মণিজিঞ্জির সান্যাল : আঘাত কি মানুষকে শক্ত করে? মনে হয় করে কিন্তু অনেক সময় সেই আঘাত এতোটাই বিধ্বস্ত করে যে অনেক ক্ষেত্রে তখন মৃত্যুর কাছেই নিজেকে সে সমর্পন করে। ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা এমন-ই একটা আঘাত।

মন খারাপ আর বিষণ্ণতা কিন্তু এক জিনিস নয়। মন খারাপ হলে কিছুদিন পর তা ঠিক হয়ে যায়। যেমন রেজাল্ট ভাল না করা, কারো মৃত্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বলি “আমি খুব বিষণ্ণ” বা “আমি খুব ডিপ্রেসড” কিন্তু বাস্তবে তাকে বলে মন খারাপ, এই প্রবল মন খারাপকেই ইংরেজিতে বলি sadness. এটি কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়, আমরা তখন স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরে আসি।

কিন্তু ডিপ্রেসন বা বিষণ্ণতা কিন্তু অন্য জিনিস। ধীরে ধীরে সেটি আরো যেন আঁকড়ে ধরে। এমনকি শেষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

ডিপ্রেশনের উল্টোটা মানেই এই নয় যে তিনি সারাদিন হৈ হৈ করে বেড়ানো। ডিপ্রেশনের উল্টোটা হচ্ছে এই যে তিনি স্বাভাবিক জীবন- যাপন করেন। সময় মতো স্নান- খাওয়া- অফিস- ছেলে মেয়েদের সাথে খেলা গল্প ইত্যাদি।

কিন্তু যারা ডিপ্রেশনে আছেন তাঁরা বিছানা ছেড়ে উঠতেই চাইবেন না, কোথাও যেতে চাইবেন না। শরীরে কোনো অসুখ না থাকলেও শরীরকে টেনে নিয়ে যাওয়াই তার কাছে বিড়ম্বনা। সমস্যাটা কি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন ভীষণ একটা শূন্যতা, কি যেন নেই নেই। এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা থেকেই জীবনকে তাঁর তুচ্ছ মনে হয়। এরপর জগৎ সংসারের সব কিছু তার শূন্য মনে হতে থাকে এবং সেই ভাবনা থেকেই আত্মহত্যার ভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে।
অনেকেই আমরা বলে থাকি “কি কাপুরুষ জীবন থেকে পালালো” কিম্বা বলি “কি বোকা নিজের জীবনকে এইভাবে কেউ শেষ করে!” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখেছি কি যে কতোটা শূন্যতা থেকে একটা মানুষ নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে পারে! আমরা অনেক সময়ই বলি ডিপ্রেশান এক ধরনের শৌখিনতা। আসলে আমরা যা কিছুই বিচার করি তা আমাদের অভিজ্ঞতার আলোকে, আর যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে তা নিয়ে রূঢ় জাজমেন্ট করতে আমাদের খুব একটা সময় লাগে না।

আমরা অনেক সময়ই এমন কিছু মানুষকে দেখি, বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় তাঁর দুঃখ থাকার মতো কিচ্ছু নেই। কিন্তু কি ভয়ানক শূন্যতা নিয়ে তাঁরা বেঁচে আছেন। তাঁরা কারো কাছে নিজের কথা বলে একটু হালকা হতে চান, এর বেশি কিছু কিন্তু তাঁদের চাহিদা নেই।
একজন ডিপ্রেসড মানুষকে দুম করে জাজ করাটা কিন্তু ঠিক নয়। তাঁকে বোঝাতে যাওয়াও ঠিক নয় যে দেখো তোমার চেয়ে অন্যদের জীবন কতো ভাল; আমরা কি একজন ক্যান্সার রোগিকে এই কথাগুলো বলি?

