অনলাইন ডেস্ক : কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার কাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি থেকে থানাপাড়া মাঠটি ১০ মিনিটের দূরত্ব। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবদি ওই মাঠটি মাতিয়ে রাখে ছেলে-মেয়েরা। কেউ ফুটবল খেলছে কেউ বা ক্রিকেট। কেউ আবার অন্য খেলায় ব্যস্ত, কিংবা দৌড়ঝাঁপে।
খেলায় মতোয়ারা সেই ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সরব উপস্থিতি থাকতো মুর্শিদা খাতুন হ্যাপিরও। কাজী গোলাম মোস্তফা-হাওয়া খাতুন দম্পতির ১১তম সন্তান মুর্শিদা। ছোট্ট বয়স থেকেই দুরন্ত। সংসারের ছোট সন্তান বলে কথা।
সেই ডানপিঠে মেয়েটি যে এক সময় লাল-সবুজ জার্সিতে ক্রিকেট ব্যাট হাতে দেশ ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে মাঠ মাতাবেন তা কে জানতো? কে জানতো যে, ক্রিকেট খেলতো বলে বড় ভাই আর বোনদের হাতে মার খাওয়া মুর্শিদার হাতে এক সময় মার খাবেন প্রতিপক্ষের বোলাররা!
জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের এ বাঁ-হাতি ওপেনারের বয়স ২১ বছর। দুই বছর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর বুঝিয়ে দিয়েছেন আগামীর তারকা হতে যাচ্ছেন তিনি।
এই তো দুদিন আগে ইএসপিএন ক্রিকইনফো ২০ জন নারী ক্রিকেটারের একটি তালিকা তৈরি করেছে, যাদের ধরা হচ্ছে ভবিষ্যতের তারকা। আগামী এক দশক ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করতে পারেন এই নারী ক্রিকেটাররা। সেই তালিকায় বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে স্থান পেয়েছেন মুর্শিদা খাতুন হ্যাপি।
জাতীয় দলের এই উদ্বোধনী ব্যাটারের ক্রিকেটার হওয়ার পথটা মসৃণ ছিল না। মা হাওয়া খাতুন ছাড়া আর কারো উৎসাহ পাননি। বরং বাবা এবং বড় ভাই-বোনদের কড়া শাসনের মধ্য দিয়েই তাকে ক্রিকেটের জন্য সময় বের করতে হয়েছিল।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী শিক্ষার্থী তখন মুর্শিদা। কীভাবে মাঠে খেলাধুলা করেছেন তার গল্প শুনিয়েছেন কুষ্টিয়া থেকে মুঠোফোনে। ‘ছোট্ট সময় থেকেই আমি ছিলাম দুষ্টু-ডানপিঠে। সব খেলাই খেলতাম। তাও ছেলেদের সঙ্গে। ছেলে সেজে, ছেলেদের পোশাক পরে। এমনকি ছেলেদের মতোই ছোট চুল ছিল আমার। স্কুল পালিয়েও খেলেছি। স্কুলব্যাগে লুকিয়ে অন্য পোশাক নিয়ে যেতাম। কোনো দোকানে গিয়ে স্কুল পোশাক খুলে অন্য পোশাক পরে খেলতে নেমে যেতাম। খেলা শেষে আবার স্কুলের ড্রেস পরে বাড়ি ফিরতাম’-বলছিলেন মুর্শিদা খাতুন।
অনেক খেলায় নেশা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটে কেন মজে গেলেন? মুর্শিদা বলেন, ‘আমি টিভিতে ক্রিকেট খেলা খুব দেখতাম। মাঠে বড়রা যখন ক্রিকেট খেলতেন তখন পাশে বসে দেখতাম। বল কুড়িয়ে দিতাম। পুকুরে বল গেলে সবার আগে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে নিয়ে আসতাম। বড়দের খেলা শেষ হলে ছোট ছেলেরা খেলতো। আমি সেই ছেলেদের সঙ্গে খেলতে নেমে যেতাম।’
