মনিস রফিক : বৃদ্ধাবস্থায় মানুষের শারীরিক ক্ষমতা কমতে থাকার সাথে সাথে বিভিন্ন মস্তিষ্কজনিত অসুখ শরীরে জেঁকে বসে। বর্তমানে কানাডায় ষাট বছরের বেশি মানুষের তিন ভাগের দুই ভাগই ‘ডিমেনশিয়া’য় আক্রান্ত। কানাডাসহ সারা পৃথিবীতে এ সংখ্যা দিন দিন আশংকাজনক হারে বেড়ে চলছে। বয়স্ক মানুষের জীবন, তাদের অবস্থান এবং তাদের মস্তিষ্কজনিত বিভিন্ন অসুখ নিয়ে “বাংলা কাগজ” এ লিখছেন মনিস রফিক। সত্য ঘটনার লেখাগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
তিন.
সাত’শ সতেরো শেফার্ড এভিনিউ’র ‘এলেক্স লজ’ এ আমি যেদিন প্রথম গিয়েছিলাম সেদিন ক্যাথরিনকে দেখেছিলাম ঘরের কোনার সোফায় বসে একমনে একটি ছবি দেখছে, ছবিটা সে পরম যত্নে তার হাতের তালুতে রেখে একমনে নিবিষ্ট হয়ে দেখছিল। ব্যাক্তি মালিকানার ‘এলেক্স লজ’ ওল্ড হোমে এ মোট ত্রিশ জন রেসিডেন্ট থাকে। এদের সবার বয়সই সত্তরের ওপরে। এরা প্রায় সবাই আলজেইমার, ডিমেনশিয়া বা বিভিন্ন ধরনের স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগে, তবে এসব অসুখের চেয়ে তারা মূলত ভুগে নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বে। জীবনের শেষ বেলায় এসে এরা সবায় একধরনের শিশু হয়ে যায়।
ক্যাথরিনকে আমার প্রথম থেকেই অন্যান্যদের চেয়ে একটু আলাদা মনে হয়েছিলো। সে চুপ করে একাকী ঘরের এক কোণার এক সোফায় বসে থাকে, এক মনে ছবি দেখে আবার মাঝে মধ্যে চিৎকার করে উঠে। ক্যাথরিন নুডুলস জাতীয় কোনো খাবার খায় না। নুডুলস খেতে গেলেই তার মনে হয় তার দিকে ধেয়ে আসছে কিলবিল করে অগণিত সাপ বা কেঁচো। ক্যাথরিন রাতে কখনো আলো নিভিয়ে ঘুমাতে পারে না। রাতে অন্ধকার দেখলেই সে চিৎকার করে উঠে। আর সে খাটে ঘুমাতে পারে না। খাটে ঘুমাতে গেলে তার মনে হয় কারা যেন তাকে মুখ চেপে, চোখ বেঁধে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
শেফার্ড এভিনিউ’র এই ওল্ড হোমে মাত্র এক মাসের জন্য আমি গিয়েছিলাম। এই হোমে শুধুমাত্র আলজেইমার, ডিমেনশিয়া বা বিভিন্ন ধরনের স্কিজোফ্রেনিয়ায় ভুগা একাকী, নিঃসঙ্গ বেলাশেষের মানুষরা থাকে। তাদেরকে কাছ থেকে দেখা আর এ বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষা নেয়াই ছিল আমার ওই ওল্ড হোমে যাবার মূল কারণ। আমার পড়ার বিষয় এজিং পপুলেশন, যে মানুষদের জীবনের বেলা শেষ হয়ে গেছে, জীবনের আলো যাদের নিভূ নিভূ, সেই মানুষরা আমার পড়ার বিষয়, জানার বিষয়।
ক্যাথরিন অন্ধকার ঘরে খাটে ঘুমায় না, নীচতলার ঘরের কোণার সোফাটায় হচ্ছে তার ঘর-বাড়ি। প্রথম পঁচিশ দিন ক্যাথরিন আমাকে তার কাছে ভিড়তে দেয়নি, আমার সাথে কোনো কথা বলেনি কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি সে আমাকে আড় চোখে দেখেছে বা আমি কাছে গেলে শান্ত হয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে। তবে এটাও লক্ষ্য করেছি, মাঝে মধ্যে ক্যাথরিন কয়েকজনের সাথে অনেক স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।
ক্যাথরিনের মত থরে থরে চেয়ে থাকা শান্ত বিষন্ন মুথগুলো আমি দেখি আর ভাবি আমরা মানুষরা কতবেশি অসহায় হয়ে পড়ি আমাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, বুঝতে পারি এক সময় যৌবন সাম্রাজ্যে এরা সবাই ছিল এক একজন রাজা বা রানি, কিন্তু জীবনের শেষে এসে এরা কত বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে। সভ্যতা এগুচ্ছে, মানুষ তথাকথিত সমৃদ্ধির পথে এগুচ্ছে আর বড় বেশি অসহায় হয়ে পড়চ্ছে। আমি উপলব্ধি করি আমাদের অনেককেই এই ক্যাথরিন, আইলীন, মাকেঞ্জি, রবসন বা মালিশার মত শেষ জীবন কাটাতে হবে, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধুবান্ধব ছাড়া।
