মণিজিঞ্জির সান্যাল : সুন্দর ছন্দময় ছোট্ট শব্দ গয়না। তবে তার ইতিকথা বিশাল। সেই কবে কখন কোন সময়টিতে নারী গয়নাকে সাজসজ্জার ভূষণ হিসেবে একান্তভাবে গ্রহণ করেছিল, তা সঠিকভাবে সময় নির্ধারণ খুবই দুঃসাধ্য। তারপরও ধারণা করা যায়, সভ্যতার শুরু থেকে বিভিন্ন যুগের ঐতিহাসিক বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নারী গয়নাকে সাজের অঙ্গ এবং পুরুষেরা নিজের প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখেই নিজের অলংকরণ করতে গয়নাকে বেছে নিয়েছিল।
প্রাচীন সভ্যতায় চোখ ফেরালে দেখা যায়, গৃহচিত্র থেকে শুরু করে হাজার বছর ধরে নানা ধরনের শিল্পে গয়নার ব্যবহার হয়েছে। প্রাচীন সভ্যতা বলতে এখানে মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, সিন্ধু সভ্যতার কথা বলছি, এসবের যে নমুনা আমরা পেয়েছি, তাতে দেখা যায়, সেই প্রাচীন যুগ থেকে পুরুষ ও নারী নানা ধরনের গয়নায় নিজেকে সজ্জিত করেছে। মিসরের মমির দেহে নানা অলংকার দেখা গেছে, এ ছাড়া মন্দিরের গায়ে যেসব চিত্র–ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে নানা ধরনের নকশাসংবলিত গয়না খুঁজে পাওয়া গেছে। এই গয়নাগুলোর নমুনা দেখে বোঝা যায়, সে সময়ে ফুল, পাতা, বীজ, মাটি, পশুপাখির হাড়, পাখির পালক ও বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার ছিল গয়নায়। তারপরও ধীরে ধীরে যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গয়নাশিল্পের নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হয়।
এই পরিবর্তনকে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি। যেমন প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ। আনুমানিক সাত হাজার বছর আগের মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেই সময়ে পুরুষেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি অঙ্গভূষণ ব্যবহার করত। যুদ্ধের প্রয়োজনে এবং সেই অঙ্গভূষণের মধ্যে শিরোভূষণ ও কণ্ঠভূষণের আলংকারিক নকশাগুলো বিখ্যাত ছিল এবং এগুলো ব্রোঞ্জ, পিতল, দস্তা, পশুর চামড়া, হাড়, কাঠসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হতো এবং সম্ভবত সেই সময় থেকে সোনার ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে নারীরা গয়নার উপকরণ হিসেবে নুড়িপাথর, পাখির পালক, বীজ, ফুল, লতাপাতা, পশুপাখির হাড় ব্যবহার করে নিজেদের হাতে তৈরি গয়না বানাতে শুরু করে।
আনুমানিক তিন হাজার বছর আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার সময়ে সোনা ও রুপা দিয়ে গয়না তৈরি শুরু হয়। সেই সময়ের ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন মন্দিরে যেসব মূর্তি ও ভাস্কর্য দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকার সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। বিশেষ করে কোনারক মন্দির (ভারতের ওডিশা), বাংলাদেশের মহাস্থানগড়ে, তমলুকের মন্দিরে (মেদিনীপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) যেসব দেবদেবীর মূর্তি দেখা যায়, তাতে বিভিন্ন ধরনের অলংকারের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এই সব অলংকারের মধ্যে মাথার টিকলি, গলার সাতনরি হার, কোমরের চন্দ্রহার, হাতের বাজুবন্ধ, চুড়ি, বালা, রতনচূড়, বিভিন্ন নকশার আংটি, পায়ের খাড়ু, চরণচক্র, কানবালা, কেউর (বাজুবন্ধ), বিছাহার, সীতাহার, কান ঝুমকা (কানঢাকা ঝুমকা), অলংকৃত চিরুনি, অলংকৃত চুলের কাঁটা, মাদুলি, মুকুট বেশি দেখা যায়।
