সিনহা আবুল মনসুর : (পূর্ব প্রকাশের পর)
ওই স্বপ্নের ঠিক সাত বছর পর একদিন অমিত কাকুর চিঠি পেলাম। কাকু লিখেছে:
‘অয়ন,
তুই কেমন আছিস?
তুই নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছিস। আমি নিজ হাতে তিনটি রাবার-বাগান করেছি। অপু, শামিম আর তুই মিলে দেখে যা। কবে আসতে চাস লিখে জানা। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো’!
কাকুর চিঠি পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগল। আমি আর শামিম তখন বুয়েটে ভর্তি হয়েছি। আর অপু মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। আমাদের ক্লাস শুরু হয়নি। সাথে সাথেই চিঠি লিখে জানালাম আমাদের যাবার দিন।
এক সকালে অপু, শামিম আর আমি অমিত কাকুর গাড়িতেই রওনা দিলাম রামু। কাকা আসেননি। ড্রাইভার পাঠিয়েছেন। ড্রাইভারই আমাদের নিয়ে যাবে। আমরা রামু পৌঁছালাম সন্ধের পর।
বিশাল বাংলো!
বাংলোর সামনে গোলাপ, রজনীগন্ধা আর হাসনাহেনার বাগান!
বাংলোর গাড়িবারান্দার ওপর বাহারি বোগেনভিলিয়া!
কাকু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন গাড়িবারান্দায়। কাকু আগের মতোই আছেন।
ঠিক যেন দেবরাজ জিউস!
অমিত কাকু আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।
তারপর কেঁদে ফেললেন!
কাঁদলাম আমরাও!
বাংলোয় ঢুকে গোসল সেরে রাতের খাবার খেলাম চারজন মিলে।
খাবারের পর কাকা বললেন, ‘আজ তোরা ক্লান্ত, ঘুমিয়ে পড়। সকালে নাস্তার পর তোদের নিয়ে ঘুরতে যাব।’
অপু, শামিম আর আমি ঘুমুতে গেলাম।
গভীর রাতে আমার ঘুম ভাঙল। ঝুমঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে ওই বৃষ্টির একটানা শব্দ। আমার বাম পাশেই খোলা জানালা। ওই জানালা দিয়ে আসছে হাসনাহেনার মৌ মৌ গন্ধ। আমার ডান পাশে অপু। গভীর ঘুমে মগ্ন। আমি শুয়ে শুয়েই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। গাড়িবারান্দায় বাতি জ্বলছে। ওই আলোর কিছুটা এসে পড়েছে জানালায়। তৈরি হয়েছে আলো-আঁধারি। ওই আলো-আঁধারির দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই ভাবছিলাম অমিত কাকুর কথা!ভাবছিলাম নূপুর খালার কথা!
নূপুর খালাকে আমি খুবই ভালোবাসি। যেমন ভালোবাসি অমিত কাকুকেও!
এই দুজন মানুষ এক ছাদের নিচে থাকলে পৃথিবীর কী এমন ক্ষতি হতো? মানলাম, অমিত কাকুর চালচুলো কিছুই ছিল না।
কিন্তু অমিত কাকুর মতো এই রকম স্বচ্ছ মানুষ কয়জন আছেন এই সংসারে?
তাহলে কি অর্থই সব?
মানুষ কোনো কিছুই না?
শুদ্ধতা, স্বচ্ছতা কি কিছুই না?
খালার ওপর আমার খুব রাগ হলো। খুব অভিমান হলো। অভিমানে মনটা ভারী হয়ে গেল। বাইরের বৃষ্টির মতো মনের ভেতরও চলল অবিরাম বৃষ্টির পতন!
আচ্ছা, আমাদের জীবনটা এমন কেন?
মনে মনে বললাম, ‘যে জীবন দোয়েলের, যে জীবন ফড়িংয়ের মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা’!
