বৃষ্টি ভেজা পথ
তসলিমা হাসান : জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় রাধিকা রহমান, কাল রাত থেকে অনবরত বরফ পড়ছে যেন আকাশ ভেঙে। বাহিরে তাকিয়ে দেখে এখনও বিকেল, রোদ মরে গেছে, দখল নিয়েছে অন্ধকার। সাদা বরফের দিকে তাকিয়ে মনে হয় সমস্ত দিগন্ত জুড়ে সাদা কাফনের কাপড় জড়িয়ে রেখেছে প্রকৃতি। মৃত কোন মানুষের দেহ জুড়ে অমাবস্যার কালো নিবিড় অন্ধকার জুড়ে আছে রাধিকার অন্তরে। রাধিকা ভেবে পাচ্ছিল না রুপম চোধুরী কি ভাবে ওর জীবনটা ওল্টে পাল্টে দিল। কত ভেবেছে আগামী জীবন আলোময় হবে। জীবনের অন্ধকারময় রাতগুলো কেটে যাবে কোন উজ্জল আলোয়। কোনো এক নতুন ভোরের ভাবনা নিয়ে। জীবন কখনও সরল পথে চলে না, দিনের আলোয় যখন সমস্ত পৃথিবীটা ঝক মক করে, তখনও মানুষের মনে অশুভ ছায়া পড়ে! রাধিকার বুকটা ধুক ধুক করছিল, মনটায় আলো আঁধারের ভাব। হৃদয়ে কষ্টের ঢেউতো সব সময় নিয়ম মানে না। ওর ভেতরটা বিদীর্ন হয়ে যাচ্ছিল। ওর দিন রাত কাটছিল প্রলম্বিত শূন্যতার গহ্বরে বসে। প্রতিটি মূহূর্ত আবর্তিত হয়েছে দু:খের, স্মৃতিতে প্রতিটি দিন হিরের টুকরোর মতো জ্বল জ্বল করছে এখনও। প্রথম দিনের কথা রাধিকার আজও মনে পড়ে। কত ভালোবাসার রেস, ভুলতে পারে না রাধিকা! রুপম চৌধুরী নামটা ওর হৃদয়ের ঐশ্বর্য। ররাধিকা একজন কবি, লেখিকা। জনপ্রিয় উঠছিল ধীরে ধীরে। কিশোরী সুলভ উচছলতা ওর, যেন এক সকালের তাজা ফুল। চকলেট সীলিভলেছ ব্লাউজ, বয়কাট চুল, ঝড় ঝড়ে আকাশ নীল শাড়ীতে লাগে অপরুপা, মসৃন মুখমন্ডল, অনন্য মন কাড়া সুন্দরী। দেখলে মুগ্ধতা ছুয়ে যায় হৃদয়ে, মনে। সবার চোখে ও রুপসী। অন:করনটা দেবীর মতো। অসাধারন মহানুভবতা ওর ভেতরে। মুখে ওর দৃঢ প্রতিজ্ঞা। সুন্দর মুখে সকালের আলোর মতো হাসি। অপরুপ উজ্জল মুখ। বহুমুখী প্রতিভার মাধ্যমে উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ রচনা করে। সাহিত্য সমৃদ্ধ ধারার গ্রন্থ রচনায় ওর বিশেষ কৃ্তত্বি আছে। রধিকার আজও মনে আছে প্রথম যেদিন আই ফোনে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে ঘটোনাটা। দুবার ভৎরবহফ ৎবয়ঁবংঃ আসছিল ম্যাসেজে। নোটিফিকেসন চেক করলে অনেকেই ভৎরবহফ হতে চায়। এ ভাবে কত যে আসে, রাধিকার এ সব খেয়ালও করে না। এক এক সময় ভাবনাগুলো লুটোপুটি খায় চিন্তা ধারার মাঝে। কি মনে করে ভৎরবহফ ধপপবঢ়ঃ করে। ওর একটি পরার আগ্রহ দেখিয়ে রুপম চৌধুরী প্রথম কথার আদান প্রদান শুরু করে। রাধিকা অনেক বেছে বেছে ভৎরবহফ ধপপবঢ়ঃ করে। কেন জানি ওর বেলায় তার ব্যতিক্রম হোল। ওকে মনের অজান্তেই ভৎরবহফ করে নিয়েছে। রাধিকা