বরং তাঁর কথাগুলো মন দিয়ে শুনলে তিনি অন্তত বুঝবেন যে এই পৃথিবীতে তিনি একা নন, কেউ একজন অন্তত আছে তাঁর কথা শোনার। হয়ত এই বিশ্বাস থেকে তিনি আবার তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতেই পারেন।

দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎসের বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি “…which does not kill us makes us stronger”
এবারে একটি ডিপ্রেশন জয়ের গল্প শোনাই।

নাম তার সোনিয়া, জন্ম নিউইয়র্কে। তিন বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাবা ছোটখাটো ব্যবসা করেন। মা গৃহবধূ। সোনিয়া বরাবরই পড়ালেখায় খুব ভালো, বিশেষ করে অঙ্ক আর বিজ্ঞানে। ওদের পরিবারে কারোরই তেমন লেখাপড়া নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমেরিকান সাদা পরিবারে এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। তা ছাড়া যে সময়ের ঘটনা, সে সময়ে মেয়েরা গণিত, বিজ্ঞান- এসব বিষয়ে কম পড়ত। হাইস্কুলে পড়ার সময় কেমন করে যেন ওর শখ চাপল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। ওর বন্ধুবান্ধবও খুব হাতে গোনা। স্কুলের মেয়েরা বেশির ভাগ সে সময় সাজগোজ, কনসার্ট, পার্টি নিয়ে ব্যস্ত। বয় ফ্রেন্ড আর ডেট খুঁজতেও ব্যস্ত। সোনিয়ার সঙ্গে ওরা খুব একটা ভাব জমায় না। এমন নয় যে সোনিয়ার ইচ্ছে করে না, কিন্তু তার ধরনটাই অন্য রকম। ছেলেরাও তার প্রতি তেমন বেশি আগ্রহ দেখায় না। তাও যে দু–একজনের সঙ্গে একটু ভাবসাব হয়েছিল, খুব একটা বেশি এগোয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে সে। তা ছাড়া ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়বে এ উত্তেজনায় সে তখন অনেক বেশি স্বপ্নে বিভোর।

ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সে কিছুটা ঘাবড়ে গেল। তার ক্লাসে সে একা মেয়ে। অনেকটাই একা হয়ে গেল সে। তাছাড়া হাইস্কুলে রেজাল্ট যত ভালো হতো, এখানে পড়ালেখা অনেক বেশি কঠিন। সে হয়ে গেল একজন মাঝারি মানের ছাত্রী। সব মিলিয়ে তখন থেকেই অল্পস্বল্প ডিপ্রেশনের শুরু। তবে অন্য একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ক্লাসে একমাত্র মেয়ে বলে সব ছেলেই তার কাছে ঘেঁষতে চাইত। সেও যে ব্যাপারটা উপভোগ করত না তা নয়। তবে ভাবেনি ক্লাসের সবচেয়ে তুখোড় ছেলে কাইলের সঙ্গে তার প্রেম হবে। কাইল শুধু পড়ালেখাতেই দুর্দান্ত নয়, মানুষ হিসেবে চমৎকার, প্রবল রসবোধ আর সুদর্শন। সেই তুলনায় সোনিয়াই বরং খুব সাধারণ। তাদের গভীর প্রেম হয়েছিল, বিয়েও হয়ে গেল যথা সময়ে। কাইলের মতো অত ভালো রেজাল্ট না হলেও দুজনেরই নামকরা কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেল। বিয়ের পর কয়েক বছর বেশ ভালোই কাটল।