সকালে অমিত কাকুর সাথে দেখা হলো ডাইনিং টেবিলে। বাবুর্চি রাজ্যের সব খাবার সাজিয়েছে টেবিলে। অমিত কাকু আমাদের বললেন, ‘কাল রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। ঠান্ডাও পড়েছে। তোমাদের নিশ্চয়ই খুব ভালো ঘুম হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘অমিত কাকু, রাতে আমার ঘুম হয়নি’!
কাকু বললেন, ‘কেন বল তো?’
আমি বললাম, ‘তার আগে তুমি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও’!
কাকু অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী রে, কোন কারণে মন খারাপ হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, খুব মন খারাপ হয়েছে।’
আমার কথায় অমিত কাকু, অপু আর শামিম খুব অবাক হলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা অমিত কাকু, তোমার কয়টা বাড়ি?’
কাকু বললেন, ‘হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?’
আমি বললাম, ‘আহা, যা যা জিজ্ঞেস করি, বলোই না।’
কাকু বললেন, ‘তিনটা।’
‘ক’টা গাড়ি?’
‘দুটো।’
‘ক’টা বাগান?’
‘তিনটে।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু তোমার ঘর একেবারেই ফাঁকা। আমাদের একটা কাকি দরকার। তোমারও একটা সংসার দরকার’!
কাকা বললেন, ‘অয়ন, আমার ঘর ফাঁকা নেই। আমার ঘরে আমি একা নই। আছে অনেকে। তোরা খেয়ে নে। তারপর চল আমার সাথে। আমার সংসার দেখাব’!
নাস্তার পরপরই আমরা বেরিয়ে পড়লাম অমিত কাকুর সঙ্গে। জিপে আমরা চারজন। জিপ বাংলো ছেড়ে নেমে এল জনপদে। জনপদের লোকজন অমিত কাকুকে দেখে হাত নাড়াচ্ছে। হাত নাড়াচ্ছে আমাদেরও। তার মানে অমিত কাকুকে ওরা খুবই ভালোবাসে। পনেরো-বিশ মিনিট ড্রাইভ করে কাকু থামলেন একটা বৌদ্ধমন্দিরের কাছে। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম।
অমিত কাকু বললেন, ‘অয়ন, এই জায়গাটা আগে জঙ্গল ছিল। জঙ্গল কেটে কেটে এই মন্দিরটি আমি বানিয়েছি দুবছর আগে।’
মন্দিরের পাশেই বিশাল মাঠ। মাঠের ওপারে একটি স্কুল। মাঠে খেলা করছে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা।
আমি বললাম, ‘অমিত কাকু, এই মাঠ, এই স্কুল, স্কুলের পাশে ওই লাইব্রেরি- এগুলো সব তোমার তৈরি?’
অমিত কাকু বললেন, ‘জানিস অয়ন, ওই মন্দিরটা আমার ঘর। ওই স্কুল, মাঠ আর লাইব্রেরি আমার সংসার।’
অমিত কাকুর কথা শুনে আমার চোখে জল এল। জল এল অপু আর শামিমের চোখেও।
কাল রাতে অভিমানে বলেছিলাম, আমাদের জীবনটা এমন কেন?
এখন বলতে ইচ্ছে করছে, জীবনটা তো এমনই হওয়া উচিত!
অমিত কাকু আর আমি ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে। অপু আর শামিম গেল খেলার মাঠ আর স্কুলের দিকে। আমরা যখন মন্দির থেকে বের হয়ে স্কুলমাঠে এলাম, ততক্ষণে অপু আর শামিমের সাথে ভাব হয়ে গেছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের। ভাব হলো আমারও। কী সহজ আর কী সরল ওদের কথাবার্তা! কী নির্মল ওদের চিন্তাভাবনা!
আমরা সবাই মিলে এলাম লাইব্রেরিতে। ওখানে রাজ্যের সব বই। সত্যজিৎ রায়, বিভূতিভুষণ, সৈয়দ ওয়ালীউল¬লাহ থেকে শুরু করে সুকান্ত, নজরুল আর রবীন্দ্রনাথ সবই আছে। এক পাশে থরে থরে সাজানো ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। আরো দেখলাম ‘কিশোর বাংলা’ আর ‘টিন টিন’। অমিত কাকা কার্পণ্য করেননি!
