হাসান আমিন : কুইবেকে অস্থায়ী বিদেশী কর্মীদের সংখ্যা কানাডার অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় দ্রুত বেড়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শোষণ প্রতিরোধে কার্যকরী কোন ব্যবস্থা বজায় না রাখার ফলে অনেক শ্রমিক কুইবেকের অন্য কোথাও বা সীমান্তের ওপারে অবৈধ কাজের জন্য খামার ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

কোয়ালিশন অ্যাভেনির কুইবেকের ফ্রাঁসোয়া লেগল্টের অধীনে থাকা প্রাদেশিক সরকার, যারা আগামী ৩ অক্টোবর পুনঃনির্বাচন চাইছে, তারা অভিবাসন বৃদ্ধি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বয়স্ক জনসংখ্যা এবং ক্রমহ্রাসমান জন্মহারসহ একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিতে গুরুতর শ্রমের ঘাটতি থাকা সত্বেও অভিবাসন বাড়ানোর বিষয়ে আপত্তি করছে তারা। এটি পরিস্থিতিকে কেবল আরও খারাপের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে।

পরিবর্তে তারা কুইবেকের নিয়োগকর্তাদের ২০২৩ সালের মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা তিনগুণ করার অনুমতি দেওয়ার জন্য অটওয়ার সাথে চুক্তি করেছে। এটি সর্বজনবিদিত যে নিরাপত্তাহীন এই শ্রমশক্তির সুস্থতা তাদের নিয়োগকর্তাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক এডওয়ার্ড ডানসওয়ার্থ বলেছেন, এটি গভীরভাবে সমস্যাযুক্ত কারণ আপনি শ্রমশক্তিতে কাঠামোগত অর্থনৈতিক সমস্যা এবং কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান করছেন এমন একটি কার্যক্রমের মাধ্যমে যা মানুষকে খুব স্পষ্টভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর অধিকার প্রদানের শর্তে কাজের জন্য নিয়ে আসছে।

২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ফেডারেল সরকার কুইবেক নিয়োগকর্তাদের অস্থায়ী বিদেশী কর্মীদের জন্য জারি করা পারমিটের সংখ্যা ১৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। যা ২০১৭ সালে ছিলো তের হাজার ৩০ জন এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ত্রিশ হাজার ৩৪০ জনে। একটি অভিবাসী শ্রমিকদের অ্যাডভোকেসি গ্রুপের অনুমান অনুসারে ২০২৭ সালের মধ্যে এই সংখ্যা নব্বই হাজার হতে পারে।

অভিবাসি শ্রমিকদের পারমিট দেয়ার ক্ষেত্রে কুইবেকের পরে দ্বিতীয় ছিল প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপ। এটি ২০১৭ সালে ৬০৫টি পারমিট অনুমোদন কররেছিলো, যা ২০২১ সালে এসে এক হাজার ১১৫টি-তে দাঁড়িয়েছে – অর্থাৎ ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। সে তুলনায় গত বছর অন্টারিওতে ৩৩ হাজার ৯২০টি পারমিট জারি করা হয়েছিল, যা ২০১৭ সাল থেকে মাত্র ১৮ শতাংশ বেশি।

অস্থায়ী বিদেশী কর্মীদের পূর্ব কানাডার কৃষি সেক্টরের মেরুদন্ড হিসাবে গন্য করা হয়। তারা এখন কানাডার সব ধরণের শিল্পকে প্রসারিত করতে ভূমিকা রাখছে। এর মধ্যে আসবাবপত্র উৎপাদন, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত, এসব সেক্টর কেবল মৌসুমি চাকরির বাজার নয়।

শ্রমবাজারের দ্রæত স¤প্রসারণ সত্তে¡ও কুইবেকের সংস্থানগুলো সে তুলনায় খুবই ধীর গতির। গবেষকরা বলছেন যে, এটি ক্রমবর্ধমান সংখ্যক শ্রমিককে অবৈধ কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে চোরাকারবারিদের হাজার হাজার ডলার পরিশোধ করে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাচ্ছে।

