ফরিদ আহমেদ : বাঙালি নারীদের মধ্যে প্রথম যিনি বিদেশে যান, তাঁর নাম হচ্ছে কৃষ্ণভাবিনী দাস। তাঁর জন্ম মুর্শিদাবাদে, ১৮৬৪ সালে। উনিশ শতকের শেষ অংশে তিনি তাঁর স্বামী দেবেন্দ্রনাথ দাসের সাথে ইংল্যান্ডে যান। দেবেন্দ্রনাথ শুধু যে তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যান, তা নয়। তিনি তাঁর স্ত্রীকে সুশিক্ষিতও করে তোলেন। বিদেশ থাকা অবস্থায় এবং বিদেশ থেকে ফিরে এসে লেখালেখিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। মূলত নারী শিক্ষা, নারী ভাবনা এবং নারীর অধিকার নিয়েই লিখতে থাকেন তিনি। তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে, ‘স্ত্রীলোক ও পুরুষ’, ‘ইংরেজ মহিলার শিক্ষা ও স্বাধীনতার গতি’, ‘স্ত্রীলোকের কাজ ও কাজের মাহাত্ম’, ‘শিক্ষিতা ও দরিদ্রা নারী’, ‘স্বাধীন ও পরাধীন নারীজীবন’।

‘নিজের জন্য বাঁচো’, এই কথা বাংলাদেশের অনেক নারীবাদী নারীকেই বলতে শুনেছি আমি। এই বক্তব্য বাংলার নারীদের মধ্যে লিখিতভাবে সর্বপ্রথম দিয়েছিলেন কৃষ্ণভাবিনী দাস। সেই কোন উনিশ শতকে নারীকে যখন কেউ মানুষই মনে করতো না, অন্যের নিমিত্তেই তার বেঁচে থাকা, এটা ভাবা হতো, সেই সময়ে তিনি সাহসী উচ্চারণে লিখেছিলেন, “পরোপকার ও অন্যের জন্য জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্যে, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তও বাঁচিয়া থাকে।”

১৮৯১ সালে কৃষ্ণভাবিনী দাসের শিক্ষিতা নারী প্রবন্ধটি ছাপা হয় সাহিত্য পত্রিকায়। এই প্রবন্ধে তিনি নারীদের শিক্ষালাভের পর স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জনের কথা লিখেছিলেন। শিক্ষা লাভ করে নারী অর্থ উপার্জনের জন্য ঘরের বাইরে যাবে, এই ধারণাটা পছন্দ হয়নি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি তখন পুরুষতন্ত্রের মুখপাত্র। পুরুষই যে নারীকে ঘরে আটকে রেখেছে, কৃষ্ণভাবিনীর এই অভিযোগকে খণ্ডন করতে তাঁর সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন তিরিশ বছরের যুবক। এই বয়সে মানুষ সাধারণত কিছুটা প্রগতিশীল থাকে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রতিক্রিয়াশীল হয়। কিন্তু, তিনি তখনই একজন প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষ। তিনি ‘শিক্ষিতা নারী’ প্রবন্ধের সমালোচনা করতে গিয়ে লেখেন,
“শিক্ষিতা নারী প্রবন্ধে শ্রীমতি কৃষ্ণভাবিনী বিস্তর গবেষণা করিয়াছেন। আমাদের বিবেচনায় নারীদের অর্থোপার্জন শক্তির দৃষ্টান্তস্বরূপে মার্কিন স্ত্রী ডাক্তার, স্ত্রী এটর্নি এবং ইংরেজ গ্রন্থকারদিগের আলোচনা নিস্ফল। পুরুষের কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া অর্থোপার্জন স্ত্রীলোকের কাজ নহে।”

রবীন্দ্রনাথ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অর্থোপার্জন হচ্ছে পুরুষের কার্যক্ষেত্র। সেখানে নারীর কোনো ভূমিকা থাকবে না। নারী থাকবে পুরুষের আশ্রয়ে, আশ্রিত হয়ে। পুরুষ উপার্জন করে তাকে খাওয়াবে পরাবে। আর সে পুরুষের হয়ে ঘরকন্নার কাজ করবে।