ক্যাথরিন যখন কোনো কিছুর দিকে তাকাই তখন মনে হয়, তার চোখ মুখ দিয়ে এক ধরনের বেদনা ঝরে পড়ে। এখানকার অন্য সব রেসিডেন্ট আমার সাথে কথা বললেও শুধু ক্যাথরিন কথা বলতো না। ফলে তার প্রতি আমার আগ্রহ অন্যান্যদের তুলনাই একটু বেশিই হয়েছিল। আমি আমার জ্যামাইকান সুপারভাইজার ডেন্টনেট-এর কাছে ক্যাথরিন সম্পর্কে যেদিন জানতে চেয়েছিলাম, সেদিন সে শুধু বলেছিল, ‘দেখো রফিক, এখানে যাদের দেখছো, এদের সবারই জীবনে এমন কিছু না বলা ঘটনা আছে তা বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু এগুলো অহরহ আমাদের চারপাশে ঘটে। শুধু জেনে রেখ, ক্যাথরিনের জীবনটা সত্যিই অন্যদের চেয়ে আলাদা, অনেক আলাদা।’ ডেন্টনেট আমাকে আরো বলেছিলো, ক্যাথরিন যদি কখনো তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে, কিছু মনে করো না। ডেন্টনেট আমাকে ক্যাথরিনের অতীত জীবনের ফাইলটা দেখতে দেয়েছিলো।
ক্যাথরিনের জন্ম ১৯৪১ সালে ডোমানিকার এক গ্রামে। ছোট বেলায় তার বাবা মারা যায়। তেরো বছর বয়সে তাকে কাজ দেবার নাম করে গ্রাম থেকে শহরে আনা হয়। তারপর তার জীবন এক নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে। সেই শহর থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কিউবায়। সেখানে তাকে পাঁচ বছর যৌনদাসী হিসেবে জীবন কাটাতে হয়। একেবারে বালিকা যৌনদাসী। তারপর ১৯৫৯ সালে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রর বিপ্লবের সময় তার এক বুড়ো খদ্দের তাকে কানাডায় নিয়ে আসে।
ক্যাথরিনের বয়স তখন উনিশ। তার শরীরের গঠন আর সৌন্দর্যে তার দিকে কামাতুর পুরুষরা চেয়ে থাকতো। এই সুযোগে তার সেই বুড়ো খদ্দের যে তাকে কানাডায় নিয়ে আসে সে অনেক অর্থ কামিয়ে ফেলে। প্রায় দশ বছর কানাডার এই অন্ধকার জগতে থাকার পর সেই খদ্দের মারা গেলে ক্যাথরিন নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ইতিমধ্যে তার এ্যাকাউন্টে বেশ অর্থ জমা হয়েছে, সে সুন্দরভাবে বাঁচার আশায় স্কুলে যাওয়া শুরু করে। তারপর একটা অফিসে রিসিপ্সনিষ্ট-এর কাজ পায়।
শুরু হয় ক্যাথরিনের নতুন জীবন। সেই অফিসেই পরিচয় হয় উইলিয়াম-এর সাথে, তারপর বিয়ে। বিয়ের তিন বছরের মধ্যে তাদের একটি সন্তানের জন্ম হয়। ক্যাথরিন ভেবেছিল বিয়ের পর সে সুখী হবে, কিন্তু সুখী হতে পারেনি, অনেক চেষ্টা করেও সে সুখী হতে পারেনি। উইলিয়াম তার অতীত জীবন সম্পর্কে জানতো, আর এটাও জানতো ক্যাথরিনের বেশ অর্থ আছে। ক্যাথরিনের অর্থ উইলিয়ামের দরকার ছিলো। ক্যাথরিন পরিবার পেয়েছিলো, কিন্তু সুখ-আনন্দ পায়নি। উইলিয়াম তাকে অত্যাচার করতো, তাকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কঠিন কঠিন কাজ করাতো, ক্যাথরিন সব সহ্য করতো আর ভাবতো ছেলেটা বড় হলে নিশ্চয় তার কষ্ট দূর হবে।
তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে, উইলিয়াম মারা গেছে, ছেলেটা বড় হয়েছে, ছেলের ছেলেমেয়ে হয়েছে, কিন্তু ক্যাথরিনের সুখ হয়নি। নিজের যে জমানো অর্থ তার সব ছেলেকে দিয়েছে, কিন্তু সে তার মা’র কোনো রকম যতœ নেয়নি, দেখভাল করেনি। সাত বছর আগে একটা ব্যাগ আর ক্যাথরিনকে যখন রাস্তা থেকে তুলে একটা হোমলেস শেল্টার নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সে ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া এক ছোট্ট পাখি। কয়েক মাস পর সেখান থেকে যখন এই ওল্ড হোমে তাকে আনা হয় তখন সে ছিলো একেবারে ভাঙাচুরা এক মানুষ। আর এই সাত বছরে তার ছেলে তাকে একবারও দেখতে আসেনি। ক্যাথরিন তার ছেলেকে নিজের ছেলে বলে ডাকে না, সে হচ্ছে, তার গ্রাণ্ডচিল্ড্রেনদের বাবা।
