সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: ছয়
অয়নের ডায়েরি
রোববার
৩রা জুন ১৯৮৪।
আমার জন্ম কর্ণফুলীপারের চট্টগ্রামে। অপুর জন্ম পদ্মাপারের বিক্রমপুরে। কিন্তু আমাদের দুজনেরই শৈশব ও কৈশোর কেটেছে শীতলক্ষ্যা পারের নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ তখনো ব্যস্ত শহর হয়নি। বলা যায় ওটা ছিল ঢাকার অদূরে ছোট্ট একটি শহরতলি। মূলত বন্দর-শহর।
দূরদূরান্ত থেকে পাটের নৌকোগুলো এসে নোঙর ফেলত এই বন্দরে।
অনেক পাটের কল ছিল, ছিল সুতোর কারখানাও। নারায়ণগঞ্জকে তখন বলা হতো প্রাচ্যের ড্যান্ডি। অপুর বাবা আর আমার বাবা দুজনেই ছিলেন পাট ব্যবসায়ী।

এই শহরতলিরই একটি এলাকা জামতলা। শুনেছি কোনো এককালে প্রচুর জামের গাছ ছিল ওখানে। ওখানেই ছিলাম আমরা। পাশাপাশি বাসায়। আমরা তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি।
ছোটবেলায় অপুর বাবা অথবা আমার বাবার হাত ধরে অপু আর আমি নারায়ণগঞ্জ বন্দরে গিয়েছি বহুবার। শীতলক্ষ্যার পারে ওই বন্দরে সপ্তাহে দুবার হাট বসত। ওই হাটে কত কিছু যে পাওয়া যেত, বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমার আর অপুর সবচাইতে পছন্দের জিনিস ছিল তালমিছরি! হাটে গিয়েই বাবা আমাদের হাতে তুলে দিতেন তালমিছরি। তালমিছরি খেতে খেতে আমরা যেতাম নদীর ধারে। বাবা কথা বলতেন পাটের মহাজনদের সাথে।

অপু আর আমি আসন গেড়ে বসতাম নদীর পাড়ে। আমাদের দৃষ্টি শীতলক্ষ্যার ওপর ভেসে বেড়ানো শত শত নৌকো, লঞ্চ আর স্টিমারের ওপর। ওই নৌকোগুলোর কোনোটায় পাট, কোনোটায় আলু আবার কোনোটায় থাকত বালু।
নৌকোগুলোর কোনোটা পালতোলা, কোনোটা গুনটানা, কোনোটা বিশাল, কোনোটা ক্ষুদ্র। পালগুলোও ছিল বিভিন্ন আকারের, বিভিন্ন বর্ণের! কোনো কোনো দিন বাতাসের বেগ থাকত। ঝোড়ো হাওয়া থাকত। পালগুলো ফুলেফেঁপে উঠত বোয়াল মাছের পেটের মতো!
ওই দৃশ্য দেখে আমাদের সে কী উচ্ছাস!
সে কী আনন্দ!
আমাদের মনে হতো, ওই নদীটা আমাদের! নদীর ওপরে ঘুরে বেড়ানো সব নৌকো আমাদের!
নদীর ওপরে ঝুঁকে পড়া বিশাল আকাশ। ওই আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। মেঘ দিয়ে তৈরি হতো কতশত নকশা! কখনো নৌকা, কখনো জাহাজ, কখনো জীব-জন্তু, কখনো-বা বিশাল বিশাল দানব। ওরা যেন পাললা দিত নদীতে বয়ে যাওয়া ওই নৌকোগুলোর সাথে। পাল্লা দিতে দিতে হারিয়ে যেত ওই আকাশেই। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম সেই সব দৃশ্য!
অপু বলত, ‘অয়ন, আমি বড় হয়ে বিশাল একটা নৌকো বানাব। একদিন তুই আর আমি ওই নৌকো করে চলে যাব।’
আমি বলতাম, ‘অপু, কোথায় যাবি?’
অপু বলত, ‘দূর অজানার দেশে। যেখানে কেউ যায়নি কখনো।’
এত বছর পরও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে সেই সব স্মৃতি!
সেই সব কথা!
মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, অপুকে বলি-অপু, আমি তো অজানার দেশেই যাচ্ছি, তোর নৌকোটা ধার দিবি?
অপুকে এই কথাটা বলা হয় না!
কৈশোরে আমরা যে এলাকায় থাকতাম, সেখানে বেশ কিছু হিন্দু পরিবার ছিল। তবে বৌদ্ধ বলতে আমরাই। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধা হয়নি। সেই সময়টাতে ধর্মীয় স¤প্রীতি ছিল। জামতলায়, আমাদের বাড়ির ঠিক সামনেই ছিল সেনবাড়ি। বিশাল পুরনো ইমারত। চারদিকে উঁচু দেয়াল দেওয়া। ভেতরে বিশাল বিশাল গাছ।
সেনবাড়িতে সারা বছর পূজা-পার্বণ চলত। সবচেয়ে বড় ছিল দুর্গাপূজা। বিশাল উত্সব হতো। ওই উত্সবে আমরাও নিমন্ত্রণ পেতাম। প্রসাদের লোভে সব পূজা-পার্বণেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম।
লোভ আরেকটা ছিল!
বাসন্তীকে দেখার লোভ!