ছোট সময় ক্রিকেট খেলার জন্য বাবা এবং বড় ভাইদের কাছে ব্যাট-বল চেয়েও পাননি। তাহলে কীভাবে সেগুলো সংগ্রহ করতেন? ‘আমাদের বাড়িতে অনেক নারকেল ও সুপারি গাছ আছে। মা হাঁস ও মুরগি পালতেন। ডিম, সুপারি, নারকেল বিক্রি করে মা আমাকে ব্যাট ও বল কিনে দিতেন। আমার ক্রিকেটার হওয়ার পেছনে মায়ের অবদানই বেশি’-ছোট্ট সময়ের গল্প শোনালেন মুর্শিদা খাতুন।
বড় ভাই কাজী কেরামত আলীর অনুপ্রেরণায় কীভাবে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন মুর্শিদা বললেন সে গল্পও, ‘যখন আমাকে কিছুতেই খেলা থেকে বিরত রাখতে পারছিলেন না কেউ, তখন একদিন ভাই বললেন- তোর যখন এতই খেলার ইচ্ছা, তাহলে বিকেএসপিতে ভর্তি পরীক্ষা দেই। সিদ্ধান্ত নিলাম বিকেএসপিতে ভর্তি হবো। মাকে ইচ্ছার কথা বললাম। ভর্তির বিজ্ঞপ্তির পর ঢাকা যাই। পরীক্ষা দেই এবং ভর্তি হই।’
২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক হয়েছে মুর্শিদা খাতুনের। ইতিমধ্যে ৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ এবং ১০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন এ বাঁ-হাতি ব্যাটার। এ বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলেছিলেন তিনি। ওই ম্যাচেই আলোচিত হয়েছিলেন মুর্শিদা।
এক সময় মা ছাড়া পরিবারের সবার বাধার মুখে ক্রিকেট খেলতে যেতেন যে মুর্শিদা এখন তার খেলা হলে বেশি টেনশনে থাকেন তার পরিবারের সদস্যরাই, ‘এখন তো আমার চেয়ে আমার বাসার সবাই বেশি চিন্তায় থাকেন যখন খেলা থাকে। যে ভাই-বোনদের মার খেয়েছি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে সেই ভাইবোনরাই এখন আমার খেলার বেশি খবর রাখেন।’
মাত্র দুই বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। এই ছোট্ট ক্যারিয়ারে নিজের স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে মুর্শিদা দেখছেন দুই বছর আগের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরকেই। কারণটাও বলেন মুর্শিদা, ‘ওটা ছিল আমার অভিষেকের সফর। তিন ম্যাচ খেলেছিলাম। বেশি রান করতে পারিনি। কারণ, নার্ভাস ছিলাম। যে কারণে আমি পরে বাদও পড়েছিলাম দল থেকে। তবে মাত্র এক বছর পর আবার দলে জায়গা করে নিয়েছি।’
ভাই-বোনদের তালিকায় মুর্শিদা ১১ নম্বরে। কিন্তু ক্রিকেট দলে তিনি নাম্বার ওয়ান। ওপেনার ব্যাটসম্যান। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর সম্ভাবনাময় ২০ তারকার মধ্যে স্থান পেয়ে বেজায় খুশি। এটাকে দেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো খবর উল্লেখ করে হ্যাপি বলেন, ‘যারা এ তালিকাটি করেছেন তারা সবাই কিংবদন্তি। আমাকে এখন আরো পরিশ্রম করতে হবে, ভালো খেলতে হবে। বিশেষজ্ঞ প্যানেল আমাকে নিয়ে প্রত্যাশা করছে, এখন তাদের প্রত্যাশানুযায়ী পারফরম্যান্স করতে হবে। এই প্রাপ্তি যেমন অনুপ্রেরণা, তেমন চ্যালেঞ্জও।’