সেলিম আহমেদের বিবাহীতা রিভব .. সেলিম আহমেদ একজন নাম করা ব্যারিস্টার ওর স্বামীর কাছে রাধিকা এক বাসি ফুল। যার কোন সৌন্দর্য নেই, ঘ্রান নেই, অনুভূতি নেই। যেন এক নির্জন বৃষ্টি ভেজা পথ! নগ্ন পিচ ঢালা রাস্তা। যার উপর দিয়ে হাঁটা যায় কিন্তু দৌড় দিলে হোঁচট খেতে হয়। কিন্তু আসলে কি তাই? সবাই মনে করে রাধা এক রজনী গন্ধা, যার ঘ্রানে মৌ মৌ করে মৌমাছি, প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় লাল নীল হলুদ, সবুজ ফুলে ফুলে। মৌমাছি এই ফুলের মধু খায়। এতো ভাল লাগার মানুষ ও! রাধা-রুপমের কথার বিনিময়ে ভাব হয়ে যায়, এসবই ফোনের কথোপকথনে। জানা নেই একে অপরের, দেখা নেই মনে হয় কোন এক দূর নক্ষএ, রাঁধার কাছে রুপম। রাধিকা দল বেঁধে বেড়াতে গেল নীল পাহাড়ের এক সুন্দর যায়গায়। যায়গাটায় বনকে আলাদা রেখা টেনে বিভাজন করা যায় না। গাড়ি জনপদ পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় চলে বহুদূরে টিলা দেখা যায়, দেখে মনে হয় একটা শিশু আকাশের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। চার পাশে গভীর অরন্য। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোদ নেমেছে। কিন্তু শীতের কনকনে বাতাস। দু’ পাশে বড় বড় পাথর। বেদনার্ত নি:শ্বাস ভেসে ভেসে গুমরে গুমরে ছডিয়ে পড়ে। বাতাসে কাঁপে সেই আশ্চর্য সূর। দলের সাথে রাধিকা এক হোটেলে ওঠে। হোটেলের এক রুমে রস্নি আর রাধিকা। প্রথম এই সময়ে ফোন এলো, রুপম চৌধুরী ফোন করলো রাধিকা রহমানকে-
– হ্যালো, রাধিকা?
– হ্যাঁ, বলুন?
– তুমিতো করছো, বিজি?
– না বিজি না, বলুন?
– আমার তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
– তা কেন বলুনতো? আমিতো দেখার মতো তেমন সুন্দরী নই।
– কি যে বলো, তোমার ছবি আমি সব প্রোফাইলে দেখেছি।
– তা কি দেখলেন?
– তুমিতো সুন্দরী ললনা।
– আরে দুষ্টুমি করছেন?
না না আমি সত্যি বলছি। রাধিকার মনে হোল রুপমের প্রতিটি কথা প্ঙতির ছন্দে গানের সুরে বাজছে ওর কানে। রাধিকার মনে হোল ও আকাশের ধ্রæব তারা। ভালোবাসা নীরবে বয়ে যায় হৃদয়ের তন্রীতে তন্রীতে।
– রাধা তুমি চুপ করে আছ কেন বলোতো?
– কি বলবো বলুনতো? হঠাৎ রুপ ওকে বলে ফেললো, আই লাভ ইউ। আচমকা রাধিকার মনে খুশীর ধামামা বেজে উঠলো। ভালোবাসার উচ্ছ¡াসে হারিয়ে গেল সীমাহীন সীমানায়, অনন্য ভূবনে। প্রিয় রুপমের মনের সোনালি যাপিত জীবনে বিচরন করছে রাধিকা, হৃদয়ে দোলা দেয় এক রঙিন কল্পনা, আনন্দময় ফাল্গুনি ধারা। পাহাড় বর্নায় বনভূমি একই ছন্দে কলধ্বনী, হাওয়ায় হাওয়ায় মন দোলে আনন্দে আনন্দে। ভালোবাসা?
