মনিস রফিক : চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়।
চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।

পাঁচ.
অভিনয় করার সাথে সাথে চার্লি চ্যাপলিন পরিচালনায় আসলেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি হচ্ছে ‘কট ইন এ ক্যাবার’। ১৯১৪ সালের এপ্রিলে ছবিটি মুক্তি পায়। ম্যাবেল নরম্যাল্ড-এর সাথে যৌথভাবে তিনি ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন। সংবাদপত্রে ছবিটির খুবই প্রশংসা করা হয়। সমালোচকরা তাঁর নাম উল্লেখ করে তার পরিচালনা ও অভিনয়ের ভূঁয়সী প্রশংসা করেন। ‘ড্রামাটিক মিরব’ পত্রিকায় লেখা হয়; চার্লির কোনও তুলনা হয় না। তিনি অদ্বিতীয়।
পরের ছবির কাহিনী তিনি নিজেই লিখলেন। পরিচালনার ব্যাপারেও তিনি কারো সাহায্য নিলেন না। দশ মিনিটের ছবির নাম ছিল ‘কট ইন দি রেন’। কিস্টোন স্টুডিও’র কোন ছবিই কখনো আগে ভেবে-চিন্তে তোলা হয়নি, ‘কট ইন দি রেন’ এর ব্যতিক্রম। এ ছবি পরিচালনার পূর্বে চ্যাপলিন তার আনুপূর্বিক একটি পরিকল্পনা স্থির করে নিয়েছিলেন। এ ছবিটিও প্রচুর দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে।

চ্যাপলিন তখন কেবল মাত্র পঁচিশে পা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি চলচ্চিত্র জগতের শ্রেষ্ঠ রঙ্গাভিনেতা হিসেবে দর্শক সমাজে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। গোটা আমেরিকার চলচ্চিত্র দর্শকদের দৃষ্টি তখন তার উপর। কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর নাম অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। কয়েক বছর পূর্বেও যে চ্যাপলিনকে দরিদ্র্যতার মধ্যে জীবন কাটাতে হয়েছে। সেই চ্যাপলিনের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট লাফিয়ে লাফিয়ে ফুলতে শুরু করলো।

১৯২২ সালে হলিউডের চার্লি চ্যাপলিন স্টুডিও’র ছবি। ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত চার্লি চ্যাপলিনের সব চলচ্চিত্র এই স্টুডিও থেকে প্রযোজিত হয়।

অভিনয়, পরিচালনা এবং প্রযোজনায় একশ আটটি চলচ্চিত্রের সাথে চার্লি চ্যাপলিন ওৎপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এর মধ্যে তাঁর অভিনীত বা পরিচালিত বেশকিছু ছবি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে; দ্য ট্র্যাম্প (১৯১৫), দ্য ইমিগ্রান্ট (১৯১৭), এ ডগস লাইফ (১৯১৮), শোল্ডার্স আর্মস (১৯১৮), দ্য কিড (১৯২১), দ্য সার্কাস (১৯২৮), সিটি লাইটস্ (১৯৩১), মডার্ণ টাইমস্ (১৯৩৬), দ্য গ্রেট ডিক্টেটর (১৯৪০), মঁসিয়ে ভের্দু (১৯৪৭), লাইম লাইটস্ (১৯৫২), এ কিং ইন নিউইয়র্ক এবং এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং (১৯৬৭)।

