ফরিদ আহমেদ : হারমান গোরিং ছিলেন গেস্টাপোর প্রতিষ্ঠাতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান গোপন পুলিশের সংগঠন ছিল এটি। এই সংগঠনের মতো দুর্র্ধষ এবং পৈশাচিক সংগঠন মানব ইতিহাসে খুব কমই আছে। অত্যাচার করা লাগতো না, গেস্টাপোর নাম শুনলেই বহু লোকের পিলে চমকে যেত। এর প্রধান হিসাবে গোরিংকেও মানুষ ভয় পেত যমের মতো। কাজেই, এই লোককে প্রতারণা করাতো দূরের কথা, তাঁর ধারে কাছেই ভয়ে কেউ ঘেষতো না। অথচ সেই তিনিই কিনা নিজে নিজে প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন।
গোরিং ছিলেন শিল্পরসিক এবং শিল্পপ্রেমী ব্যক্তি। শুধু তিনি একাই নন, হিটলারের মতো একজন যুদ্ধবাজ রক্তপিপাসু ব্যক্তিও শিল্পপ্রেমী ছিলেন। অনেকেই হয়তো জানেন না, হিটলার নিজেও শিল্পী ছিলেন। যদিও এই পেশায় ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। শিল্পী হিসাবে ব্যর্থ হলেও শিল্পকর্ম সংগ্রহের নেশা বন্ধ হয়নি তাঁর। শিল্পকর্মের একটা বিশাল সংগ্রহশালা ছিল তাঁর। সবাইকে এই সংগ্রহশালা দেখিয়ে আনন্দ পেতেন তিনি। এর বেশিরভাগ শিল্পকর্মই অবশ্য চুরি করা বা লুট করা। খুব কমই ছিল সেখানে যা তিনি পয়সা দিয়ে কিনেছেন।
হারমান গোরিং-এরও একই ধরনের একটা সংগ্রহশালা ছিল। নানা জায়গা থেকে চিত্রকর্ম সংগ্রহ করতেন তিনি। হঠাৎ করেই ডাচ শিল্পী ভারমিরের একটা ছবি নজরে আসে তাঁর। ছবিটার নাম ‘ক্রাইস্ট এন্ড দ্য এডাল্ট্রেস’। ডাচ শিল্পী ভারমিরের মাত্র ৩৫ বা ৩৬টি অথেনটিক চিত্রকর্ম রয়েছে। সেই তালিকায় ‘ক্রাইস্ট উইথ দ্য এডাল্ট্রেস’ নেই। শুধু যে নেই তা নয়, ছবিটাতে ডাচ শিল্পীর আঁকার যে বৈশিষ্ট্য, সেটাও অনুপস্থিত রয়েছে।
এই নকল ছবিটা আসলে এঁকেছিলেন আরেক ডাচ শিল্পী হ্যান ভ্যান মীগারেন। এই ভদ্রলোকের মতো নিখুঁত নকলবাজ শিল্পী খুব কমই ছিলেন। প্রচুর সংখ্যক নকল ছবি এঁকেছেন তিনি তাঁর জীবনে এবং সেগুলোকে বিশাল অংকের টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছেন। ভারমিরকে নকল করে আঁকা এই ছবিটা তিনি বিক্রি করেন এক নাজি ব্যাংকার এবং শিল্প সংগ্রাহক আলেইস মিয়েডলের কাছে প্রায় সাত মিলিয়ন ডলারে। এই ব্যাংকার পরে ছবিটা বিনিময় করেন গোরিং এর সাথে। এই ছবির বিনিময়ে তাঁর নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে ১৩৭ টা চিত্রকর্ম ব্যাংকারকে দেন গোরিং। যেহেতু এটি নকল ছবি, এর যথার্থতা প্রমাণ করা নকলবাজদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে, তাঁরা এই ছবির ইতিহাস বর্ণনাকারী একটা চিঠি গোরিং-কে প্রদান করে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে, এই নকল চিঠির বিষয়বস্তুকেই গোরিং মেনে নেন, এবং ভেবে নেন যে আসলেই তিনি ভারমিরের অজ্ঞাত একটা ছবি কিনেছেন।
ছবিটা নিয়ে দারুণভাবে উচ্ছ¡সিত ছিলেন গোরিং। তাঁর ধারণা ছিল যে, তিনি তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন পেয়ে গিয়েছেন। নিজের বাসার দেয়ালে সগর্বে তিনি ঝুলিয়ে দেন এই নকল ছবিটাকে।
যুদ্ধ শেষে হ্যান ভ্যান মীগারেনের বিচার শুরু হয়। অভিযোগ হচ্ছে ডাচ ন্যাশনাল ট্রেজার চুরি এবং তছনছ করা করা। বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। কোর্টে ভ্যান মীগারেন বলেন যে, তিনি ডাচ ন্যাশনাল ট্রেজার চুরি করেন নি। যে সব ছবি তিনি ভারমিরের ছবি বলে বিক্রি করেছেন নানা জনের কাছে, সেগুলো আসলে সবই তাঁর আঁকা নকল ছবি। গোরিং এর কাছে তিনি যেটা বিক্রি করেছেন, সেটিও মূলত তাঁর নিজেরই আঁকা। তাঁর এই বক্তব্য সত্য কিনা, সেটা যাচাই করার জন্য একটা শেষ সুযোগ তাঁকে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তিনি প্রস্তাব দেন যে, সাংবাদিক এবং কোর্টের নিযুক্ত সাক্ষীদের সামনে তিনি নকল ছবি এঁকে দেখাবেন। এই সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয়। কোর্টের নিযুক্ত সাক্ষীর সামনে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন।ছবি আঁকার আগে বদ্ধ মাতাল হয়ে নেন তিনি, সাথে গাঁজাও ছিল। এরকম অবস্থায় না গেলে নাকি তিনি ছবি আঁকতে পারেন না। ছয় সপ্তাহ ধরে সবার সামনে তিনি আঁকেন ক্রাইস্ট এমং দ্য ডক্টরস ছবিটা। এই নকল ছবিটা এমনই উচ্চমানের ছিল যে, নকল ছবি বিশেষজ্ঞরা একমত হন যে, ভ্যান মীগারেন খুব সম্ভবত মিথ্যা কথা বলছেন না। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আসলে ভারমিরের আঁকা ছবি তিনি চুরি করে গোরিং এর কাছে বিক্রি করেন নি, বরং গোরিং-কে নিজের আঁকা ছবি দিয়ে প্রতারিত করেছেন।
গোরিং এর নিজের বিচার যখন হচ্ছিল নুরেমবার্গে, তখন তাঁকে জানানো হয় যে, তাঁর প্রিয় ভারমিরের ছবিটা আসলে নকল ছবি। কিন্তু, ঘাড় ত্যাড়া গেস্টাপো প্রধান এই তথ্য বিশ্বাস করতে অস্বীকৃতি জানান।
অবশ্য গোরিং-কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বিস্ময়করভাবে এখনও অনেক শিল্পবোদ্ধা ভ্যান মীগারেনের নকল করা ছবিটাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে ভারমিরের আঁকা ছবি বলেই মনে করেন।