ভালোবাসা মানেইতো সুখ, পাশাপাশি দু:খতো বটেই। তবুও মাণুষতো ভালোবাসতে চায়, ইচ্ছে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আনন্দের স্রোতে ভাসে। মনে তখন সবুজ প্রকৃতি, নীল আকাশের তারা, নদীর উচ্ছল ঢেউ, জ্যোস্না ভরা আকাশ, মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকি দেয়া আলোর ছটা, বাউলের গান, পাখীর কলরব, কত কি ভালো লাগে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে ফোনের ওপার থেকে রুপ বলে উঠে – দেখি তোমাকে, একটা ফেলাইং কিছ, তোমাকে দিলাম! রাধিকা স্তব্দ হয়ে গেল, একি ভালোবাসা, এতো ভাল লাগা এ জীবনে কোনদিন অনুভব করেনি! এখন রাধিকা স্বপ্নের ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় কোন এক রাজার দেশে! মেঘমুক্ত আকাশে পরী হয়ে উড়তে চায়, জ্যোস্না, ফুলের ঘ্রান, মায়া কানন, এ সবই মনের অলম গলি ঘুরে বেড়ায়। ওদের ভালোবাসা উদ্দাম হয়ে ওঠে। সূর্যের আগুনের মতো জ্বলছে ওর হৃদয়। খুশীর অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, মনে হয় এক ফোটা গলিত স্বর্ন।
রাধিকার ছ্ন্নছাডা জীবন। ভালোবাসা পেয়ে স্বর্গ পেয়েছে। মুখর, বিমর্ষ ম্লান, দু:খ, কষ্ট সব ভুলে যায়। বজ্রভরা মেঘ দূরে সরে গিয়ে ফুরফুর করে জ্যোস্নায় ভরা মন। স্বর্গ থেকে যেন এক দেবী জলকেলা করে মনের রঙিন অরন্যে। অরন্যে রাশি রাশি ফুল, নরম ঝকঝকে রোদ খেলা করে হৃদয় গহ্বরে।
প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে সুডৌল দুই বুকে। তার উওেজনায় স্পন্দন অনু ভব করে শরীরে সৌরভে দেহে। নেশায় আচ্ছন্ন হয়। কিছুক্ষণ পরে রাধিকা চুপ হয়ে যায়। ভাবনার অতল থেকে ফিরে আসে বাস্তবে। রাধিকা বাথরুমে এসে সাওয়ারে দাঁড়াল। পরনের সাদা পাজামা আর নীল টপ্স খুলে চঞ্চলা হরীনির মতো প্রফুল্ল মনে পানিতে শরীর ভিজিয়ে সেন্নান করতে করতে উত্তেজনায় সারা শরীর কেঁপে কেঁপে রন্জিত নাভিটির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। অদৃশ্য এক যুবক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে গালে আলতো চুমু দিয়ে যেন আলিঙ্গন করছে। একটু একটু ঠোঁট ফুলছিল ওর মনে হোল। বাথরুমে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় বুকে দুটো হাত রেখে স্তনের পাশে পানির ফোটা মুক্তা বিন্দু হয়ে ভেঙে গলিয়ে ঝড়ে পড়ে ওর শরীর থেকে। ভিজে শরীরের দিকে তাকিয়ে রাধিকা ওর নাভি, স্তন দেখে। শ্বাস, প্রশ্বাসে ওর বুক কাপে। হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ভালো করে মাথা মোছা হয় না তোয়ালে দিয়ে। মন্হর ভারি পায়ে ও নীচে এসে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে ফোন বেজে চলছে। মনে হোল সেই যুবক রুপম চৌধুরী ফোনের ও প্রান্ত থেকে ওর দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। একটু দ্বিধা থ দ্বন্ধ মনের ভেতরে এসে ভীড় করে। কিছুটা হলেও মানসিক নৈকট্য এসে ভীড় করে। ফোনটা রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে আষ্টে সেই সপ্ন ঘেরা যুবকের কন্ঠ।
