অনলাইন ডেস্ক : দেশ ছেড়েছেন ২২ বছরের বেশি সময়। এখনকার আবাস পাশের দেশ ভারতে। সেখানকার নগরিকত্বও নিয়েছেন। তবে এ দেশের মানুষ তাঁকে আজও ভোলেনি। চলচ্চিত্রপ্রেমী সবার আজও প্রিয়মুখ তিনি। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ একটি ছবিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে যুগের পর যুগ। শুধু ছবি অভিনয় নয়, কালজয়ী গান ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’র জন্যও মনে রাখবে এই মানুষটিকে। তিনি আর কেউ নন, অঞ্জু ঘোষ। বুধবার দুপুরে কথা হলে জানালেন, কলকাতার বাড়িতে বাগানের পরিচর্যা নিয়ে ব্যস্ত তিনি।
অবশ্য তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে গেল বছর। অঞ্জু ঘোষ বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক বেধেছে পশ্চিমবঙ্গে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে মিজ ঘোষের নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বলা হয়েছে, তিনি আসলে বাংলাদেশের নাগরিক এবং ‘কারসাজি করে তাঁকে ভারতের নাগরিক বানানো হয়েছে’। একজন বিদেশি কীভাবে ভারতের একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, সেই প্রশ্ন তুলছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল। তবে বিজেপি দাবি করেছে যে মিজ ঘোষের বাবা বাংলাদেশের মানুষ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর জন্ম–কর্ম, সবই কলকাতায়।
অঞ্জু ঘোষ ১৯৯৮ সালে যখন দেশ ছাড়েন। ছবি: সংগৃহীত
অঞ্জু ঘোষ ১৯৯৮ সালে যখন দেশ ছাড়েন। ছবি: সংগৃহীত
নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক আপাতত থাক। বর্তমানে কলকাতার সল্টলেকে থাকেন অঞ্জু ঘোষ। মা–বাবা দুজনেই মারা গেছেন। সময় কীভাবে কাটে জানতে চাইলে অঞ্জু ঘোষ বলেন, ‘লকডাউন ঘরে বসে কাটে। প্রয়োজনীয় কাজে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হয়। আমাদের এদিককার পরিস্থিতি ভালো। তবে আমার একটুও মনে হয় না, সময় কাটছে না। একটা বাড়ি দেখাশোনা করে সামলে রাখাটাও অনেক সময়ের কাজ। এসব করছি। রান্নাবান্না করি। বাগানে সময় কাটাই অনেক বেশি।’
পরিবার নিয়ে খুব বেশি কিছু বলতে চাইলেন না এই অভিনয়শিল্পী। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে বড় হয়েছেন অঞ্জু ঘোষ। অষ্টম শ্রেণিতে থাকতে তাঁর সিনেমায় অভিনয় শুরু। প্রথম অভিনীত সিনেমা তমিজ উদ্দিন রিজভীর ‘আশীর্বাদ’। তবে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এফ কবীর চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’। গত শতকের আশির দশক থেকে অভিনয়জীবন শুরু করা অঞ্জু ঘোষ ১৯৯৮ সালে যখন দেশ ছাড়েন, তত দিনে অভিনয় করেছেন তিন শতাধিক ছবিতে। দুই দশক পর ২০১৮ সালের শেষ দিকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় আসেন তিনি।
কী কারণে দেশ ছেড়েছেন, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কার কিছু বলেননি। বেশ কয়েকবার এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান। একটি বাক্যে প্রশ্ন এড়িয়ে যান, ‘এ বিষয়ে বলতে চাই না।’ তবে মনে যে কষ্ট ছিল, তা তাঁর কথায় স্পষ্ট। তিনি সরাসরি কিছু না বললেও তাঁর ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে জানা গেছে, কয়েকজন পরিচালক ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা উত্ত্যক্ত করতেন। এ কারণে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন অঞ্জু। তবে এ প্রসঙ্গটি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি হ্যাঁ বা না কিছুই বলেননি। বলেন, ‘থাক না এসব আলাপ।’
ছোটবেলা থেকে গানে ভীষণ ঝোঁক ছিল অঞ্জু ঘোষের। গুনগুন করে গান গাইতেন। তাঁর কণ্ঠে ‘ওরে ও বাঁশিওয়ালা’ গানটি তো সুপারহিট। গানটি গাওয়ার সময়কার ঘটনা মনে পড়ে কি না, জানতে চাইলে বলেন, ‘ছবির শুটিংয়ের সময় আমরা এমনিতে গুনগুন করে গাইতে থাকি। একদিন সুবল দা (সুবল দাস) বললেন, অঞ্জু, গান গাইতে হবে। তখন অন্য ছবিতে একটা গান গাওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। এরপর ভাবলাম, গেয়ে দেখি। একদম খেলার ছলে গানটি গাওয়া। গাওয়ার সময়ও মনে হয়নি এতটা জনপ্রিয়তা পাবে।’
অঞ্জু ঘোষ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর ও সংগীতে প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন। এরপর সুবল দাস, আলাউদ্দীন আলীর সুরেও গান গেয়েছেন। তাঁর দুটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছিল।
শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি দুর্বলতা ছিল অঞ্জু ঘোষের। ছোটবেলায় এসরাজ শিখতেন। চট্টগ্রামের শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ মানবেন্দ্র বড়ুয়া তাঁকে এসরাজ শিখিয়েছেন। জনপ্রিয় এই নায়িকার সংগীত পরিচালনায় রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন ও এন্ড্রু কিশোরও গান করেছেন।
‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বাংলা ছবির ইতিহাসে সফল একটি নাম। তিন শতাধিক ছবিতে অভিনয় করলেও অঞ্জুর কথা বললেই এই ছবিটির নাম সবার আগে আসে। এই ছবির সাফল্যের রহস্য জানতে চাইলে বলেন, ‘কিছুই না, এটা মাটির গল্প। এই ছবির গানগুলো মাটির গান, সংলাপগুলো মা-বোন যাঁরা গ্রামগঞ্জে থাকেন, তাঁদের মনের একটা খোরাক। এমন একজন মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তিনি নাকি ২৭০ বার “বেদের মেয়ে জোসনা” ছবিটি দেখেছেন।’
ছবিটি নিয়ে একরকম কষ্টও আছে বলে জানালেন। বলেন, ‘একজীবনে এত ছবিতে অভিনয় করেছি, যাঁর সঙ্গেই দেখা হয়, শুধু এই একটা ছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র কথা বলেন। বলেন, ভালো লাগে!’
ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন রাজ্জাক, ওয়াসিম, জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চনকে। সবার সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং আন্তরিকতা ছিল। শিল্পী তৈরির পেছনে পরিচালক আর প্রযোজকদের ভূমিকা থাকে। আপনার ক্ষেত্রে কাদের কথা মনে করবেন? এমন প্রশ্নে অঞ্জু বলেন, ‘সে সময় যাঁরা কাজ করেছেন, সবাই গাইড করেছেন। কারও থেকে কেউ কম নন। তমিজ উদ্দিন রিজভী, এফ কবীর চৌধুরী, আলমগীর কুমকুম—একটা বাচ্চাকে যেভাবে হাঁটাচলা শেখায়, সেভাবে তাঁরা আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন।’