বাসন্তী সেনবাড়ির ছোট মেয়ে। ওকে প্রথম দেখেছিলাম পূজামণ্ডপে। কুমারীপূজার দেবী হিসেবে!
আহা! ওইটুকুন একটা মেয়ে!
কত আর বয়স হবে!
আট বা নয়।
কী অদ্ভুত সুন্দরই না ছিল!
ওকে একনজর দেখার জন্য সেনবাড়ির আশপাশে আমি আর অপু কত ঘুরঘুর করেছি!
কিন্তু দেখা মিলত না বাসন্তীর।
বাসন্তীর দেখা মিলত পুরো বছরে মাত্র কয়েকবার।
শুধুই পুজোর সময়ে!
অবশেষে একদিন এল সেই শুভক্ষণ।
দেবী বাসন্তীর দেখা মিলল। সেনবাড়ির সামনেই। ঘটনাটা খুলে বলি। আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনেই ছিল বিশাল একটা ছাড়াবাড়ি। সবাই বলত অম্বিকাসার বাড়ি। বাড়ির মালিক অম্বিকা সাহা বহু বছর আগে পরিবার-পরিজনসহ পাড়ি জমিয়েছিলেন কলকাতায়।
কেন?
কেউ তা জানে না।
জানতাম না আমরাও।
ওই বাড়িতে দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার। চারদিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে আম, জাম আর আমরুজের গাছ। সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়ালে চোখে পড়ত বেতফল আর ডেউয়া। আমি আর অপু সময় পেলেই হামলা চালাতাম ওই বাড়িতে।
সেদিনও চালিয়েছিলাম। আমাদের সংগ্রহে দুটো ডেউয়া আর কয়েক থোকা বেতফল। ওগুলো নিয়েই সেনবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরছি অপু আর আমি।
কে যেন বলল, ‘ও মা, কী সুন্দর বেতফল! কী সুন্দর ডেউয়া! অম্বিকাসার বাড়ি থেকে এনেছ বুঝি?’
আমাদের হাঁটায় ছেদ পড়ল। আমরা থমকে গেলাম। ঘুরে তাকালাম।
অবাক হয়ে দেখি, বাসন্তী!
সেনবাড়ির ছোট মেয়ে বাসন্তী!
কুমারীপূজার দেবী বাসন্তী!
দেবীরাও কথা বলে! একি সত্যি!
বাসন্তী দাঁড়িয়ে ছিল ওর মায়ের সাথে। ওর মা আমাদের চিনতেন। আমরা এগিয়ে গেলাম। এটা-সেটা আলাপ হলো। বাসন্তীর উচ্ছ্বাস দেখে ওর হাতে তুলে দিলাম এক থোকা বেতফল। অপু তুলে দিল একটা ডেউয়া।
এ যেন দেবীসনে পূজার অর্ঘ্য!
আরেক দিনের কথা আমার বেশ মনে পড়ে।
হেমন্তের সকাল।

