সাজ্জাদ আলী : জন্মের আগেই তাকে ১,৫৮২ ডলারে কেনা হয়েছে। অরিত্র-শতরূপারা তখন একটি কন্ডোমিনিয়াম এপার্টমেন্টে থাকে। তিন রুমের ফ্লাট ছিল সেটি। ওদের দুই ছেলে কুটুস আর কাটুস দুটো রুম বরাদ্দ পেয়েছে। এখন এই অনাগতের বসবাসের জন্য বাসায় কোনো আলাদা রুম নাই। ছেলেরা অবশ্য দুজনই আগত সেই অতিথির সাথে রুম শেয়ারে বেজায় আগ্রহী। কিন্তু শতরূপার তাতে সায় নাই। ছেলেদের সুরক্ষা নিয়ে সে শঙ্কিত।

তাহলে নতুন অতিথি থাকবে কোথায়? তাকে তো আর বলা যায় না যে ড্রয়িং রুমে সোফার উপরে শুয়ে পড়ো! অগত্যা অরিত্রকে আরেকটি বড় বাড়ি কিনতেই হল। নতুন সেই বাড়িতে অনাগতের জন্য রাজসিক ব্যবস্থা! থাকবার জন্য আলাদা এয়ারকন্ডিশন্ড কক্ষ। সে কক্ষে ফায়ার প্লেস পর্যন্ত আছে। বালিশ তোষক ইত্যাদি সব মজুত। অতিথির জন্য পৃথক ডাইনিং এরিয়া। হাগু-হিসুর জন্যও আলাদা বন্দোবাস্ত আছে। বাড়ির সামনে ও পেছনের চত্তরে ছুটোছুটি করবার বিস্তর জায়গা। জলে ঝাপাঝাপির জন্য ব্যাকইয়ার্ডে বিশাল সুইমিং পুল আছে। নতুন অতিথিকে স্বাগত জানাতে আয়োজনের আর কোনো ত্রæটি রইল না। কখন জন্মাবে সে, কুটুস কাটুসরা সেই অপেক্ষায়!

এই অনাগতের নাম কোকো। বাড়িতে আসবার আগেই তার নাম রাখা হয়েছে। সে ল্যাব্রাডর জাতের কুকুর। পাঠক বন্ধুরা কেউ কেউ হয়ত ওকে কুত্তা-বিলাই গোত্রের ভাবছেন! সবার কাছে করোজোড়ে মিনতি করছি, একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে ব্যপারটা দেখুন প্লিজ। এটা কি সত্য নয় যে এই জগত সংসারে আপনি আমি কোকো সবাই প্রাণী? হয়ত বলবেন, তাই বলে মানুষের সাথে কুকুরের তুলনা? না তা না, তুলনা না। তবে একটু যত্ন-আত্তির মধ্যে বেঁচে থাকার অধিকার সব প্রাণীরই আছে। আর অধিক বুদ্ধি-বিকেরওয়ালা মানুষদের অন্য প্রাণীকুলের উপর সদয় হবার দায়ও অধিক।

টরন্টোর ল্যাব্রাডর পাপিজ সেন্টারে কোকোর জন্ম। ওর বাবার গায়ের রং হলুদ আর চকলেটের মিশেল। আর মায়ের রং সাদাকালো। মা তখন প্রেগনেন্ট। এবারে গোটাপাঁচেক বাচ্চার জন্ম হতে পারে। কুকুরের বাচ্চার দর দাম রং ভেদে উঠা নামা করে। সাদা রংয়ের বাচ্চাই শতরূপার পছন্দ। কিন্তু তার দাম মেলা। কম্পানিকে ওরা বলে রেখেছে হলুদ বা চকলেট রঙের বাচ্চা ওরা কিনবে। কোকোর জন্মের খবর যে দিন এল, সে দিন অরিত্রর খুশি আর ধরে না! ফোন করে গদগদ হয়ে বলে, দাদা অবশেষে কোকো বাড়িতে আসছে।
আমি বললাম, কোকো যেন কে?

এই দেখুন আপিন কোকোর কথা ভুলে বসে আছেন? মাস সাতেক আগে ওর কথা আপনাকে বলেছিলাম। দাদা সেই কোকো, ওই যার কমফোর্টের জন্য এই বাড়িটি কিনলাম।
ওহ তাই বলুন! আমি খুবই লজ্জিত অরিত্রদা, সত্যিই মনে ছিল না। আপনি সেই কুকুরটির কথা বলছেন তো?