১৯১৫ সালে ‘দ্য ট্র্যাম্প’ বা ভবঘুরে ছবিটি করার পর চার্লির জনপ্রিয়তা প্রচুর বেড়ে যায়। ছবিটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে গণ্য করা হয়। বিষাদময় পরিণতিতে ছবিটি শেষ হয়। এ ছবিটি দেখে দর্শকরা শুধু হাসলেনই না বরং ভবঘুরে চার্লির জন্য প্রাণ থেকে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। ছবিতে দেখা যায় ভবঘুরে চার্লিকে কেউ কিছু খাবার দিয়েছিল। সে সেটি রুমালে বেঁধে নিয়েছিল। খাবারটি খাওয়ার জন্য সে রাস্তার ধারে এসে বসে, কিন্তু খুতঁখুঁতে ভবঘুরে খাওয়ার আগে মনোযোগ সহকারে নখ পরিস্কার করতে থাকে। ভেবেছিল হাত পরিস্কার করে সে খাবারটি খাবে। কিন্তু ইতোমধ্যে আরেক ভবঘুরে সন্তর্পনে খাবারটি রুমাল থেকে খুলে সেখানে একটি ইট বেঁধে রাখে। চার্লি কিছুই বুঝতে পারে না। কিছুক্ষণ পর সেই ভবঘুরে ও তার দলবল এক গোলাবাড়ির মালিকের এক সুন্দরী কন্যার টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেবার জন্য হামলা চালায়। চার্লি মেয়েটি উদ্ধার করে তার বাবার কাছে পৌঁছে দেয়। মেয়েটির বাবা কৃতজ্ঞতাবশত চার্লিকে তার গোলাবাড়িতে একটি চাকরি দেয়। কিছুদিন পর সেই গোলাবাড়িতে ডাকাত পড়লে চার্লি সবাইকে ঘন্টা বাজিয়ে জাগিয়ে দেয় এবং ডাকাতদের তাড়া করে। ডাকাতরা ফিরে যাবার সময় চার্লির পায়ে গুলি করে। এমন এক বিপদে চার্লির ভূমিকার জন্য সে সবার কাছে নায়কে পরিণত হয়। অসুস্থ চার্লিকে মনিব কন্যা সেবাযতœ করতে থাকে। চার্লির মনে হচ্ছিল, মনিব কন্যা তার প্রেমে পড়েছে। সে ভাবতে থাকে মনিব কন্যার সাথে তার বিয়ে হলে তার পরবর্তী জীবনটা স্বাচ্ছন্দে কাটবে। কিন্তু কিছুদিন পর সে আবিস্কার করে এক যুবকের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় চার্লি সিদ্ধান্ত নেয় সে গোলাবাড়ির চাকরি ছেড়ে দিবে। অতঃপর, সেই সিদ্ধান্তে সে আবার রাস্তায় নেমে পড়ে। আবার ভবঘুরের জীবনে চার্লি প্রবেশ করে। শেষ দৃশ্যে চার্লির অভিনয় দর্শকদের হৃদয়কে মোচড় দিয়ে দেয়। চার্লির চাপা কষ্টে দর্শকদের মন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

‘দি কিড’ চলচ্চিত্রে চার্লি চ্যাপলিন এবং জাকি কোগান

১৯১৭ সালে নির্মিত ‘দ্য ইমেগ্রান্ট’ ছবিতে চার্লি স্বাধীনতার জন্য আমেরিকানদের গর্বকে বিদ্রুপ করলেন। উদ্বাস্তুদের প্রতি কর্তৃপক্ষের আচরণকে তিনি পৃথিবীর মানুষদের সামনে তুলে ধরলেন। ছবিতে দেখা যায়, উদ্বাস্তদের প্রত্যেকের গলায় একটি করে নম্বর লাগানো ট্যাগ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তারপর গরু-ছাগলের মত একটি নৌকায় তাদের তুলে দেয়া হয়েছে। গাদাগাদি করে নৌকায় উঠানো এসব উদ্বাস্তদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোনো এক আশ্রয় শিবিরের দিকে। আমেরিকার স্বাধীনতার গর্ব ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র পাশ দিয়ে যখন নৌকাটি যাচ্ছিল তখন উদ্বাস্তু চার্লির বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকা দর্শকদের উদ্বাস্তুদের মনের বেদনা উপলব্ধি করতে অনেকটা সাহায্য করে।

রাস্তা যাদের ঘরবাড়ি, ভিক্ষে করে বা ছোট খাটো চুরি করে যাদের জীবন চলে এমন সব মানুষের জীবন কাহিনী নিয়ে ১৯১৮ সালে চার্লি চ্যাপলিন তৈরি করলেন ‘এ ডগ্স লাইফ’ ছবিটি। একটি কুকুর এবং একটি দরিদ্র মানুষের জীবনের মধ্যে যে পার্থক্য সেটাই ছবিতে উঠে এসেছে। প্রচুর হাসির মধ্যে মানব জীবনের করুণ চিত্র এমনভাবে চার্লি তুলে ধরেছেন যে তা দর্শকদের মনে সারা জীবনের জন্য দাগ কেটে যায়। এ ছবিতে এক কুকুরের সাথে চার্লির বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সে যেখানে যায়, কুকুর ছানাটিকে সঙ্গে রাখে। এক বড় হোটেলে চার্লির খাবার সুযোগ ঘটে যায়। কিন্তু বড় হোটেলে কুকুর নিয়ে যাওয়া নিষেধ থাকায় সে তার ঢোলা প্যান্টের পকেটে তাকে ঢুকিয়ে নেয়। পকেট থেকে আমরা শুধু কুকুরটির লেজ দেখতে পাই। আর একটি দৃশ্যে দেখা যায় একটি দোকানের সিঁড়িতে চার্লি ও তার বন্ধু কুকুরটি বসে আছে। পাশেই একটি বোতলে সামান্য কিছু দুধ পড়ে ছিল। কুকুরটির পক্ষে যেহেতু বোতলের দুধ খাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না, সেজন্য চার্লি তার লেজটি বোতলের মধ্যে ঢুকিয়ে দুধ দিয়ে ভিজিয়ে দেয় আর কুকুরটি সেই ভিজা লেজ চেটে চেটে খেতে থাকে। কুকুরটার এই খাদ্য সংগ্রহ ও খাওয়ার পদ্ধতির সাথে যে দরিদ্র মানুষদের জীবনের কোন পার্থক্য নেই, সেটি উপস্থাপন করায় ছিল এই ছবির মূল উদ্দেশ্য।