– রাধিকা তুমি কি করছো এখন? রাধিকা কিছুক্ষন চুপ করে থাকে, তারপর অকস্বাৎ বলে ওঠে,
– এই যে সাওয়ার নিচ্ছিলাম।
– তাই না কি? ওপাশ থেকে রুপম বলে ওঠে,
– তা তুমি একটু ভিডিও কলে আসওতো? তোমায় আমি একটু দেখি? রাধিকা ভেবে পেল না কি করবে। রাধিকা না বোঝার মতো বালিকা মতি তো সে নয়। সেই কন্ঠস্বরের মিশে ছিল নিজস্ব পুরুষের নারী গন্ধ! ও পাশ থেকে বলে উঠলো,
– আজ থেকেতুমি আমার স্বপ্নের এক ড্রিম, একড্রিম গার্ল। আর শোন মাই ডিয়ার, স্বপ্ন ফুল ফিল করতে হলে তোমাকে আমি একটু ছুয়ে দেখতে চাই। এখন একটু দেখি তোমাকে। শোন পিউরিটি বলে জগতে কিছু আছে। আজ থেকে তোমাকে আমি স্বপ্ন দেখাবো। আমি তোমাকে সেই সেন্স দিলাম। সারা জীবন আমাকে তোমার মনে থাকবে।
– দেখি তোমায় দেখি? রাধিকা তখন সারা শরীরে সাদা টাওয়েল জড়িয়ে ভিডিও কলে রপকে দেখালো, শুধু মুখটুকু। রাধিকার মনে হোল কোন এক পুরুষ মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখছিল।
রাধিকার মন তখন কোরমশ ঊন্মও হয়ে ওঠে। প্রবল আকর্ষন পুরুষের নীচে তার পেলব দেহ তখন যেন পিশে যাচ্ছে। তার দেহের ওপরে এক দারুন ক্রীড়ায় মগ্ন এক পুরুষ। নিজের সবটুকু দিতে চাইছে খুশী করতে। খুব ধীরে আদর, দেহের এক একটা ইঞ্চিতে খুব যতœ করে জাগায় ভালোবাসা। ধীরে ধীরে নিজের লিপস্কে এক উওুঙ্গ শীর্ষের দিকে যেন নিয়ে যায়, পুরুষ হিসেবে তার চোখে অদ্বিতীয় করে তোলে। সারা বিছানা যেন দাপিয়ে ফেলছে। এই সব আপাতভাবে কোনও মেয়ের স্বপ্ন পুরুষকে খারাপ লাগার কথা নয়। তবে পৌরুষের সঙ্গে তার দেহের আনাচে-কানাচে মনে হবে এক মজে যাওয়া নদী ছড়িয়ে পড়ছে। সে যেন এক আগ্রাসী প্রেমিক। শরীর নিয়ে ইচ্ছে মতো খেলা করছে। সব যেন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না যায়, তার বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে রীতিমতো আবেগ হয়ে পড়ে, বলে “আই লাভ ইউ আ লট “ ‘উড ইউ মাইন্ড স্পেনডিং দ্য রেস্ট অফ ইউর লাইফ উইথ মি” কোন সম্পর্ক ভেঙে না গেলে এক যায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। সেদিন মনে হয়েছিল রুপম ওর আলতো ঠোঁট ছুঁয়েছিল আচমকাই! ভালো লাগা – মন্দ বোধ এভাবেই কাজ করে এক পূর্ণাঙ্গ অপরুপ সম্ভারে। কয়েক মাস পরের কথা। রুপমের ভাল মন্দের হাসি কান্না একটা ডিটেল বলে দিতে পারে এখন রাধিকা রহমান। এখন আর তাপ উত্তাপ দেখায় না রুপম চৌধুরী! জীবনের এক পর্যায়ে নতি স্বীকার করে রাধিকা। আশ্চর্য রকম নিস্পৃহ থাকে। ওর দু’ চোখে ডীব্র অবিশ্বাস। পরিস্থিতি পালটেছে। অপার সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তারা পরস্পরকে ছুঁয়ে দেখেনি। জীবনও এ রকমই পাল্টে যায়। আত্তশ্লাঘা একজটিল বিষয়। সময়ে অসময়ে তা ভালোবাসার মতো বলিষ্ঠ আবেগের টুটি চেপে ধরে। দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক সচরাচর ভেঙে যায়। হার্ডল পেরিয়ে তবেই যবানিকা পড়ে। সোনা রংয়ে ভরে ওঠা সোনালি হৃদয় ভেঙে যায় নিয়তির কাছে! টরেন্টো