টরন্টোর ইউনিভার্সিটি ডি ল’অন্টারিও ফ্রাঙ্কাইসের সহকারী অধ্যাপক গুইলারমো ক্যান্ডিজ বলেছেন, অন্টারিওতে আপনি যা পেতে পারেন তার চেয়ে শ্রমিকদের সাহায্য করার জন্য কুইবেকে কম সাহায্য সংস্থা এবং নেটওয়ার্ক রয়েছে। ক্যান্ডিজ কুইবেক সিটি অঞ্চলে এবং মেক্সিকোতে এ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করেছেন। সেখানে তিনি অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে সাত মাস কাটিয়েছেন।

ক্যান্ডিজ একটি অভিবাসী কৃষি শ্রমিকদের সহায়তা নেটওয়ার্কের পরিচালনা পর্ষদে জড়িত, এটি কুইবেকের অভিবাসী কৃষি শ্রমিকদের জন্য সহায়তা নেটওয়ার্ক (RATTMAQ)। সংস্থাটি স¤প্রতি শেরব্রুক, কুইবেক সিটি এবং রিভিয়ের-ডু-লুপে নতুন অফিস খুলেছে এবং সেন্ট-জেরোমে শীঘ্রই আরেকটি খোলার পরিকল্পনা করছে। যদিও এর নেটওয়ার্ক বেড়েছে, তবে সংস্থাটি শ্রমিকদের প্রতিটি অভিযোগ গ্রহণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

সহ-প্রতিষ্ঠাতা মিশেল পিলন বলেছেন, এর বিস্তৃতি ‘বিস্ময়কর।’ RATTMAQ ২০২০-২১ সালে অভিবাসী কর্মীদের অভিযোগ সম্পর্কিত ৭৬টি আইনি মামলা নিয়েছে। পরবর্তী ১২ মাসে এ সংখ্যাটি ৫৭৮-এ পৌঁছেছে। আমাদের সম্পদের পরিমাণের তুলনায় চাহিদা প্রচুর, পাইলন স্বীকার করেছেন। আরও বেশি করে আমাদের বেছে নিতে হবে।

সিবিসি কর্তৃক প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুসারে, অস্থায়ী বিদেশী কর্মীদের তরফে কুইবেকের কর্মক্ষেত্রের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বোর্ডে (CNESST) দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। পাইলনের মতে অভিযোগের বৃদ্ধি সম্পূর্ণরূপে একটি খারাপ জিনিস নয়, কারণ এর অর্থ হল আরও অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিকরা নিজেদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিতে এবং উকিল দিতে প্রস্তুত।

ফেদেরিকো আলিয়াস, যিনি গত বসন্তে মন্ট্রিলের উত্তরে একটি খামারে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, অনেক শ্রমিকের অভিযোগ করার কারণ রয়েছে। আলিয়াস জানান, তিনি অস্থায়ী কর্মীদের এবং তাদের নিয়োগকর্তার মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করেছেন। কুইবেকের শ্রম আইন মানা হচ্ছে তা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কমিটি গঠন করার পর কিছুদিন পরেই অ্যালিয়াসকে চাকরি থেকে ছয় সপ্তাহের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছিল।

তারা বলেছিল যে আমি শ্রমিকদের পক্ষ নিচ্ছি, আলিয়াস বলেছেন। তিনি সাবলীলভাবে স্প্যানিশ বলতে পারেন, যা তার জন্য শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ করা সহজ করে তোলে। আমি শ্রমিকদের পক্ষ নিচ্ছিলাম না; আমি আইনের পক্ষ নিচ্ছিলাম।