পরবর্তী সময়ে মুসলিম যুগে যখন মোগলেরা ভারতে আসে, তখন অলংকারশিল্পের পরিবর্তন ঘটে। পারস্য থেকে শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অলংকারের প্রচলন ঘটে। তখন সোনার অলংকারের সঙ্গে দামি রতেœর ব্যবহার শুরু হয়। মোগল রাজকন্যারা সোনার সঙ্গে মুক্তা, হীরা, পান্না, চুনি, নীলা ইত্যাদি রতœ ব্যবহার করতে পছন্দ করত। বাদশাহ ও বেগমদের মুকুটে রত্নার ব্যবহার ছিল অত্যাবশ্যকীয়। মোগল যুগের গয়না বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
আঠারো শতকের পরবর্তী সময়টিকে গয়নার আধুনিক যুগ। এই সময় এই উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের সভ্যতার প্রসার লাভ করে। পাশ্চাত্য ঘরানার অলংকারশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দামি পাথর ও অল্প সোনার ব্যবহার। প্রধানত সেই সময় থেকে সোনার সঙ্গে রুপা, প্লাটিনাম, স্টিল বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং নকশার দিকেও বেশি নজর দেওয়া শুরু হয়।
উনিশ শতক থেকে প্রিসিয়াস মেটালের পরিবর্তে কৃত্রিম উপাদান দিয়ে তৈরি গয়না, যা আমরা কস্টিউম জুয়েলারি হিসেবে এখন চিনি, তার প্রচলন হয়। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে এ ধরনের গয়না খুবই জনপ্রিয়তা পায়।
গয়নার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় যে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত শুধু উচ্চবিত্ত লোকজনই সোনা-রুপাসহ দামি রত্ন ব্যবহার করে আসছে। নিম্নবিত্তের লোকজন তামা, পিতল, কাচ, মাটি ইত্যাদি উপাদানের গয়না ব্যবহার করে। সুতরাং গয়নার সঙ্গে এই শ্রেণিবিভেদ ভীষণভাবে প্রতীয়মান হয়। তবে কম দামি উপাদানের তৈরি গয়না এখন সমানভাবে জনপ্রিয় ও সমাদৃত, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে।
বিভিন্ন যুগ বা সময়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বা ইতিহাসের পাতা উল্টোলে দেখা যায়, মুঘল যুগের সোনার অলংকার একেবারেই অনন্য অসাধারণ।
মুঘলরা যেই সময় ভারতে আসে তখন নিজেদের সাথে নিয়ে আসে অতুলনীয় প্রতিভাশালী সুদক্ষ শিল্পীদের যারা সোনার গয়নাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন এবং নামকরণও করেছিলেন নতুনরূপে। সেই সময় অলংকরণের চারুকলাকে তারা ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন? সেই যুগের কিছু সেরা জহুরি মুঘলদের অধীনে কাজ করতেন? তাদের হাতের সূ² কাজ ছিল দেখার মতো। মুঘলদের গয়না (গহনা) তাই অপূর্ব সুন্দরভাবে খচিত এবং তাদের ডিজাইনে সূ²তার মাত্রাই সেগুলিকে আলাদা করত?
সেই সময়ের গয়নাগুলি ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল? রতœ খচিত পাগড়ি, পদাঙ্গুলীর আংটি বা চুটকি, নেকলেস ইত্যাদির মত ভারী গয়না পরে রাজ পরিবারের সদস্যরা তাদের সামাজিক অবস্থান প্রদর্শন করত? মুঘলরা মধ্য প্রাচ্য থেকে আসা ডিজাইনগুলির সাথে ভারতের পরিচয় করায়, হিন্দু ও মুসলিম শৈলির একটি মিশ্রণ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে? অনেক মুঘল রাজাই রাজপুত রাজকন্যাদের বিয়ে করেছিলেন বলে রাজপুত শিল্পীরা মুঘল ঘরানায় চলে আসে? এর ফলে গয়নার ক্ষেত্রে মুঘলদের সূ² ডিজাইনের সাথে রাজপুতদের নিখুঁত কারুকাজের একটি অভিনব একত্রীকরণ হয়?
বিখ্যাত কুন্দনের গয়না মুঘলরাই জনপ্রিয় করে তুলেছিল? ঘরোয়া তাপমাত্রায় সোনার ওপর পাথরের সেটিং করার চারুকলা মুঘল আমলের একটি স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যমূলক গয়না-প্রস্তুতির কৌশল? কুন্দন শব্দটির অর্থ অতিমাত্রায় বিশুদ্ধ সোনা। আর তাই অত্যন্ত বিশুদ্ধ এবং সম্পূর্ণ গলানো সোনা এই কুন্দন গয়নায় ব্যবহার করা হয়?