অন্য অনেক পুরুষদের মতো নিষ্ঠুর অবশ্য তিনি ছিলেন না। নারীদের প্রতি তিনি দরদও অনুভব করতেন কিছুটা। নারীরা যে খুব একটা আদর-সোহাগে নেই, সেটা তিনি বোঝেন। সেই বোঝা থেকে তিনি নারীদের সান্ত¡না দিয়ে বলেন, “নারীর আদর কালক্রমে আপনি বাড়িবে, সেজন্য নারীদিগকে কোমর বাঁধিতে হইবে না, বরঞ্চ আরো অধিক সুন্দর হইতে হইবে।”

যার ব্যথা আর যন্ত্রণা, চিৎকার সেই করবে। কিন্তু, রবীন্দ্রনাথ সেই চিৎকারও শুনতে রাজি নন। মেয়েদেরকে তিনি রূপচর্চার পরামর্শ দিয়েছেন, কোমর বাঁধার পরিবর্তে কোমরের যত্ন নিতে বলেছেন প্রকারান্তরে, যাতে করে তারা তাদের স্বামীদের কাছ থেকে অধিক আদর আদায় করে নিতে পারে।
নারীদের কোমর বাঁধার ব্যাপারে সবসময়ই রবীন্দ্রনাথের অনীহা ছিলো। শুধু এই সময় নয়, পরবর্তীকালেও নারীদের এই নিজেদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে কোমর বাঁধাকে কোলাহল হিসাবে উল্লেখ করেছেন তিনি। নারীরা যে পুরুষের আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে থাকার বদলে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চায়, সেটাকে তীব্র সমালোচনা করে তিনি লিখেছিলেন,
“আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত, তাতে এই হত যে, চরিত্রের ওপর অধীনতার কুফল পড়ত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমনকি অধীনতাতে চরিত্রের মহত্ত¡ সম্পাদন করত। প্রভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভৃত্যের মনে মনুষত্বে হানি হয় না।”

রবীন্দ্রনাথের কাছে পুরুষ হচ্ছে প্রভু আর নারী হচ্ছে ভৃত্য। সেই ভৃত্য আগে প্রভুভক্তিকে ধর্ম বলে মনে করতো। কেনো ভৃত্য সেটাকে ধর্ম মনে করতো, কোন প্রতিষ্ঠান এই সামাজিক অন্যায় তৈরি করেছিলো, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তার লেশ নেই তাঁর লেখায়। বরং ভৃত্য সেই প্রভুভক্তির ধর্মকে ছেড়ে দিয়ে, প্রভুর আশ্রয় ছেড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে, সেই বিদ্রোহের করুণ আর্তনাদকে তাঁর কাছে কোলাহল বলে মন হচ্ছে।

ফিরে আসি আবার কৃষ্ণভাবিনীর লেখায়। নারীর শিক্ষা অর্জন এবং অর্থোপার্জনের জন্য বাইরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে অবরুদ্ধ করার যুক্তি হিসাবে প্রকৃতিকে টেনে আনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকৃতিই নারী এবং পুরুষকে আলাদা করে তৈরি করেছে, তাদের কার্যভার ভিন্ন করে দিয়েছে, এটাই বলতে চান তিনি। তিনি বলেন,
“প্রকৃতিই রমণীকে বিশেষ কার্য্যভার ও তদনুরূপ প্রবৃত্তি দিয়া গৃহবাসিনী করিয়াছেন – পুরুষের সার্ব্বভৌমিক স্বার্থপরতা ও উৎপীড়ণ নহে – অতএব বাহিরের কর্ম দিলে তিনি সুখীও হইবেন না, সফলও হইবেন না।”