এরপর কোথা থেকে যেন দুষ্টু এক টুকরো মেঘের মতো সোনিয়ার অসুখটার শুরু। প্রথম প্রথম এটা যে কোনো একটা অসুখ, সেটাই তো কেউ বোঝেনি। ও নিজেও না। খালি কী যেন শূন্যতা। কোনো কাজে আগ্রহ পাচ্ছিল না। সন্তান নেওয়ার আলোচনা উঠলেই ও ঘাবড়ে যেত। কাইলের কাছে সময় চাইত। আপাতদৃষ্টিতে জীবনের কোথাও কোনো অপূর্ণতা নেই। অথচ কী গভীর বিষাদ ঘিরে ধরত ওকে। কাইল খুব বাস্তববাদী মানুষ। জীবনে নানা ঘাত–প্রতিঘাত খাওয়া। প্রথম প্রথম সোনিয়ার সমস্যাই ও বুঝতে পারছিল না। এরপরও ডাক্তারের কাছে গেছে ওর অনুরোধে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে অনেক ওষুধ বদলে, বিভিন্ন থেরাপিস্ট বদলেও কাজ হচ্ছিল না। সোনিয়ার এক সময় কাইলকেও অসহ্য লাগতে শুরু করে। অদ্ভুত রকম ভাবে ও জড়িয়ে পড়ে অফিসের এক কলিগের সঙ্গে। নতুন সম্পর্কের উত্তেজনায় প্রথম কিছুদিন মনটা একটু হালকা লাগছিল। তারপর অবৈধ শারীরিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। আর তারপরই একধরনের অবসাদ ঘিরে ধরল তাকে। বিষণ্ণতার সঙ্গে যোগ হল অপরাধ বোধ। কিছুদিন নিজেকে নিজেই শাসন করে চলল সে। কিন্তু না। আনন্দের সন্ধানে আবার জড়িয়ে পড়ল সে আরো একটি সম্পর্কে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কোনো স্বস্তি পাচ্ছিল না। বরং অপরাধ বোধ, বিষণ্ণতা সব তখন চরম পর্যায়ে। জীবনের উদ্দেশ্য কী, এই চিন্তা দিনরাত তখন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জীবনের কোনো উদ্দেশ্য না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সে আত্মহত্যার চিন্তা করতে লাগল। ডাক্তার তার এই চিন্তা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে দেবদূতের মতো তার জীবনে এসেছিল এক নার্স। যে তার পাশে বসে প্রার্থনা করত। সেই তাকে জীবনের মূল অর্থের সন্ধান দিয়েছিল। ঈশ্বরের প্রেম, জীবে প্রেম আর তার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি অর্জন। সে এত দিন চারপাশের মানুষের মাপকাঠিতে নির্ধারিত সংজ্ঞায় জীবনকে সাজাতে চেয়েছিল। আর সেই সংজ্ঞাটা তার কাছে অর্থহীন মনে হতো। যখনই কোনো ব্যর্থতা আসত, সে আতঙ্কিত হতো। মনে হতো তাকে কেউ সম্মান করবে না, ভালোবাসবে না। কিন্তু ঈশ্বরের প্রেম শর্ত সাপেক্ষ না। এই একটি জায়গা, যেখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, ব্যর্থতা নেই। বরং তার দুশ্চিন্তার ভার দিয়ে দেওয়া যাবে ঈশ্বরের ওপর। আর ঈশ্বরের সৃষ্টি যে মানুষ, তার সেবা করলে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি আর সেটাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে থেরাপিস্টের সঙ্গে গিয়ে সে নতুন করে আলোচনা শুরু করে। এত দিন থেরাপিস্ট এসব বললেও সে ঠিক অনুধাবন করতে পারেনি। তার একদমই বিশ্বাস ছিল না। এখনো অনেক বিশ্বাস তা নয়, তবে সে বিশ্বাস করতে চায়। এই পথটা সে খুঁজে দেখতে চায়।

তারপর থেকে সোনিয়ার জীবন বদলাতে শুরু করে। প্রথম কাজটা ছিল সব চেয়ে কঠিন। কাইলের কাছে সব স্বীকার করা। তার সমস্ত ভুলের কথা। সে প্রায় নিশ্চিত ছিল কাইল তাকে ছেড়ে চলে যাবে। তবুও সব সাহস সঞ্চয় করে সে বলল এবং অবাক হয়ে দেখল আরেক দেবদূতকে। অনেক ভেঙে পড়েও নিজেকে সামলে নিয়েছিল যে সোনিয়ার কাছে ঈশ্বরের দ্বিতীয় রূপ হয়ে যেন এসেছিল কাইল। সোনিয়া বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। নিয়মিত চার্চে যাওয়া শুরু করল। বাইবেল পাঠ আর ঈশ্বরের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া। চার্চের নতুন বন্ধুরা অনেক সাহায্য করল। কাইল ঈশ্বরে অতটা বিশ্বাসী না হলেও সোনিয়ার বিশ্বাসের কোনো অমর্যাদা করেনি। ওষুধ ছাড়তে পারেনি সোনিয়া। থেরাপিস্টের কাছেও যেতে হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে একধরনের স্থিরতা সে অনুভব করছিল। জীবনের প্রতি অনীহা কমে গেল, যদিও জীবনের মূল লক্ষ্য গেল বদলে।

নিজেকে আবিষ্কার করল সে নতুন রূপে, জীবনকে সে ভালোবাসতে শুরু করল।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