রাজস্থানী প্রাচুর্যপূর্ণ গয়না জারাওতার শিকড় মুঘল গয়নাতেই খুঁজে পায়? এক্ষেত্রে নমনীয় সোনার ওপর পাথর সেট করার জন্য তিন-স্তর বিশিষ্ট কার্যক্রমের প্রক্রিয়া নিযুক্ত থাকে? কলাইয়ের কাজ বা মীনাকরীর কাজও মুঘল যুগেই সমৃদ্ধি পায়? মীনাকরীর কাজ একটি সময়-সাপেক্ষ কৌশল যেটি গয়নার দুই পাশেই ফুলের কারুকার্য করে? তাছাড়া ফিলিং অর্থাৎ সোনার তার পরস্পর গেঁথে যে গয়না তৈরি হয় এবং গলে যাওয়া কাঁচের ওপর সোনার ফলকে নিখুঁত কাজ করা গয়নার কাজের মতো জটিল কৌশলগুলি দৃষ্টান্তমূলক এবং অনন্য মুঘল শিল্পকলাকে প্রতীকায়িত করে? একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় মুঘল গয়নার ডিজাইন ছিল অর্ধচন্দ্রকলা এবং বৃন্ত। কানের দুলগুলি সম্পূর্ণ কান জুড়ে অর্ধচন্দ্রাকারে তৈরি হত যার ওপরে একটি ছোট বৃন্ত থাকত?
মুঘল সম্রাটদের পরিহিত সিল্কের পাগড়িগুলি সোনায় মীনাকরী কাজ করা অলংকার দিয়ে সাজানো থাকত? কব্জির অলংকারগুলি যেমন কড়া, বালা, ব্রেসলেট ইত্যাদি বেশিরভাগ সময় কলাই করা সোনা দিয়ে তৈরি হত যেগুলিতে নিখুঁত এবং মার্জিত ফুলের ডিজাইন থাকত? সম্রাটরা যে বিশাল বড় আংটিগুলি পরত তা কাঁটি সোনায় বা কলাই করা সোনায় তৈরি হত? মুঘল রাজ্ঞীরা প্রায়সই নিখুঁতভাবে কাজ করা গোল্ড-প্লেটেড নূপুর পরত? মুঘল যুগের একটি অন্যতম জনপ্রিয় সোনার সাজের সরঞ্জাম ছিল ‘নথ’? এই নাকছাবিটি বৃত্তাকার সোনার তার দিয়ে তৈরি হত যার মধ্যে চুণী এবং মুক্তোর মত পাথর গ্রথিত থাকত আর প্রত্যেক মুঘল সম্রাজ্ঞী এটি পরত?
রাজ পরিবারের মহিলারা খিল বা দড়ি দেওয়া অনন্ত পরত যেগুলি খাঁটি সোনায় অথবা কলাই করা সোনায় তৈরি করা হত? ‘কানফুল’ ঝুমকো এই সময়ই উঠে আসে; এগুলির বৈশিষ্ট্য ছিল এগুলিতে একটি চেন এবং একটি সুন্দর ফুলের নকশা সংযুক্ত থাকত? মুঘলকা সোনার সুতো দিয়ে এম্ব্রোডারি করা বিভিন্ন স্টাইলের জুতোও তৈরি করেছিল যেগুলি মোজড়ি নামে পরিচিত ছিল?
মুঘল সময়কালের এই সোনার গহনা প্রস্তুতির কৌশল এবং অলঙ্কৃত ডিজাইনগুলি উত্তর ভারত জুড়ে সমাদৃত হয়ে এসেছে, বিশেষত আধুনিক কালের রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং গুজরাটের মত রাজ্যগুলি জুড়ে ? তবে আজকাল মুঘল সোনার গহনার রাজকীয় ডিজাইনগুলি আন্তর্জাতিক সীমাও অতিক্রম করেছে এবং সারা পৃথিবীতেই স্বীকৃত এবং সমাদৃত হয়ে চলেছে?
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক
শিলিগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