‘ডগস লাইফ’ চলচ্চিত্রে চার্লি চ্যাপলিন ও তাঁর প্রিয় কুকুর

১৯১৮ সালেই চার্লি আরেকটি বিখ্যাত ছবি তৈরী করলেন। সেটি হচ্ছে ‘শোল্ডার আর্মস’। এই ছবিতেই প্রথম যুদ্ধ নিয়ে মস্করা করা হয়। আনাড়ি সৈনিক চার্লি যুদ্ধ সম্পর্কে কিছুই জানে না। একটি দৃশ্যে দেখা যায় সে একটা ট্রেঞ্চে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাইরে শত্রæপক্ষের গোলাগুলি চলছে। সেই সময় চার্লি ও একজন সার্জেন্ট নিশ্চিন্তমনে খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাচ্ছে। তারা দু’জন একটি বিয়ারের বোতল শূন্যে তুলে ধরতেই শত্রæ পক্ষের গুলিতে বোতলের মাথাটা খুলে যায়। সাথে সাথে চক চক করে তারা বিয়ার খেতে থাকে। তারপর দেখা যায় শত্রæপক্ষের গুলিতে সে সিগারেট ধরিয়ে নেয়। আবার দেখা যায়, যুদ্ধে কর্ম ক্লান্ত চার্লি ট্রেঞ্চে ফিরে এসে শুয়ে পড়ে। ট্রেঞ্চ তখন জলে ভরে গেছে। ভিজে বালিশটাকে টেনে নিয়ে তাকে আদর করে সে শুয়ে পড়ে। এক সময় সে স্বপ্ন দেখতে থাকে। জলের মধ্যে ডুবে ঘুমিয়ে থাকার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার জন্য সে একটি ভাঙ্গা ফোনোগ্রাফের নল নাকের সাথে লাগিয়ে নেয়। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, জার্মানদের সঙ্গে চার্লি একাই যুদ্ধ করে চলেছে। একটা ছোট গাছ কেটে নিয়ে ডালপাতা দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে নিয়ে পুরোদস্তুর একটা গাছ বনে যায় চার্লি। তারপর বীরদর্পে সে প্রবেশ করে শত্রæর সীমানায়। এদিকে কয়েকজন জার্মান সৈন্য রান্নার কাঠ সংগ্রহের জন্য গাছরূপী চার্লির দিকে এগিয়ে আসে। গাছ ভেবে চার্লির দিকে এক সৈন্য কুড়াল চালাতে থাকে। চার্লির শরীরে তার কুড়ল লাগার আগেই চার্লি তাকে ঘায়েল করে ফেলে। তারপর শুরু হয় গাছরূপী চার্লি ও জার্মান সৈন্যদের ছুটোছুটো। একটা গাছ ছুটে চলেছে উর্ধ্বশ্বাসে, এঁকে বেঁকে বন বাদাড় পেরিয়ে। শত্রæপক্ষের সৈন্য বা দর্শক কেউ বুঝতে পারছে না কোনটা গাছ আর কোনটা মানুষ। প্রচুর হাসিতে দর্শকরা ফেটে পড়ে। বাহিক্যভাবে ছবিটি হাসির মনে হতে পারে। কিন্তু এই হাসির মধ্য দিয়ে চার্লি চ্যাপলিন সভ্য জগতের মানুষদের সৃষ্ট যুদ্ধের ব্যঙ্গ করেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, চার্লি যেভাবে ছবিটিকে উপস্থাপিত করেছেন, তা অনন্য এবং তার আবেদন কালকে অতিক্রম করে যায়।