দাদা, ওর নাম কোকো! ফোনের মধ্যে আরিত্রর গলাটা বেশ সিরিয়াস শোনাল।
দুই মাস বয়সে কোকো মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়ল। ঠিক তার পরদিনই সে নতুন মা শতরূপার বাড়িতে এসেছিলো। এখন ওর বয়স দুই বছর। কোকো বাবুর নিয়ম বেঁধে খাওয়া দাওয়া। আর যেনতেন খাবার উনার মুখে রোচে না। সকালে সব্জি আর মাংস, দুপুরে মাছ বা মাংস, রাতে শুধুই মাংস। তবে এ সব মাছ, মাংস বা সব্জি মশলাপাতি দিয়ে রাঁধা না। ওগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বড় সাইজের ট্যাবলেটের মতো করে বড়ি বানানো। কোকো তা চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।

চায়ের কাপে চিনি নাড়তে নাড়তে শতরূপা বলে, দাদা কোকোর পেছনে আমার কুটুস কাটুসের থেকে খরচ বেশি। অরিত্র বাড়িতে থাকলে কোকোকে ঘন ঘন খাবার দিতে থাকে। এই বেশি খাওয়ানোর জন্য এ পর্যন্ত পাঁচবার ওর পেটে অসুখ করেছে। একবার তো হাসপাতালে দুই দিন রাখতে হয়েছিলো।

অরিত্র বলে উঠলো, দাদা কোকো তো বেশি দিন বাঁচবে না! বড়জোর ১৪ বছর! মাঝে মধ্যেই ওর জন্য মনটা খুব কাতর হয়ে ওঠে। সে জন্যে একটু খাবার টাবার দেই আর কি! ক’দিনই বা খাবে বলুন!

তাই বলে তুমি কি বেচারাকে খাওয়ায়ে মেরে ফেলবে? নিজে তো মরার ভয়ে ভাতের থালা থেকে মদের গ্লাস অব্দি মাপঝোপ করো, ঝাঁঝালো শোনালো শতরূপার কথাগুলো।
অরিত্ররা মাঝে একবার তিন সপ্তাহের জন্য কলকাতা গিয়েছিলো। কোকো বেচারাকে সাথে নেয়নি। সে তখন হোটেলে ছিলো।

টরন্টোতে কুকুরদের থাকবার হোটেল আছে। সেখানে রাখা বিস্তর খরচ। রুমের সাইজ ভেদে প্রতি রাতের জন্য ৭৫ থেকে ১২৫ ডলার ভাড়া গুণতে হয়। অবশ্য অল ইনক্লুসিভ। থাকা, খাওয়া, গোলস, খেলা, গাইডের সাথে হাঁটতে যাওয়া ইত্যাদি সব ওই টাকার মধ্যেই।
কানাডায় কুকুর বিড়ালদের ভাল মন্দ দেখভাল করার জন্য প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই।
টরন্টোতে এমনই একটি প্রতিষ্ঠানের নাম “হিউম্যান সোসাইটি”। নগরবাসীরা কেউ যদি কোন কারণে তাদের পোষ্য বিড়াল বা কুকুর পালনে অক্ষম হয়ে পড়ে, তবে ওই সব প্রতিষ্ঠানে রেখে আসে। আবার যারা কুকুর দত্তক নিতে চায় তারা সেই সব প্রতিষ্ঠান থেকে বিনা টাকায় কুকুর বিড়াল এনে পোষে। এই ভাবে ওই প্রাণীদের মালিকানা বদল হয়।
সিঙ্গাড়া খেতে খেতে অরিত্রকে জিজ্ঞাসা করলাম, হিউম্যান সোসাইটিতে বিনা পয়সায় কুকুর পাওয়া যায়। সে সব কুকুরও বনেদি গোত্রের। ওখান থেকে না এনে আপনি শতশত ডলার খরচ করে কোকোকে কিনতে গেলেন কেন?