ছুটির দিন।
খুব ভোরে অপু আর আমি যাচ্ছিলাম অম্বিকাসার বাড়ি। যাওয়ার পথে দেখি সেনবাড়ির দরজাটা আধেকটা খোলা।ওই আধেক খোলা দরজা দিয়েই আমরা ঢুকে পড়লাম সেনবাড়ির ভেতরে। বিশাল উঠোন। উঠোনের এক প্রান্তে ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসীতলা। তুলসীতলার পাশেই একটা শিউলি ফুলের গাছ। তুলসীতলা আর শিউলিতলা দুটোই ছেয়ে আছে ফুলে ফুলে!
ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের বাতাসে!
ওই গন্ধে মাদকতা ছিল!
মুগ্ধতা ছিল!
মাদকতা আর মুগ্ধতা নিয়েই আমরা এগোলাম সামনে। চোখে পড়ল একটি চিলেকোঠা। চিলেকোঠায় ঠাকুরমূর্তি। মূরতির সামনে দাঁড়িয়ে দুজন।
বাসন্তী ও তার মা!
দুজনেরই পরনে নীল শাড়ি!
কপালে চন্দনের ফোঁটা!

হাতে ছোট্ট ডালা।ওই ডালায় গাঁদা, শেফালি আর রক্তজবা! ফুলের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ আর সকালের হালকা রোদ সব মিলিয়ে স্বপ্নপুরীর স্বপ্নদৃশ্য!
বাসন্তীকে ওই আমাদের শেষ দেখা।
শুনেছি হেমন্তের আরেক রোদেলা ভোরে ওরা চলে গেছে কলকাতা।
পাখি উড়ে যায়, পালক পড়ে থাকে।
পালক পড়ে থাকে গাছের পাতায়, গাছের শাখায় অথবা গাছের তলায়।
পালক পড়ে থাকে বুকের তলায়ও!
আমিও উড়ে যাব খুব সহসাই।
আমার ঝরা পালক কি লুকিয়ে থাকবে কারো বুকের তলায়?
বাসন্তীরা কলকাতা চলে যাবার পর আমাদের খুব মনখারাপ হলো।

হঠাত জ্বরে পড়লে যেমন হয়। কিছু খেতে ভালো লাগে না। কিছু করতে ভালো লাগে না। স্কুলে যাই। বাকি সময়টা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াই। বাসন্তী বেতফল পছন্দ করত। ডেউয়া ফল পছন্দ করত। বাসন্তী নেই। আর তাই বেতফল বা ডেউয়া ফল সংগ্রহেও আমাদের আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা ভুলেও অম্বিকাসার বাড়ি যাই না। মাঝে মাঝে সেনবাড়িতে যাই।
বিশাল বিশাল গাছ!
তুলসীতলা!
শিউলীতলা!
চিলেকোঠা আর চিলেকোঠার ঠাকুর- সবই আছে আগের মতো!
নেই শুধু বাসন্তী!
লোকমুখে শুনেছি, সেনবাড়ির মালিকানা বদল হয়েছে। আজ এত বছর পর আমার মনে হয়, এরকম কত বাসন্তী চলে গেছে ভিটে-মাটি ছেড়ে।
জন্মের ঠিকানা ছেড়ে!
কিন্তু কেন?
এই কেন’র উত্তর আমি জানি না। অপু জিজ্ঞেস করেছিলাম। সেও জানে না।
যারা আমার ডায়েরী পড়ছেন তারা জানেন?
চলবে….
সিনহা মনসুর।