কোমলমতি ওই সব শিশু-কিশোরের হাতে মেঘ না চাইতেই জল তুলে দিয়েছেন!
আমি মনে মনে বললাম, অমিত কাকু, তুমি বড় বেশি ভালো!
দুপুরের পরপরই আমরা স্কুল ছেড়ে পথে নামলাম। পথ মানে পাকা রাস্তা নয়, ইট বিছানো রাস্তা।
গাড়ি রাস্তায় ওঠার পরপরই কাকা বললেন, ‘ইতিহাসবিদদের রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তকে আমাদের এই রামুকে ‘প্যানওয়া’ বা হলদে ফুলের দেশ হিসেবে বলা হয়েছে। রামু এলাকাটি একসময় আরাকান রাজ্যের একটি প্রাদেশিক রাজধানী ছিল। তৃতীয় ধন্যাবতী যুগের প্রথম রাখাইনরাজ চেন্দা থুরিয়ার শাসনামলে তাঁর আমন্ত্রণে সেবক আনন্দকে নিয়ে গৌতম বুদ্ধ আরাকানে এসেছিলেন বলে জনশ্রতি আছে। গৌতম বুদ্ধের সাথে ছিলেন তার পাঁচশত শিষ্য!
প্রথম রাখাইনরাজ চেন্দা থুরিয়ার শাসন আমলের সময়টা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০-৫২৮ সালে। আরাকানে এক ধর্ম সম্মেলনে সেবক আনন্দকে উদ্দেশ করে গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন:
‘হে আনন্দ, ভবিষ্যতে পশ্চিম সমুদ্রের পূর্ব উপক‚লে পাহাড়ের ওপর আমার বক্ষাস্থি স্থাপিত হবে। তখন এর নাম হবে ‘রাং-উ’!
রাং-উ রাখাইন শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ বক্ষাস্থি। রাং-এর অর্থ বক্ষ, উ-এর অর্থ অস্থি’।
আঁকাবাঁকা পথে মাইল চারেক ড্রাইভ করার পর কাকু গাড়ি পার্ক করলেন উঁচু একটা পাহাড়ের পাদদেশে। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম।
অমিত কাকু বললেন, ‘অয়ন, এই জায়গাটার নাম রাজারকুল। আর পাহাড়ের ওপর ওই যে মন্দিরটা দেখছিস, ওর নাম রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার।
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৮ সালে সম্রাট অশোক এটি নির্মাণ করেন।
জানিস অয়ন, সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে ভীষণ বদমেজাজি ও একরোখা ছিলেন। তার ক্রূর স্বভাবের জন্য সবাই তাকে ‘চণ্ডাল অশোক’ নাম দিয়েছিল। কলিঙ্গের যুদ্ধই ছিল তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।অশোকের ত্রয়োদশ শিলালিপিতে বলা আছে যে কলিঙ্গের যুদ্ধে দেড় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। বিপুল এই মৃত্যু কলিঙ্গের আকাশ ও বাতাসকে ভারী করে তোলে। চারদিকে মৃত ব্যক্তির স্বজনদের কান্না, অপরিসীম কষ্ট আর হাহাকার। এই কান্না, এই কষ্ট আর এই হাহাকার ছুঁয়েছিল চণ্ডাল অশোক-এর কঠিন হৃদয়! দুঃখে ও অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন অশোক!ফেলে দিলেন যুদ্ধের অস্ত্র!
বরণ করে নিলেন শান্তির ধর্ম!অহিংসার ধর্ম!
হয়ে গেলেন বৌদ্ধধর্মের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক!
অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় শুধু মৌর্য সাম্রাজ্য নয়, এশিয়ার বিভিন্ন রাজ্যেও বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে, সম্রাট অশোকের পুত্র মহিন্দ ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছেন’!