কারণ আছে দাদা। একটা শিশু কুকুর কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে সেটা কিন্তু বড় ফ্যাক্টর। যদি সে রাস্তাঘাটে লাথি-গুতা খেয়ে বড় হয়, তো সে পথের-কুত্তা হয়ে উঠে। আবার সে যদি কোনো মানব পরিবারের সাথে বড় হয় তো সেই পরিবারের ভাল মন্দ সুবিধা অসুবিধাগুলো শিখে নেয়। ওই হিউম্যান সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানের কুকুরগুলোর অনেকবার মালিকানা বদল হয়। আজ এর বাড়ি তো কাল তার বাড়ি! ওরা যে কখন বেপরোয়া হয়ে উঠবে তার কোনো ঠিকঠাক নেই।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন যে কোকো কখনও “কুত্তা মার্কা” আচরণ করে না, জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

ঠিক তাই দাদা। গত দুই বছরে আমরা পছন্দ করি না এমন কোনো কাজ সে করে নি। আসলে কোকো তো অন্য কোন পরিবেশ কখনও দেখেনি। সে আমার ছেলেদের দেখে দেখেই বড় হয়েছে। শুনলে আশ্চর্য হবেন, কুটুস কাটুস যখন পড়ার টেবিলে থাকে, কোকো তখন তা বুঝতে পারে। ওদের কাছে ঘেঁষে না। যখন ওদের পড়া শেষ, কোকোকে তখন আর পায় কে? দৌঁড়ঝাপের আর শেষ থাকে না।

আচ্ছা অরিত্র একটা কথা বলুন তো, এই যে দিন নাই রাত নাই বাড়িতে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে, বিরক্ত লাগে না?

দাদা, বাড়িতে কারো কোনো বিপদের আশঙ্কা না দেখলে সে তো কখনওই ঘেউ ঘেউ করে না! অত্যন্ত নিচু স্বরে গো গো রকমের একটা শব্দ করে। ওটাই তার স্বাভাবিক ভাষা। আরো কী জানেন, কোনো কিছু আব্দার করতে হলে কোকো দৌঁড়ে ওর মা শতরূপার কাছে যায়। তারপর তার ঘাড়ে পিঠে মুখ ঘষে ঘষে মৃদু ঘাওউ ঘাওউ শব্দে আদর কাড়তে থাকে। আর শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় করেই ছাড়ে। কী জানেন, ওর আব্দারের ভাষাও আলাদা।
ইন্টারেস্টিং! ওর দাবিগুলো কী রকম শুনি, জানতে চাইলাম আমি।

এই যেমন ধরুন, ঘর থেকে বাইরে বেরুবার অনুমতি, অবেলায় খেতে চাওয়া, আরো কত সব বায়না আছে তার!

ক’দিন আগে গিয়ে দেখি শতরূপাদের ব্যাকইয়ার্ডের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে একটা স্টপ সাইন পুতেছে। কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম, রাস্তার সাইন বাড়িতে কেন?

শতরূপা হাসে, কথা বলে না। অরিত্র বলল, দাদা ওই স্টপ সাইনটি আমাদের বন্ধু বান্ধবদের জন্য। কেউ যাতে ব্যাকইয়ার্ডের ওই কোণাটায় না যায়। সারাদিনে কোকোর যতবার হাগু-মুতুর চাপ পায়, সে ওই কোণে গিয়ে কর্মটি সারে।

কুকুর তার বাথরুম চেনে! শুনে খুব আশ্চর্য লাগল। অরিত্রকে আরো জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার বাড়ির কাছাকাছি তো ঘন বনজঙ্গল আছে। কোকো যদি কখনও জঙ্গলে গিয়ে হারিয়ে যায় তখন কী হবে?

দাদা, জন্মের পরপরই ওর পিঠে সার্জারি করে একটা মাইক্রো চিপস ঢুকানো হয়েছে। সেই চিপসের মধ্যে ওর নাম ঠিকানা, এমনকি আমার ও শতরূপার পরিচয়ও লেখা আছে। যদি কখনও হারিয়ে যায় তখন কম্পিউটার স্ক্যানার ওর খোঁজ পাবে মুহুর্তেই।

“মানুষেরা কুকুরদের প্রতি আরো সদয় হোক”, কৌশলে এমন একটা ক্যাম্পেইনের চেষ্টা আছে আমাদের অরিত্রর। ব্যক্তিগতভাবে আমিও এই মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না। কিন্তু যখন দেখি সহস্র-কোটি মানব শিশু কোকোর থেকে ভাগ্যহীন, মনটা তখন ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)