হিমাদ্রী রয় : বৈশাখ এই মাসের নাম শুনলেই স্মৃতির সিন্ধুক খোলে যায়। গ্রাম ছাড়িয়ে মেঠোপথ, কাঁদাজলে খেলা করা দামাল ছেলের দল, ষাড়ের লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, মামার বাড়ি বেড়ানো, মামীর হাতের মালপোয়া, দিদিমার ঝুলির লম্বা কাহিনি আর কিস্যা এইতো ছিল জীবনের অনমূল হিস্যা।

পুবের বাতাস ধানের ক্ষেতে ঢেউ এলিয়ে, ঝরের দিনে কাঁচা আম কুড়ানোর সুখ নিয়ে আসতো বৈশাখ।

সেই বৈশাখ সময়ের কাছে এখন অনেক দামী। শৈশবের সব তারার স্বপ্ন ধুয়ে যায় যৌবনের বর্ষার জলে। ছেলেবেলায় চার দেয়ালের বন্দি জীবনে ঘরে থাকতে চাইতো না মন এখন স্বাধীন জীবন অথচ কেবলি মনে হয় ঘরে ফিরবো কখন। জান্টুদার চা-সিঙারা আর বুন্দিয়ায় কিছুতো যাদু ছিল, হরিদার আমেত্তি আর লালমোহনে কিছুতো মধু ছিল। যৌবন লোভ দেখিয়ে সেই শৈশব কেড়ে নিল।

এমন আমির কি আর হয় যে কিনতে পারে বয়ে যাওয়া সময়কে। তাই বৈশাখ এলে আমার ভিতরে খোঁজে পাই সেই ছোট্ট আমিটাকে। পালট ফিরে দেখলেই পলকে নিয়ে যায় সেই তেপান্তরের মাঠে যাকে ছেড়ে এসেছি চৈত্রের বনপলাশে, ফুটবল মাঠের ঝগড়ায় যে বন্ধুটির সাথে হয়েছিল কাট্টি, এখন সময় নিয়ে তার খোঁজে ইন্টারনেটের পথে হাঁটি।

পাশের মহল্লার, প্রেমগলির লম্বা বাড়িটির চার নম্বর খিরকিতে, খোলা চুলে মনের ভুলে আবছা আলোয় কারো চাহনির জন্য কত সন্ধ্যা হয়েছে মাটি।

মাটির বড় মায়া আর মায়ায় বদ্ধ মন তাইতো অনুমতি না নিয়েই সে চলে যায় স্মৃতির পলিমাটি ধরে যখন-তখন।

এখন কর্মহীন অবসরে মনে পড়ে তাকে, যে আছে অন্য কারো আঙিনাতে, অন্য জীবন ঘিরে একদিন যে বলেছিল ভেজা হাতে ডেকে
‘এখানে আম কুড়াবার ধুম লেগেছে চলনা অন্যকোথাও যাই’।
মাঝে মাঝে স্বপ্নে আসে কৃষক আবু দাস খালি পায়ে মাইল দুই হেঁটে আসতো বাবার কাছে ধানের থুর বেড়িয়েছে এই খবর দিতে। মাটিও যে মা এটা কৃষকের চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।

হয়তো তাই কৃষককে মাটির বুকে জুতা পায়ে হাঁটতে দেখিনি কোনদিন। ব্যাংক লোন চুকাতে না পেরে দেশ ছেড়ে যায় না কোন কৃষক। খুব সহজেই যেটা করতে পারে শিক্ষিত কর্পোরেট বাবু আর সাহেবেরা। অকস্মাত হাঁক দেয় হিরালাল পাহাড়াদার। ঘুমের দেশে অন্ধকার রাতে লন্ঠন হাতে খবরদার বলে দিত হাঁক, ঘুমিয়ে পড়তাম নিশ্চিন্তে।