পাহাড়ের চূডায় রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার প্রবেশপথের দুধারে সারি সারি ঝাউবীথি আর সাজানো-গুছানো বাগান। দেখে আমাদের মন পুলকিত হলো। বৌদ্ধ বিহারের ভেতরে দেখলাম দুটি বড় বুদ্ধমূর্তি। একটি মূর্র্তির ভেতরে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বক্ষাস্থি। মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট অশোক কর্তৃক স্থাপিত ৮৪ হাজার ধাতু চৈত্যের মধ্যে রামুর এ চৈত্যটি অন্যতম। আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল!
মনে মনে বললাম, ধন্য হলুম, ধন্য হলুম!
হতবিহভল ভাব নিয়ে আমরা নামতে শুরু করলাম পাহাড়চূডা থেকে।নামতে নামতেই অমিত কাকু বললেন, ‘অয়ন, ওই পাশের পাহাড়ের চূডাটা দেখ। এটাকে বলে রামকোট তীর্থধাম। কথিত আছে, রাম-সীতা বনবাসকালে এই রামকোটে অবস্থান করেছিলেন’!
১৯১৯ সালে শ্রীলংকা থেকে আসা পুরোহিত জগৎ জ্যোতি মহাস্থবির রামকোট বৌদ্ধ বিহারটি সংস্কার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এখানে একটি বনাশ্রম আছে। প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী, পূজারি ও পর্যটক এখানে ভিড় করেন। আশ্রমের পাদদেশে আছে ‘জগৎ জ্যোতি শিশুসদন’। এটি একটি বৌদ্ধ অনাথ আশ্রম’।
আমাদের গাড়ি আবারও পথে নেমেছে। সূর্যের তেজ কমেছে। চারদিকে একটা হলদেটে ভাব। অমিত কাকু বললেন, ‘জানিস অয়ন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই রামকোটে বসেই ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন।হলদে ফুলের দেশ এই রামুকে কবিগুরুই প্রথম রম্যভূমি হিসেবে আখ্যা দেন’!
আমরা বাংলোয় ফিরলাম বিকেল সাড়ে চারটায়। বাবুর্চি টেবিলে খাবার দিল। সরষে-ইলিশ, চান্দা মাছ ভাজা, চিংড়ি ভুনা আর বনমোরগের মাংস! সাথে সবজি ও ডাল। ভাত এবং খিচুড়ি দুটোই আছে। বাবুর্চির রান্না অমৃতের মতো!
খেতে খেতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘অমিত কাকু, আমরা বাগানে যাব কখন?’
কাকু বললেন, ‘অয়ন, আজ পূর্ণিমার রাত। বাগান আজ রহস্যময় হয়ে উঠবে। রাতেই বাগানে যাব’!
সন্ধের পর আমরা চা খেতে বসলাম বাংলোর সামনে। আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। বাতাসে ফুলের মৌ মৌ গন্ধ।
শামিম বলল, ‘অমিত কাকু, তোমার স্কুলের প্রকল্পটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।’
কাকু বললেন, ‘শামিম, আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এখানে একটি অত্যাধুনিক স্কুল কমপ্লেক্স গড়ে তুলব।’
শামিম বলল, ‘কাকু, তুমি অনুমতি দিলে আমি আর অয়ন পুরো কমপ্লেক্সের ডিজাইন করব’!
অপু বলল, ‘কাকু, তুমি অনুমতি দিলে আমি একটা স্কুল হেলথ ক্লিনিক করব’!
অমিত কাকু বললেন, ‘আমার অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন? এই প্রকল্প তো শুধু আমার নয়, এটা তোদেরও। তোদের নবীন মনে ভালো যা কিছু আসে, তা-ই করবি’!
এই সব কথা, এই সব পরিকল্পনা তো খুব বেশি দিন আগের নয়। এইতো বছর তিনেক আগের কথা। বছর তিনেকের মধ্যে সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল!