আলিয়াস বলেন, খামারের ব্যবস্থাপক এবং মালিকরা প্রায়ই শ্রমিকদের মনে করিয়ে দেন যে তাদের দেশের শত শত মানুষ তাদের জায়গায় চাকরির পেতে উদগ্রিব, যাতে কাজ এবং জীবনযাত্রার অবস্থার বিষয়ে শ্রমিকরা তাদের উদ্বেগ মুছে ফেলেন। তিনি বলেন, মালিকরা যেভাবে শ্রমিকদের সাথে আচরণ করে এবং তাদের সম্পর্কে মালিকানার সুরে কথা বলে তা প্রকাশ করে যে সেই শ্রমিকদের উপর সিস্টেমটি নিয়োগকর্তাদের কতটা ক্ষমতা দেয়। আমি এটা ভাবতে পারিনা যে ২০২২ সালে এসে আমরা এখনও হুমকি এবং ভয়ের সাথে কাজ করতে হচ্ছে।

আলিয়াসের বিষয়ে খামারের মালিকদের একজন বলেছেন যে, আলিয়াসকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কারণ সে যথেষ্ট দক্ষ ছিল না। তবে তিনি জানান, আলিয়াস যে কমিটি স্থাপন করেছিলেন তা বহাল রয়েছে এবং এখন অন্য দুই মানবসম্পদ কর্মচারী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। খামার অপারেটর স্বীকার করেছেন যে, বাড়ি পাঠানোর ভয়ে বা অন্য মৌসুমে যদি ডাকা না হয়, সে ভয়ে শ্রমিকরা প্রায়ই কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন। তিনি বলেন, খামার শ্রমিকদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে সেই পরিস্থিতিগুলো প্রশমিত করার চেষ্টা করে।

তিনি জানান, এই মৌসুমে প্রায় ১০ জন কর্মী ফার্ম ছেড়েছেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য তারা এটি করেছে। কিছু লোক কাজে যোগ দিতে আসার পরপরই এমনটা করতে তৎপর ছিলো বলে বিশ্বাস তার। তিনি বলেন, খামারটি তার কর্মীদের চোরাকারবারীদের হাতে না পড়তে নিরুৎসাহিত করার জন্য মিটিং করেছে, তারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করলে তারা কী ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হয় সে সম্পর্কে তাদের অবহিত করেছে।
জঅঞঞগঅছ-এর পিলন বলেছেন, কানাডার বিদেশী শ্রমিকদের কর্মসূচীর মৌলিক কাঠামোতেই সমস্যা রয়েছে। অর্ধ ডজনেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিকদের আইনজীবী এবং গবেষকদের কথা অনুযায়ী, এই কর্মসূচির অসাম্যের মূলে যে বিষয়টি রয়েছে তা হল, শ্রমিকদের পারমিট তাদের নিয়োগকর্তার সাথে আবদ্ধ।

কুইবেক লিবারেল পার্টি বলেছে, নির্বাচিত হলে, এটি ২০২২ সালে কুইবেকে অনুমোদিত স্থায়ী অভিবাসীদের সংখ্যা ৭০ হাজারে উন্নীত করবে। দলটি বলেছে, তারা প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে তাদের নিজস্ব অভিবাসন চাহিদা নির্ধারণের জন্য চুক্তিও তৈরি করবে।
২০১৯ সালে ফেডারেল সরকার ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে অস্থায়ী বিদেশী কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত ওয়ার্ক পারমিট প্রাপ্তির বইষয়টি সম্ভব করেছিল যাতে তারা অন্য নিয়োগকর্তাদের জন্য কাজ করতে পারে, কিন্তু পারমিটগুলো একটি সংস্থার সাহায্য ছাড়া পাওয়া কঠিন। আরও বিষয় হল, এই পারমিট এক বছর পরে মেয়াদ শেষ হয়ে যায় এবং নবায়নযোগ্য থাকে না। একবার আসল চুক্তি শেষ হয়ে গেলে একজন কর্মী ওপেন পারমিটের জন্য আর আবেদন করতে পারবেন না। সূত্র : সিবিসি