এলেক্স লজ এ আমার দিন শেষ হয়ে আসছিল। ক্যাথরিনের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়ছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম তার সাথে ভাব জমাতে, তার কাছ থেকে তার জীবনের কথা শুনতে। এর মধ্যে এক রেসিডেন্ট-এর জন্মদিনে আমি কেক এবং অন্যান্য কিছু খাবার নিয়ে গেলাম এবং কিছুটা হৈ চৈ করে সময় কাটালাম। এক সময় আমরা সবাই মিলে ওল্ড হোমের ক্যামেরায় ছবি তুললাম। আমাদের ছবি তুলায় শুধুমাত্র ক্যাথরিন আসলো না। আমি তার কাছে গিয়ে তার ছবি তুলতে চাইলাম, সে না বললো না। আমি তার ছবি তুলে তাকে দেখালাম, কিন্তু সে ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ওটা তার ছবি না। আমি আবার তার ছবি তুললাম কিন্তু সে কিছুতেই বিশ্বাস করলো না যে ওগুলো তার ছবি। সে বলতে লাগলো, সে দেখতে এত বুড়ো আর কুৎসিত নয়। তার কথা বলাটা এক সময় চিৎকারের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। তারপর ডেন্টনেট আমাদের কাছে এসে আমাকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিল।
এই সাত বছরে এই ওল্ড হোমে ক্যাথরিন কখনো আয়নার সামনে যায়নি, প্রথম প্রথম তাকে আয়নার সামনে নিয়ে গেলে সে ভয় পেতো আর চিৎকার করতো। ডেন্টনেট আমাকে বলেছিল, এই দীর্ঘ সময় আয়নায় নিজের চেহারা না দেখার ফলে তার বর্তমান চেহারা সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। তার মনোজগতে এক সময়ের সেই সুন্দরী ক্যাথরিন এখনো বসবাস করে।
এলেক্স লজ এ আমার শেষ দিনের আগের দিন ক্যাথরিন যে সব খাবার খেতে ভালোবাসতো সেগুলো নিয়ে গেলাম। তাকে বললাম, আমার এখানকার দিন শেষ হয়ে এসেছে। আমার কথাটা শোনার সাথে সাথে সে আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। আমি তার দিকে খাবার এগিয়ে দিলাম, সে খাবারগুলো মেঝেয় ছুঁড়ে ফেললো। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। আমি নিজেকে ঠিক রেখে ক্যাথরিনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। আস্তে করে তার হাতটা আমার হাতের মধ্যে রাখলাম।
সে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। কোন শব্দ করলো না। আমি দেখলাম তার চোখ দিয়ে অশ্রæ ঝরছে। তারপর তার স্বভাব বহির্ভূতভাবে সে আমার হাতটা ধরে আমাকে টেনে নিয়ে তার সোফায় বসিয়ে একটানে বলতে লাগলো, ‘আমি তোমার সাথে এতদিন কেনো কথা বলিনি তা জানো? তোমাকে আমার ছেলে হেনরি’র মত দেখায়’, একথা বলেই সে সোফার পাশ থেকে তার ছেলের ছবি দেখালো। বুঝলাম, এই ছবিই সে সব সময় দেখে। ছবির দিকে তাকিয়ে সে বলতে লাগলো, ‘আমি তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, কিন্তু এই ছেলে আমাকে কখনো দেখতে আসে না! তোমাকে দেখলে আমার হেনরি’র কথা মনে পড়ে যায়। তোমার সাথে কথা বলে আমি আর মায়া বাড়াতে চাইনি, মায়া বড় বেশি কষ্ট দেয়!’ এবার সে কিছুটা থামলো, তারপর কিছুটা কড়াভাবে বললো, ‘এখানে তোমার কাজ শেষ হয়ে গেলে আর কখনো এখানে আসবে না। আমি তোমাকে আর কখনো দেখতে চাই না।’ ক্যাথরিন আমাকে কথাগুলো বলেই আমি যেভাবে তার হাত জড়িয়ে নিয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই আমার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
ততক্ষণে ডেন্টনেট আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেদিন ডেন্টনেট শুধু আমাকে বলেছিল, এই সাত বছরে এই প্রথম সে ক্যাথরিনকে কাঁদতে দেখলো।