অনলাইন ডেস্ক : জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর দায়িত্ব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ইতিহাসের বইয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি জার্মানির প্রভাব ও ভাবমূর্তি বাড়িয়েছেন। বিশ্বের নারীদের জন্য একজন রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন।

সেই মার্কেল গত ৮ ডিসেম্বর চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। নতুন চ্যান্সেলর হয়েছেন এসপিডি দলের ওলাফ শলত্স। যিনি মার্কেলের জোট সরকারের ভাইস চ্যান্সেলর ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন।

চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নেওয়ার মাধ্যমে মার্কেল তার ৩১ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ইতি টেনেছেন। এর মাধ্যমে এক স্বর্ণ যুগের অবসান হয়েছে। গত ১৬ বছরে তিনি ইউরোপ ও বিশ্বমঞ্চে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। যে কারণে ইউরোপ তথা বিশ্ব তার অভাব বোধ করবে।

মার্কেল পূর্ব জার্মানিতে বেড়ে উঠেছিলেন। ইউরোপে ‘লোহার পর্দা’ এর পতনের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু। দুই জার্মানি একত্রীকরণের পর ১৯৯০ সালে তার রাজনৈতিক গুরু সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল তাকে নারী ও যুব বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। জার্মান গণমাধ্যমে তাকে ‘কোল গার্ল’ বলে সম্বোধন করতে থাকে। কিন্তু দ্রুত সময়ের মধ্যেই কোল এর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ২০০০ সালে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ) এর নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে অল্প ব্যবধানে তার দল জয়ী হয় এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে জোট করে কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্বে আসেন।

চ্যান্সেলর থাকা অবস্হায় তিনি ৪ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ৪ জন ফরাসি প্রেসিডেন্ট, ৫ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ৮ জন ইতালি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি চ্যান্সেলর থাকাবস্হায় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ইউরোপের ঋণ ও শরণার্থী সংকট, সর্বশেষ করোনা মহামারির মতো সংকট বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে মোকাবিলা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের পরিচালক ডেভিড উইলপ বলেন, তিনি যে জার্মানিকে অনেক ধরনের কোমল ক্ষমতা দিয়েছেন সেটা অস্বীকার করা যাবে না। নিঃসন্দেহে তিনি বিশ্বে জার্মানির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ২০০৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকেই তাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিশ্বে জার্মানির ভাবমূর্তির সঙ্গে তার মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বেড়েছে।

ডেভিড উইলপ-এর মতে, রাশিয়া ক্রিমিয়াকে তাদের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তাতে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছিলেন মার্কেল। পশ্চিমাদের পক্ষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সংলাপ করতে তিনিই সক্ষম বলে বিবেচনা করা হতো। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক সহজ ছিল না। ট্রাম্পের অনেক নীতির বিরুদ্ধে তিনি শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিলেন।

সম্প্রতি লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী হাভিয়ের বেটেল বলেন, মার্কেল ছিলেন ‘কম্প্রোমাইজ মেশিন’। যখন কোনো আলোচনা আটকে যেত, তখন মার্কেল কোনো না কোনো উপায় বের করতেন। তার সর্বশেষ ইইউ সম্মেলনে ইউরোপিয়ান কাউন্সিল প্রেসিডেন্ট চার্লস মাইকেল মার্কেলকে বলেন, আপনি একটি স্তম্ভ। আপনাকে ছাড়া এই সম্মেলনকে মনে হবে ভ্যাটিক্যান ছাড়া রোম বা আইফেল টাওয়ার ছাড়া প্যারিসের মতো। মার্কেলের জন্য এই প্রশংসা খুবই অকৃত্রিম। তার সময়ে ইইউ’তে বিভক্তি থাকলেও জার্মানির স্বার্থ রক্ষা করে জোটকে এগিয়ে নিতে তিনি সব সময় সচেষ্ট ছিলেন।

ক্ষমতা ছাড়ার আগে এক বক্তৃতায় মার্কেল বলেন, অনেক সংকটের অভিন্ন সমাধান খুঁজতে আমরা সফল হয়েছি। কিন্তু এখনো আমাদের অনেক অমীমাংসিত সমস্যা রয়েছে। আমার উত্তরসূরির জন্য সেগুলোর সমাধান বড় দায়িত্ব হবে।

২০১৮ সালে মার্কেল ঘোষণা করেন যে, তিনি পঞ্চমবারের মতো চ্যান্সেলর হতে লড়বেন না। ওলাফ শলত্স নতুন চ্যান্সেলর হলেও এবারের নির্বাচনের প্রধান তিন প্রার্থীর চেয়ে জনপ্রিয়তায় তিনিই এগিয়ে ছিলেন। তিনি তার সাত পূর্বসূরি চ্যান্সেলর মতো নয়, বরং নিজের ইচ্ছায় কার্যালয় ছেড়েছেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে মার্কেল ‘গ্লামারাস’ ছিলেন না কখনোই। তবে তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার এটিও অন্যতম কারণ ছিল। গত ১০ বছরে বেশিবারই তিনি মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের বিশ্বসেরা ক্ষমতাধর নারী হয়েছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের মতে, মার্কেল একজন মানবিক নেতা, একজন নারী হলেও নেতৃত্ব দিতে তিনি কখনো ভয় পাননি।

দায়িত্ব ছেড়েছেন এখন কি করবেন মার্কেল? গত জুলাইতে যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় তাকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, প্রথমে একটা ‘ব্রেক’ নেব এবং কোনো ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করব না। আমার কাজগুলো ‘এখন অন্যজন সামলাবে’ এটা মেনে নিতে হবে। আমার মনে হয়, এটা আমার খুবই ভালো লাগবে।