১৯২১ সালে নির্মিত হল ‘দ্য কিড’ ছবিটি। চার্লি চ্যাপলিনের নাম উচ্চারিত হলে যে কয়েকটি ছবির নাম স্মরণ হয়, এটি তাদের মধ্যে অন্যতম। হাসি ও করুণ রসে ছবিটি দর্শকদের একই সাথে হাঁসায় ও কাঁদায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার বাস্তবচিত্রের এক প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে ছবিটিকে। বিশেষ করে হাজার হাজার অনাথ শিশুদের ভাগ্যে কি ঘটেছিল এবং দারিদ্র্যের কারণে কিভাবে মায়েরা তাদের শিশু সন্তানকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছিল তার একটি প্রামাণ্য দলিল বলা যেতে পারে এই ছবিটিকে। এই ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন এবং শিশু জ্যাকি কুগানের অভিনয় দর্শকদের বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছিল। ছবির শুরুতে দেখা যায় সদ্যোজাত একটি শিশুকে কোলে নিয়ে এক মহিলা হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসছে। মহিলাটির নিজের শিশুকে লালন পালন করার মতা নেই। সে গীর্জার সামনে দাঁড়াতে দেখতে পেল এক ধনী দম্পত্তি একটি লিমুজিন গাড়ি থেকে নামলেন। মহিলাটি হঠাৎ করেই গাড়ির পিছনের সিটে তার বাচ্চাটিকে রেখে গলায় কিছু একটা লিখে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করে। এদিকে সেই লিমুজিন গাড়িটি একদল চোর এসে চুরি করে নিয়ে যায়। চোরের দল কিছুদূর যেতেই আবিস্কার করে শিশুটিকে। তখন তারা শিশুটিকে একটি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চম্পট হয়। এদিকে ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে ভবঘুরে চার্লি যাওয়ার সময় শিশুর কান্না শুনে থেমে পড়ে। সে ডাস্টবিনের মধ্য থেকে শিশুটিকে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। তারপর পুত্র স্নেহে মানুষ করতে থাকে শিশুটিকে। ধীরে ধীরে শিশুটি হয়ে যায় তার একমাত্র পরম সঙ্গী। শিশুটির বয়স পাঁচ বছর হয়। বিভিন্ন ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে গল্পের কাহিনী। এক সময় অসুস্থ জ্যাকিকে ডাক্তার চিকিৎসা করতে আসে। ডাক্তারের মনে হল, জ্যাকি চার্লির আসল সন্তান নয়। ফলে সে গোপনে পুলিশকে খবর দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অনাথ আশ্রমের গাড়ি নিয়ে পুলিশ হাজির হয়। জ্যাকিকে জমা দিতে হবে অনাথ আশ্রমে। চার্লি ও জ্যাকি দুজনেই এই প্রস্তাবে রুখে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ ধরে ধস্তাধস্তি ও টানা হ্যাঁচড়া চলতে থাকে। অবশেষে পুলিশ রাস্তার কুকুরের মত জ্যাকিকে অনাথ আশ্রমের গাড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার প্রিয় জ্যাকিকে এভাবে কেড়ে নিয়ে যাওয়ায় চার্লি মরিয়া হয়ে ওঠে। ছাদের পর ছাদ ডিঙিয়ে সে চলন্ত গাড়ির ওপর লাফিয়ে পড়ে। প্রথমে অ্যাটেনডেন্টকে কাবু করে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। তারপর জ্যাকিকে মুক্ত করে আনে সে। জ্যাকি চার্লির বুকে লেপটে থাকে। দু’জনের চোখে তখন অঝোরে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। জ্যাকি ও চার্লি এরপর এক সরাইখানায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পুরস্কারের লোভে সরাইখানার মালিক জ্যাকিকে চুরি করে নিয়ে যায়। জ্যাকিকে পাগলের মত খুঁজে না পেয়ে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত চার্লি ঘুমিয়ে পড়ে এবং ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখতে থাকে। স্বপ্নের মধ্যে নোংরা বস্তিটা হয়ে যায় এক সুন্দর পরীদের দেশ। পাখাওয়ালা পরীরা সবাই আনন্দে উড়ছে। পরিপূর্ণ শান্তির পরিবেশে জ্যাকি এসে দাঁড়ায় তার পাশে। কিন্তু সেই স্বর্গ রাজ্যেও হঠাৎ করে হানা দেয় শয়তানের দল। ছয় রিলের এই ছবিটি শেষ হয় মধুর সমাপ্তি দিয়ে। জ্যাকি তার মাকে ফিরে পায়। তার মা এখন নামকরা গায়িকা। ইতোমধ্যে প্রচুর অর্থ করে ফেলেছেন সে। নিজ সন্তান পেয়ে মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন। আর চার্লিকে তিনি জ্যাকির বাবা করে নেন।
১৯২১ সালে চ্যাপলিন ইউরোপ ভ্রমণে বের হলেন। লন্ডন এবং প্যারিসে তিনি বিপুল গণসম্বর্ধনা পেলেন। ইউরোপের মানুষ তাকে পরম ভালোবাসায় গ্রহণ করে নিলেন। চার বছর আগে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়ে গেছে। চার্লি চ্যাপলিন সব সময় রাশিয়ার এই বিপ্লবকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। যদিও আমেরিকার মত এক পুঁজিবাদী দেশে অবস্থানের জন্য প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে কিছু বলতে পারেননি। চার্লির ক্রমাগত জনপ্রিয়তা দেখে পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতারা চার্লির ভূমিকা নিয়ে বড় আতংকের মধ্যে ছিলেন। ইংল্যান্ডে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিক হঠাৎ তাঁকে প্রশ্ন করে বসলেন তিনি বলশেভিক কিনা। সেদিন চ্যাপলিন খুবই স্পষ্টভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি একজন শিল্পী এবং মানুষের জীবন নিয়েই আমার কাজ। বলশেভিজম মানব জীবনের একটি নতুন অধ্যায়। কাজেই জীবন প্রেমিক হিসেবে আমি অবশ্যই এতে আগ্রহী। আরেকজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সোভিয়েত রাশিয়ার লেনিন এবং ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ এই দুজনের মধ্যে কে বড়?’ চ্যাপলিন ছোট্ট একটি কথায় সাংবাদিকটির উত্তর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন কাজ করেন আর অন্যজন ভনিতা করেন।’ আসলে জন্মের পর থেকে দারিদ্র্যের নৃশংসতা এবং উঁচুতলার মানুষদের নগ্ন অমানবিকতা এত কাছ থেকে তিনি দেখেছিলেন যে, তিনি সব সময় চাইতেন, পৃথিবীর ধনী ও দরিদ্র মানুষদের মধ্য এত যে বিস্তর প্রভেদ তা ঘুঁচে যাক।