দীর্ঘশ্বাসের সাথে যার বসবাস
আবুল খায়ের : ‘প্রভার’ দুরন্তপনার বয়স এখনও আছে। সাথীদের সাথে আড্ডায় সিনেমার গল্প করা, ফুলের বাগানে প্রজাপতি দেখা ও ধরতে চেষ্টা করা। পড়তে বসা নিয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা ছোট ভাইয়ের সাথে। খাবার টেবিলে কে আগে গেলো, কে আগে খাওয়া শেষ করলো এসব নিয়ে অম্ল-মধুর বির্তক নিয়ে সালিশ করতে হয় বাবা-মা’কে প্রতিনিয়ত। তবে মজাও হয় অনেক সময়।
মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। চাকরি আর বেশি দিন নেই। ‘প্রভা’ বাবার অতি আদরের মেয়ে। সব বাবাই মেয়েদের একটু বেশি আদর করে থাকেন। প্রথম সন্তান যদি মেয়ে হয় তো আরো কদর বেড়ে যায়। তবে দ্বিতীয় সন্তান যেন ছেলে হয় সে প্রত্যাশাতো থাকেই। পরপর আরো দুইবোনসহ মোট তিন বোন ও এক ভাইয়ের সুখের নীড়। বাবার আদর্শ পেশা ও সীমিত আয়ের সংসারে বেড়ে ওঠার কারণে তেমন কোনো চাহিদাও ছিলো না ‘প্রভা’র। পড়ালেখা শেষ করবে একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশাতো দোষের নয়।
ভালো ছেলে হাত ছাড়া করতে কোনো অভিভাবকই চান না। সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত কতোদিন থাকতে দেয়া যায়? এসএসসি শেষ করেই বিয়ের পিড়িতে বসতে কার মন চায়? বিয়ের জন্য কোন প্রকার মানসিক প্রস্তুতি না থাকা সত্তে¡ও মেনে নিতে হবে নিয়তি। বাঙালি মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে কোনো রকম মতামত দেয়ার সুযোগ নেই। পরিবারের কর্তাদের সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। অগত্যা শশুরালয়ে যেতে হবে না। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ তো থাকছেই।
শিক্ষিত চাকরিজীবী স্বামী। পরিবারের অবস্থাও ভালো। দেখতে একটু কালো হলেও বেচারার হাসিটা সুন্দর। মনে মনে ভাবে আর মনের অজান্তেই হি হি করে হাসে-প্রভা। তাছাড়া কলেজের শিক্ষক হলেতো আর কোনো অজুহাত নেই বিয়েতে অমত করার। ইচ্ছেয় হোক আর অনিচ্ছায়- অনেক কিছুইতো মেয়েরা মেনে নেই সমাজের প্রচলিত প্রথার কাছে নিজেকে বলি দিয়ে।
মেয়েদের আপন নিবাস বলতে কিছু নেই। ছোট বেলায় বাবা’র বাড়ি। বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি। অনেকটা-তোমার বাড়ি কই গো নারী, তোমার বাড়ি কই? শশুর বাড়িতে বয়স্ক শশুর-শাশুরির খেতমত করা, দেবর-ননদ তো আছেই একটি বাড়তি জামেলা, যেটা অধিকাংশ মেয়েরা প্রত্যাশা করে না। তারপর শিক্ষকের আসনে যাকে ভাবা হয় তাকে যদি স্বামী হিসেবে পাওয়া যায়, তবে কেমন হবে?
