আতোয়ার রহমান : ১লা জুলাই, ২০২২ কানাডার ১৫৫-তম জন্মদিবস বা কানাডা দিবস পালিত হচ্ছে। ১৮৬৭ সালের পহেলা জুলাই কানাডা গ্রেট বৃটেনের একটি স্বশাসিত রাজ্যে পরিণত হয় এবং চারটি প্রদেশের একটি ফেডারেশনে রুপান্তরিত হয়। প্রদেশগুলো হল : অন্টারিও, নোভা স্কোশিয়া, নিউ বার্নসিক এবং কুইবেক। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এটি প্রতিবছর ডমিনিওন দিবস হিসেবে পালিত হতো। ১৯৮৩ সাল থেকে এটি ‘কানাডা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এটি জাতীয় ছুটির দিন। এ দিনে কানাডিয়ানরা সারা দেশে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্জনগুলোর প্রতি তাদের গৌরব প্রদর্শন করে।
এটি একটি আনন্দ উদযাপনের দিন হিসেবে পরিণত হয়েছে, যেখানে সারা দেশে নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই ড্যানফোর্থেও আমাদের বাঙালি কম্যুনিটিতেও বিভিন্ন ধরনের মেলা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

কানাডা বহুসংস্কৃতির একটি উন্মুক্ত, উদার গণতন্ত্রের আশাবাদী দেশ যার রয়েছে একটি প্রাণবন্ত শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক স¤প্রদায়। উত্তর গোলার্ধের অতিকায় এ দেশটিতে বহু সংস্কৃতির লোকজনের বসবাস যাদের শেকড় গ্রথিত রয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। কানাডা এমন একটি দেশ যা বাকস্বাধীনতা এবং কল্পনাতে খুব উদার। কানাডিয়ানরা জাতি, শ্রেণী এবং সময় জুড়ে “মহান সংহতিতে” বিশ্বাসী।

বৈচিত্র্য হচ্ছে কানাডিয়ান সমাজের অলঙ্কার, অহঙ্কার ও আনন্দ। বহু জাতিগোষ্ঠীর লোকদের এক করে একটা সাংস্কৃতিক মিশ্রণ তৈরিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটি। অনেকটা সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মধ্যে কানাডার একটা ঐক্য, সমগ্রতা এবং পরিপূর্ণতা গড়ে উঠেছে। ভাব ও মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা এই বহুসংস্কৃতিকতাকে আরো মাধুর্য দান করেছে। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পটভুমির মানুষকে কানাডা স্বাগত জানিয়েছে এবং তারা এখানে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে।

কানাডা হচ্ছে সামাজিক ঐক্য, স্থিতিস্থাপকতা ও নব্য ধারা সৃষ্টির একটি জীবন্ত ল্যাবরেটরি। এখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পয়সা, বিত্তের পিছনে ছুটলেও মানবিকতাবোধকেই জীবনের সারবস্তু মেনেছে। কিন্তু এটাকে নেহায়েত অবধারিত একটি বিষয় মনে না করে এ অবস্থানকে টেকসই ও স্থায়ী করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে সকলকে।

কানাডাসহ পসচিমের দেশগুলিতে সকলেরই সমান অধিকার, সমান রাষ্ট্রীয় সুযগ সুবিধা। কানাডাকে মানবাধিকারের দুর্গ বলা হয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গভেদে কোন বৈষম্য করা হয়না। এসংক্রান্ত সংবিধানের নীতি যথাযথভাবে পালন করা হয়। কানাডিয়ান মূল্যবোধের আর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কানাডিয়ান আইন অক্ষম ও প্রতিবন্ধীদের – তা মানসিক বা শারীরিক যাই হোক না কেনো – সাথে অন্য সকলের সমতার বিধান ঘোষণা করে। তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মাসিক ভাতাও প্রদান করা হয়। এখানে কেউ রাস্ট্র বা ব্যক্তি কত্রিক নিগৃহীত বা নির্যাতনের স্বীকার হলে বুদ্বিজীবীরা বা সুশীল সমাজ শুধু শোক প্রকাশমূলক দায়সারা গোছের বিবৃতির মধ্যে সীমাবধ্ব না থেকে তার পক্ষে আইনী লড়াই চালিয়ে যান, অথবা সেরকম ব্যবস্থা করেন।