এর নামই কি নিয়তি!
নিয়তির কথা ভাবতে ভাবতেই আমি আনমনা হয়ে গেলাম। আনমনা হয়ে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে, তাকিয়ে রইলাম চাঁদের দিকে!
ওই চাঁদে এক বুড়ি অনবরত চরকা কাটে।
চরকা কাটে!
চাঁদের বুড়ি কেন চরকা কাটে!
সেদিন সেইরাতে বুঝিনি, আজ তিন বছর পরে এই ডায়েরী লিখতে বসে বুঝেছি সবারই কিছু না কিছু কাজ আছে! যেমন অমিত কাকু!
আমরা রাবার-বাগানে ঢুকলাম রাত নয়টায়।চারদিকে সুনসান নীরবতা। গাছের পাতায় বাতাসের ঝিরঝির শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। বাগানের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই আমরা চলে এলাম অনেক দূর।বাগানের প্রায় মাঝামাঝি। চারদিকে সারি সারি রাবারগাছ। দুই সারি গাছের মাঝখানে তিন-চার ফিট ফাঁকা জমি। ওই জমিতে সবুজ ঘাস।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ।ওই চাঁদ থেকে আলো এসে ঠিকরে পড়ছে গাছের পাতায়। গাছের শাখায়। আলো ঠিকরে পড়ছে আমাদের চোখে-মুখেও! গাছের পাতাগুলো চকচক করছে। চকচক করছে আমাদের চোখ ও মুখ। চকচক করছে ঘাসগুলোও।
আমার মনে হলো, আমরা আমাদের চেনা-জানা কোনো জগতে নেই। আমরা চলে এসেছি অজানা, অচেনা অন্য এক ভুবনে।
ওই ভুবনে চাঁদের আলো কথা বলছে রাবারগাছের পাতার সাথে। পাতাগুলো ওই কথাগুলো ফিসফিস করে ভাগাভাগি করছে ঘাসের সাথে। ঘাস ওই কথাগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে। মাঝে আমরা চারজন শুধুই নীরব সাক্ষী!
অপু ও শামিম হাঁটছে একসাথে। ওরা একটু পিছিয়ে। অমিত কাকু আর আমি হাঁটছি পাশাপাশি।
নীরবতা ভঙ্গ করে আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘অমিত কাকু, নূপুর খালার খবর জানো?’
কাকু বললেন, ‘না রে অয়ন, নূপুর কেমন আছে?’
আমি বললাম, ‘কাকু, নূপুর খালা ভালো নেই।আমেরিকার যাওয়ার পরপরই খালা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। বছর চারেক আগে খালার একটা অপারেশন হয়েছে। অমিত কাকু, নূপুর খালা কখনোই মা হতে পারবেন না’!
আমরা হাঁটছিলাম। অমিত কাকু হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে পড়লেন। চাঁদের আলোয় আমি তার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলাম!
পারলাম না।
অমিত কাকু বললেন, ‘কি জানিস অয়ন, প্রকৃতি আমাদের নিয়ে বিচিত্র বিচিত্র খেলা খেলে। আমরা কেউই ওই খেলার বাইরে যেতে পারি না!
তুই, আমি, নূপুর আমরা সবাই ওই খেলার অংশ। প্রকৃতি আমাদের কখনোই সম্পূর্ণতা দেয় না!কোথাও না কোথাও আমাদের অসম্পূর্ণতা থাকবেই!
কিন্তু এর মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। থামলে চলবে না।
কারণ মানুষ হিসেবে মানুষের কাছে আমাদের যে অনেক দায়’!
চাঁদের আলোয় অমিত কাকুর বিষণ্ণ মুখ দেখলাম।ওই বিষণ্ণ মুখেই তিনি তাকালেন তার বাগানের গভীরে!আর ফিসফিস করে বললেন:
‘The woods are lovely, dark, and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep,
And miles to go before I sleep’! চলবে…