১৯২১ সালে তাঁর জন্মভূমি ইংল্যান্ডে আসার সাত বছর পূর্বেই তাঁর সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক ছিল সাত ডলার। ঐ অর্থেই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ পূর্বের বছরগুলোতে তাকে কঠোর দারিদ্র্যের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। অথচ ১৯২১ সালেই তার সাপ্তাহিক সম্মানীর পরিমাণ দাঁড়ায় দুই হাজার ডলার। কয়েক বছরের মধ্যে হঠাৎ এমন ধনী হয়ে চার্লি নিজ জন্মভূমিতে এসে তাঁর অতীতকে ভুলে গেলেন না। লন্ডনে এসে প্রথমেই তিনি ছুটে গেলেন তাঁর শৈশবের সেই বস্তিতে। সেখানকার মানুষদের সাথে তিনি আপনজনের মত মিশলেন, গরীব, দুঃখী আর ভিখারীদের সাথে ঘুরে ঘুরে কেবল তাঁর শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলেন। যাকে পেলেন অকাতরে সাহায্য করেলেন। আর এক সন্ধ্যায় ছুটে গেলেন ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের সামনের সেন্ট টমাস হাসপাতালে। কয়েক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন হাসপাতালটার সামনে। পাশে দাঁড়ানো এক বন্ধুকে অস্ফুষ্ঠকন্ঠে বললেন, ‘ঐ যে জানালাটা, দেখেছ? হ্যাঁ শেষের দিক থেকে তৃতীয় জানালাটা, ওই যেখানে আলো জ্বলছে, দেখেছ? ওই ঘরটাতেই আমার বাবা মারা যান। আমি তখন খুব ছোট্ট, কিন্তু আজ, সব মনে আছে আমার। সেই মর্মান্তিক রাত্রির কথা বোধহয় কোনও দিনই আমি ভুলতে পারবো না। সারারাত ওই জানালাটার নীচে ফুটপাতের ওপরে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। একে তো হাড় কাঁপানো শীত, তার ওপরে অন্ধকার। বাবা যে কেমন আছেন, আমি জানি না। জানি না, তবু এক অন্ধ অমোঘ ভয়ে আমি আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি। সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাটা রাত সেদিন আমি ডুকরে ডুকরে কেঁদেছিলাম। সকাল হলে যখন আমি নার্সের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বাবার সংবাদ। তিনি শুধু জানিয়েছিলেন, মাঝরাতেই বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’ (চলবে)