এটা সত্য যে কানাডাতে বিভিন্ন দেশ ও জাতির লোক একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে, একটি বাগানের বিভিন্ন জাতের ফুলের মত একত্রে বসবাস করে। কিন্তু তাই বলে পরিপূর্ণ সমতা এসে গেছে বলা যায় না। আমরা যদি টরন্টোতে বা খোদ এই ড্যানফোর্থ বা আশেপাশের এলাকায় তাকাই, তাহলে দেখি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জনগোষ্ঠী আসলে তাদের নিজ নিজ ঘেটোতে বসবাস করছে। কর্মক্ষেত্রে কিছুটা আন্তসাংস্কৃতিক মেলামেশা আছে, কিন্তু সামাজিক জীবনে এটা কদাচিৎ পরিলক্ষিত হয়। নতুন অভিবাসীরা নানা নিয়মের বেড়াজালে জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের প্রতিকুল অবস্থা থেকে রেহাই পেতে নতুন দেশে এসে আর এক প্রতিকুল অবস্থার সন্মুখীন হচ্ছে। এ যেন জ্বলন্ত উনুন থেকে আগুনে পড়ার মত অবস্থা। যেসব অভিবাসীর আন্তর্জাতিক সনদপত্র রয়েছে, তারা তাড়াতাড়ি সেট হয়ে যায়, কিন্তু যাদের নাই, বাই ডিফল্ট তারা ঘেটো হয়ে থাকে সেই কম্যুনিটিতে। তাছাড়া কানাডার সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে এখানকার অভিবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। কানাডা দিবসে এই বৈষম্য অবসানের বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে ভাবতে হবে। তা না হলে কানাডা দিবসের মূল চেতনার প্রতি অসন্মান করা হবে। আমাদের কানাডায় অসংলগ্ন ‘কালো’ এবং ‘সাদা’ পার্থক্যের আমেরিকান কাঠামো প্রয়োগ করা উচিত নয় এবং বসতি স্থাপনকারী এবং আদিবাসীদের বিভক্তিকে শক্ত করা উচিত নয়।
ধনী দেশ হওয়া সত্বেও সুখী দেশ হওয়ার মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো উপস্থিত আছে বলেই বিশ্বে প্রথম ১০টি সুখী দেশের তালিকায় কানাডার নাম আছে। যার যা আছে তা নিয়েই কানাডার মানুষ সন্তুষ্ট। তাদের ভাবভঙ্গিতেই তা প্রকাশ পায়। আহামরি কোনো চিন্তা নেই। অর্থের প্রতিযোগিতা নেই। এক দিনে কোটিপতি হওয়ারও স্বপ্ন নেই। আজকের দিনটি ভালো যাক এটিই তাদের জীবনদর্শন। সত্যনিষ্ঠাই কানাডার উন্নয়নের কারণ। কানাডা অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভুত অগ্রগতি সাধন করেছে। কানাডা এখনো একটি অসীম সুযোগ ও অপার সম্ভাবনার দেশ। এখানে যে কেউ চাইলেই তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। এজন্য চাই ধৈর্য ও অধ্যাবসায়।

তবে মনে রাখতে হবে এই আমাদের এই নতুন দেশটির প্রতি আমাদেরও অনেক দায়ীত্ব কর্তব্য রয়েছে। দেশের প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য প্রত্যেক ধর্ম বিশ্বাসের একটি অংশ। যখন আমি কানাডাকে আমার দেশ হিসেবে বেছে নিয়েছি, তখন এটা আমার দায়ীত্ব এই নতুন দেশের প্রতি অনুগত থাকা, নাগরিক সমাজের একজন ভাল সদস্য হওয়া, কানাডিয়ান মুল্যবোধ ও সংস্কৃতি মেনে চলা ও এর প্রসার ঘটানো, কানাডিয়ান স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকা।
লেখক : কবি ও গল্পকার