চৈত্র মাসে অন্তস্বত্তা মাটিতে যখন থুর আসতো ধানে তখন মন মেতে উঠতো প্রারম্ভিক বৈশাখী পার্বণে। যাকে আমরা বলি ফসলের সাধ ঠিক যেমন করে গর্ভবতী মাকে, সাধ কিংবা বেবিসাওয়ার দেয়া হয় ঠিক সেই রকম। সকাল বেলায় স্নান সেরে বৌদিরা রান্না করতেন পায়েস আর পুলি পিঠা তারপর মাটির সানকিতে করে বাড়ির রাখালকে দিয়ে পাঠানো হতো হাওরে। ঈশান কোণে কলাপাতার উপরে কিছু পায়েস-পুলি রেখে, আশেপাশের গরু চড়ায় এমন রাখালদের সাথে ঘাসের উপর বসে সেই পায়েস-পুলি খাওয়া, মজব না জেনে বন্ধু হয়ে যাওয়া, সেই দিন ফিরে আর আসবে কি কখনো এই রেওয়াজ প্রজন্ম জানবে কি কখনো?

শিবকে মানা হয় কৃষির দেবতা- ইতিহাস থেকে নয় জেনেছি গাজনের মেলায় যেয়ে। এই পোড়া দেশে ইতিহাসে গ্রীক দেবদেবী কিংবা গ্রীক কৃষির দেবতা নিয়েও পড়ানো হয় শুধু হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য কৃষির দেবতা শিবের নাম জানে না শিক্ষার্থীরা।
বর্ষা আরম্ভ হওয়ার আগ পর্যন্ত চৈত্রের প্রখরতা থেকে মুক্তি পেতে অতীতের তীর হতে কোন এক সময় কৃষক সমাজ এই গাজনের মেলার উদ্ভাবন করেছিল।

উপবাস থেকে বাড়ি বাড়ি যেয়ে তারা দান গ্রহণ করতো, শিব মন্দিরকে ঘিরে হতো এই আয়োজন আর চড়কের মেলা। এই লোকায়ত সংস্কৃতি অনুসরণ করেই আসে পহেলা বৈশাখ। রাত জেগে সাঝের উপর কর্নফুলি কাগজ রেখে ঝালর কাটা, ভোরবেলা আধো অন্ধকারে স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় আর রসগোল্লায় রসময় হালখাতা। কবে যে শুধুই ইলিশ-পান্তা হয়ে গেল পহেলা বৈশাখ এই নাগরিক কোলাহলে কে জানে। বৈশাখ মাসের আনন্দ দ্বিগুণ করে দিত গরুর গাড়ি। দুটি ষাঁড়ের কাঁধে জুড়ে দেওয়া হতো গাড়ি। সেই গরুর গাড়িতে চড়ে কতবার গিয়েছি হালির হাওরে। বাবা প্রতিদিন সকালে কথা বলতেন গরু দুটির সাথে। একটির নাম কালা আর আরেকটির ধলা মানে সাদা। একদিন কালা চলে গেল পরপারে; সকালবেলা দোকানের বারান্দায় বসে কাঁদছেন বাবা, অবাক আমি বোবা প্রাণির জন্য কেউ এভাবে কাঁদতে পারে! যেমন করে পিতা কাঁদে সন্তানের লাশের উপরে। সেই দুঃখভোগ আজো তারা করে।

বৈশাখ আসলেই একটি দার কাক এসে কা কা করে আমার দেখার আকাশ জুড়ে মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা স্মৃতির নামে পিন্ড না দিলে পিছু ছাড়বো কি করে। পাগল হাওয়ার বাদল দিনে বসে ভাবি আনমনে আমাদের ছেলেটা কোনদিন দেখবে না ঠাকুমার হাতের আমসত্ত¡, ছিক্কাইতে (হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখার জন্য পাটের তৈরি হস্তশিল্প) কাঁচের বয়ামে আমের আঁচারে ঠাসা, জ্বরগায়ে মাথায় পানি ঢালারত মায়ের একটু বেশি ভালোবাসা। আমি দেখেছি, আমরা দেখেছি, আমরা পেয়েছি।

বিনা মতলবেও হাসা যায় শৈশবে শিখেছিলাম। আর কাঁদতে এখন জীবন শিখিয়ে গেছে।
কাগজের আঠা আর বর্ষার পানি বড় উদাস এই নাগরিক কোলাহলে। কাগজের নৌকা বানানোর ছেলেগুলো সব বড় হয়ে গেছি বলে। হিজল পুকুরের সেই হাঁস গুলি জলকেলি করে আর চৈ চৈ করে আজো ডাকে আমারে, মন যমুনার জলবিহারে।