রবীন্দ্রনাথ নারীকে গৃহকোণে দেখেই সুখ বোধ করেন। তিনি সবসময় মনে করেছেন, প্রকৃতিই নারীর জন্য এই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রই যে নারীকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়েছে, তাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করেছে, সেই সরল সত্যটাকে কখনোই স্বীকার করতে চাননি। তিনি পুরুষতান্ত্রিক ভাববাদিতা দিয়ে এমনই আচ্ছ¡ন্ন ছিলেন যে, এই সত্যটা আসলে কখনোই তিনি চোখেই দেখেননি। যা তিনি দেখেননি, সেটার স্বীকারোক্তি তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যাবে না এটাই স্বাভাবিক।

অনেকেই হয়তো রবীন্দ্রনাথকে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করার কথা বলবেন। এটা সত্যি, রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন পুরুষতান্ত্রিক এক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে। তাঁর চিন্তা-ভাবনা, কর্ম, সব প্রভাবিত হয়েছে সেই সময়ের সমাজব্যবস্থা দিয়ে। কিন্তু, প্রতিটা যুগেই অগ্রসর মানুষ থাকেন, যাঁরা চেষ্টা করেন প্রচলিত সমাজব্যবস্থার অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি আঙ্গুল তোলার। যে যুগে নারী শিক্ষা বলতে কিছু ছিলো না, নারীদের ঘরের বাইরে যাবার কোনো সুযোগ ছিলো না, সেই যুগেও কৃষ্ণভাবিনী পাড়ি দিয়েছেন কালাপানি। এর জন্য বিপুল ত্যাগ স্বীকার তাঁকে করতে হয়েছে। তাঁর এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিলো তাঁর বাচ্চা মেয়েটাকে। তিনি বিলেত গিয়েছেন এই অপরাধে তাঁর নয় বছরের কন্যাকে অপাত্রে বিয়ে দিয়ে ডানা ভেঙে দেন তাঁর শ্বশুর। মায়ের মতো সে-ও যাতে সামাজিক সংস্কার ভাঙতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।

কৃষ্ণভাবিনীতো রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। আরো আগে যাই আমরা। বার বার প্রকৃতির যে দোহাই পেড়েছেন রবীন্দ্রনাথ নারীকে পুরুষের অধীনস্থ প্রমাণ করতে, রবীন্দ্রনাথের বাল্যকালে সেটাকে উড়িয়ে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। প্রকৃতি নয়, বরং সামাজিক নিয়মদোষকে দায়ী করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন,
“স্ত্রী জাতি – সামাজিক নিয়মদোষে পুরুষজাতির নিতান্ত অধীন, প্রভুতাপন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া অত্যাচার ও অন্যায়াচারণ করিয়া থাকেন, তাহারা নিতান্ত নিরূপায় হইয়া সে সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন।”

শুধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একাই নন, রাজা রামমোহন রায়ও একই ধরনের কথা বলেছেন আরো আগেই। পিতৃতন্ত্র বল প্রয়োগ করে কেড়ে নিয়েছে নারীর অধিকার, দুই লিঙ্গের মধ্যে সৃষ্টি করেছে সামাজিক বৈষম্য, এগুলো ধরা পড়েছে কৃষ্ণভাবিনী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়দের চোখে, কিন্তু নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে রেখেছে রবীন্দ্রনাথ। মিষ্টি মিষ্টি কথায় নারীর রূপ-গুণের প্রশংসা করে তাকে শিকলবদ্ধ করে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি ভিক্টোরিয়ান মামসকিতার প্রতিভূ হিসাবে। রবীন্দ্রনাথকে তাই কালের দোহাই দিয়ে ছাড় দিয়ে দেওয়া যায় না তাঁর এইসব প্রতিক্রিয়াশীল এবং বদ্ধ মানসিকতার। তাঁর প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতা কালের সীমাবদ্ধতা থেকে আসেনি, এসেছে তাঁর প্রথাগত সংকীর্ণতা থেকে। কালকে অতিক্রম করাতো দূরের কথা, তিনি তাঁর কালের প্রগতিশীল মানুষদের চিন্তা-ভাবনাগুলোকেও আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হয়েছেন শোচনীয়ভাবে।