দেখতে দেখতে জীবনের অনেকগুলো জগন্য ও দুর্বিসহ দিন কেটে গেল। ভাবতে ভাবতে কখন যে নোনা জলে ভিজে গেল গন্ডদ্বয়, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু এছাড়া আর কি করার ছিলো। কোনো উপায় কী ছিলো? হয়তো ছিলো। কিন্তু। সংসার ছেড়ে গেলে লোকের কাছে তামাসার পাত্র হয়েই থাকতে হতো সারা জীবন। দ্বিতীয় বিয়ে করা যে কতো কঠিন আমাদের সমাজে। কারণ প্রথম বিয়ে হতে হতে অনেকেই বিয়ের বয়সটাই শেষ হয়ে যায়, আবার দ্বিতীয় বিয়ে! সমাজে দ্বিতীয় বিয়েকে কেউ সহজভাবে বা ইতিবাচক হিসেবে নেয়া হয় না। সেটা যতো যৌক্তিক হোক না কেনো।
ছোট সুখি পরিবার! সবি আছে। তবে কোথায় যেনো কিছু একটা নেই। প্রথম সন্তান ‘মায়িশা’ পড়ালেখায় ভালো। কন্যা সন্তান হলেও তাকে মেয়ে হিসেবে বিচার না করে তার ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই এগুতে হবে। মা’য়ের অপূর্ণতা যেনো মেয়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়, সেটাই এখন প্রধান লক্ষ্য। মেয়েও ছোটবেলা থেকেই মায়ের বোবা কান্না দেখতে দেখতে নিজেকে নতুন করে আবিস্কারের নেশায় মত্ত। খেলাধুলায় বেশ মনোযোগি। শরীরটাও সেভাবে তৈরী করেছে। ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা যবনিকা টেনে চাকরি শুরু। কমিশন নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান। দীর্ঘসময় ধরে প্রশিক্ষণ শেষে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করবে।
একমাত্র ছেলেটিও ক্যাডেটে পড়ছে। ভবিষ্যতে বোনের পথই অনুসরণ করবে হয়তো। দু’দুটো সন্তান যারা সুন্দর জীবনের পথে নিজেদেরকে তৈরী করতে ব্যস্ত। এ না হয় জীবন। হয়তো এটাই জীবন। কিন্তু ‘প্রভা’র তবুও কেনো যেনো মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। কোথায় যেনো একটি অপূর্ণতা তাকে নাড়া দিয়ে যায় প্রায়শই। কী নেই তার? স্বামী, সন্তান? জীবন যাপনের জন্য অর্থ বা সামাজিক মর্যাদা সবইতো আছে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু নিজেকে প্রকাশের কোনো সুযোগ না পাওয়ার বেদনা কোনোদিন কী মুছে যাবে?
মেয়ে এবং ছেলে দু’জনই বাড়ির বাহিরে। স্বামীর চাকরি আর মাত্র কয়েকটা বছর। অসুস্থ স্বামী ছাড়া বাসায় আর কেহ নেই। ডায়াবেটিস রোগীর পথ্য তৈরী ও সামান্য কিছু রান্না করতে পারলেই দিনটি সফলভাবে শেষ করা যায়।
সময় যে কাটে না। স্বামী অফিসে, ছেলেটা হোস্টেলে আর মেয়েটা চাকরিতে। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গ করে আর কতোদিন কাটাতে হবে? এটাই কী জীবন? এটাই কী জীবনের চাওয়া পাওয়া? নাকি অন্য কিছুরও প্রয়োজন আছে জীবনে?
সন্ধ্যে হলেই কষ্টগুলো যেনো বাড়তে থাকে। বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে আকাশ দেখা, পাখিদের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখলে মন আর মানে না। নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনে শুনে সন্ধ্যাটা না হয় কাটে, কিন্তু রাত? রাত কেটে কখন যে হবে ভোর, এক একটা ভোর যেনো এক একটা নতুন জীবন। এক একটা দিন মানে এক একটি জীবনের না বলা গল্প।
(লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক)