সিনহা আবুল মনসুর : পর্ব: চার
ডায়েরির প্রথম পাতায় অয়ন লিখেছে:
সোমবার
৭ই মে ১৯৮৪।
আজ আমার ক্যানসার-জীবনের প্রথম দিন। না, ভুল বললাম। ক্যানসার তো আমার শরীরে ছিলই। আমি জানতেও পারিনি কবে, কখন, কিভাবে ওই বিষবৃক্ষের বীজ বা জীবাণু আমার শরীরে বপিত হয়েছিল। জানে না কেউই। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আজ ওই ক্যানসার ধরা পড়ল।
বাবা বা মায়ের সাহস হয়নি খবরটা আমাকে জানানোর।
ডাক্তাররাও অনেক লুকোচুরি করলেন। শেষমেশ ভার পড়ল অপুর ওপর। বেচারা অপু!
অপুও একা বলতে সাহস করেনি! আজ সন্ধ্যের পরপর অপু এল শামিমকে সাথে নিয়ে। খবরটা দিয়েই ওরা কান্নায় ভেঙে পড়ল! কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমিও!
ওই একই পাতার নিচে অয়ন আরো লিখেছে:
বসন্তের আকাশে লক্ষকোটি তারা। ওই তারাদের নিচে পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি মানুষ! এই কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বেছে বেছে কেন আমি?
ডযু সব?
আমার কেন ক্যানসার হলো?
আমাকে কেন মরতে হবে?
আমি তো মরতে চাইনি!
জানি, নক্ষত্রেরও ঝরে যেতে হয় একদিন! মরে যেতে হয় এই পৃথিবীর সব মানুষকে।
কিন্তু এ যে বড় অসময়!
বড় অসময়! এই অসময়ে আমি তো যেতে চাই না!
আমি প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে উঠতে চাই। ক্লাসে যেতে চাই। অ্যাসাইনমেন্ট করতে চাই। সকালে নাস্তার শেষে গরম চায়ের সাথে একটা সিগারেট খেতে চাই।
আমি নদীর সাথে অফুরন্ত গল্প করতে চাই।

ওকে প্রতিদিন বলতে চাই, নদী-আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
বহুদিন আগে তারাশঙ্করের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। উপন্যাসটির নাম ‘কবি’। ওই উপন্যাসের নায়কের মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়:
‘এই খেদ মোর মনে
ভালোবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে’?
এইটুকু পড়েই আমি ডায়েরি পড়া বন্ধ করলাম।
অবচেতনে চলে গেলাম সেই রাতে, যে রাতে অয়নকে আমি ও শামিম ওর ক্যানসারের খবরটা দিয়েছিলাম। পিজি হাসপাতালের এগারোতলায় অয়নকে খবরটা জানিয়ে শামিম আর আমি যখন রাস্তায় নেমে এলাম, তখন রাত প্রায় দশটা। শামিমের বাসা এলিফ্যান্ট রোডে। আমার বাসা মগবাজারে। আমি রিকশা নিলাম মগবাজার যাব বলে। শামিমও উঠে পড়ল আমার রিকশায়।
শামিম বললো, ‘অপু, মনটা ভীষণ খারাপ। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। চল তোর বাসায় যাই।’
আমি বললাম, ‘চল।’
রিকশা এগিয়ে চলল।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে এসে রিকশা ডানে মোড় নিল। কিছুদূর চলার পর ঢুকে পড়ল মিন্টু রোডে। এই এলাকায় গাড়ি-ঘোড়া কম। কোলাহলও নেই। রাস্তার দুপাশে বিশাল বিশাল সব গাছ। দেবদারু আর পাইন। ওই সব গাছের পাতায় হাওয়া ঝিরঝির করছে।
আমি মনে মনে ভাবছিলাম অয়নের কথা, ওর ভাগ্যের কথা।
বাতাসের ঝিরঝির শব্দগুলো ছাপিয়েই আমি শামিমকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শামিম, তুই কি ভাগ্য, নিয়তি অথবা ডেসটিনি- এগুলো বিশ্বাস করিস?’
শামিম বলল, ‘অপু, আমি ধর্ম মানি। নিয়তিতে বিশ্বাস করি। পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘আমি তোমাদের নিয়তিকে তোমাদের গ্রীবালগ্ন করিয়াছি’!
আমি বলি, ‘তার মানে আমাদের নিয়তি কি পূর্বনির্ধারিত?
যদি পূর্বনির্ধারিত হয়, তাহলে ভালো বা মন্দের জন্য আমরা দায়ী হব কেন?’
শামিম বলল, ‘অপু, এই বিষয়টা খুবই জটিল। এর সরাসরি কোনো উত্তর নেই। এই বিষয়ে অনেকে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন; কিন্তু কোনোটাই পরম নয়, সবই আপেক্ষিক। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথমেটিকসের একজন প্রফেসর আছেন। তিনিও এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাখ্যাটি খুবই কঠিন।

তারপরও তোকে বলি ব্যাপারটা:
অঙ্কবিদ্যায় ফাংশন বলে একটা কথা আছে। ফাংশন হচ্ছে দুই বা দুইয়ের বেশি ভ্যারিয়েবলসের মধ্যে সম্পর্ক। ভ্যারিয়েবলস আবার দুই ধরনের। প্রাথমিক ভ্যারিয়েবলটা হচ্ছে ইনডিপেনডেন্ট বা স্বাধীন। অন্য ভ্যারিয়েবলসগুলো ডিপেনডেন্ট বা পরাধীন।
ধর ‘ক’ হচ্ছে একটা ইনডিপেনডেন্ট বা স্বাধীন ভ্যারিয়েবল। আর ‘খ’ হচ্ছে একটা ডিপেনডেন্ট বা পরাধীন ভ্যারিয়েবল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যদি ‘ক’-কে একটা মান দিই, তাহলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ‘খ’-এর মানটাও নির্ধারিত হয়ে পড়ে’!
আমি বলি, ‘শামিম, তোর কথাটা হয়তো সত্যি। দৃশ্যমান এই জগতের বাইরেও আরো একটা জগত আছে। ওই জগত্টা জটিল! ওই জগতের অনেক কিছুই আমরা চিনি না, জানি না, হয়তো-বা বুঝিও না। আমাদের বোঝার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি!
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই।
মানুষ তো সৃষ্টির সেরা জীব। পিঁপড়াও উন্নত একটি প্রাণী। কিন্তু ভেবে দেখ, পিঁপড়ার ভাষা আমরা বুঝি না। কাজেই অতি সহজেই সৃষ্টির রহস্য বা সৃষ্টিকর্তার রহস্য বুঝে ফেলব তা তো হয় না!
কোরআন শরিফের সুরা আল বাকারায় একটি ঘটনার উলে¬খ আছে। ওখানে বলা হয়েছে:
মানব প্রজাতি সৃষ্টির আগে সৃষ্টিকর্তা ফেরেশতাদের ডেকে বলেছিলেন:
আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি।
ফেরেশতারা বলেছিলেন, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে স্থাপন করবেন, যারা অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে?
উত্তরে সৃষ্টিকর্তা বলেছিলেন:
‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’!
কি জানিস শামিম, আমরা ঘোড়ার গাড়ির যুগ থেকে ঢুকে গেছি রকেটের যুগে। ছুটে বেড়াচ্ছি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। চলে যাচ্ছি সাগরের গভীর থেকে আরো গভীরে। পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে তার কেন্দ্রের দিকে।
কত নতুন নতুন জগত!
কত নতুন নতুন সম্ভাবনা!
কিন্তু তার পরও যুগে যুগে আমরা হেরে গেছি রোগ-শোকের কাছে!দেখেছিস, মানুষ হিসেবে আমরা কত অসহায়!
কত সীমাবদ্ধ!
সীমাবদ্ধতা আর যন্ত্রণার ওই সব নাজুক মুহূর্তে আমরা কিন্তু ওই সৃষ্টিকর্তার কাছেই আশ্রয় খুঁজি।
নিরাময় কামনা করি।
মনে মনে মেনে নিই তার অমোঘ বাণী:
‘আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না’!
চলবে……..
সিনহা মনসুর।
পুনশ্চ: লেখাটি ভাল লাগলে অনুগ্রহ করে শেয়ার করুন। ধন্যবাদ।