ভজন সরকার : (১ম অংশের পরে)
মোখলেস সাহেবের সঙ্কেত পেয়ে সুশীলবাবু আমাকে তার বসার ঘরে ডাকলেন। সুশীলবাবু প্রচন্ড ধরিবাজ মানুষ। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলেন যে, আমি আসলেই হিন্দু ধর্মের লোক।
জিজ্ঞেস করলেন, “দাদা কি আজ এখানেই থাকবেন নাকি নাইট কোচে অন্য কোথাও যাচ্ছেন?”
আমি আজ রাত এখানেই থাকার ইচ্ছে ব্যক্ত করলাম। বললাম, “আগামীকাল বালুরঘাট যাবো। পরের দিন শিলিগুড়ি।”
সুশীলবাবু বললেন, “আমার এখানেই থাকতে পারেন। এক রাতে থাকা-খাওয়া বাবদ হোটেলের চেয়ে বেশি কিছু পরবে না।”
আমি না-চাইতেই মোক্ষম মওকা পেয়ে গেলাম। সুশীলবাবুর বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হলো। আমি থাকা-খাওয়ার জন্য সমস্ত টাকাই পরিশোধ করে দিলাম। দোতলার একটা ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা। ঘরের সাথেই এটাচড বাথরুম। স্নান করে বিশ্রাম নিচ্ছি। রাতে ঘুম হয়নি। সারাদিন প্রদীপ আর মোখলেস সাহেবের সাথে সীমান্তের গ্রামে ঘুরেছি।
সাংবাদিকতার এই এক আশ্চর্য নিয়ম। সংবাদের খোঁজে জীবনের রিস্ক যেমন নিতে হয়, তেমনি নিজের স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল থাকে না অনেক সময়।
বিশ্রাম নিতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙলো বাইরের শব্দ। নারী আর শিশু কন্ঠের আওয়াজ পেয়ে বেরোলাম। দরজার ডান দিকে তাকিয়েই দেখি বড় করিডোরের এক পাশে অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর। আসলে সুশীলবাবু ছোটোখাটো একটা আবাসিক হোটেল খুলেছেন। আমার মতো অনেকেই সুশীলবাবুর এখানে থাকেন। আমাকে যেমন বলেছেন, প্রত্যেককেই একই কথা বলেন। অবৈধ সীমান্ত পারাপারের সাথে সাথে আরেকটা নিরাপদ নিশ্চিত আয়ের উৎস।
রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হলো। সুশীলবাবু বøক পঞ্চায়েতের সদস্য। তাই পার্টির কাজে যাবেন। আজ আর কথাবার্তা হবে না। সারা রাতের বাস জার্নি এবং সারা দিনের ক্লান্তি। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম আবারও। আবার ঘুম ভাঙলো পায়ের শব্দে। করিডোর দিয়ে অনেক মানুষের আনাগোনা। হাতের ঘড়িতে দেখলাম রাত তখন দু’টো।
হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে কথা বলছে কিছু মানুষ। আমি বিছানার ওপর বসে কান পেতে রইলাম। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। শলাপরামর্শ ক্রমশ বাকবিতন্ডায় রূপ নিচ্ছে। গলার স্বর এক সময় উচ্চকন্ঠ হলো। কথা শুনে সহজেই বোঝা যাচ্ছে সবাই বেসামাল। আমি ব্যাগ থেকে ছোট টেপ-রেকর্ডারটা বের করলাম। মোবাইল ফোনেও রেকর্ড করা যেত কিন্তু টেপ-রেকর্ডারকেই নিরাপদ মনে হলো। প্রায় আধা ঘন্টা পর আবার সব কিছু শুনশান। আমি খুব যতœ করে টেপ-রেকর্ডার সরিয়ে রাখলাম।
আগামীকাল সকালে কত দ্রুত বালুরঘাট গিয়ে সাংবাদিক মনি’দার সাথে যোগাযোগ করা যায় সেই দুঃশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুম হলো না।
খুব ভোরে উঠে জানালা দিয়ে দেখলাম সুশীলবাবু পায়চারি করছেন। আমিও নেমে এলাম দোতলা থেকে। সুশীলবাবুকে বললাম, “দাদা, প্রদীপ আর মোখলেস সাহেবের ব্যাপারটা ফেরার পথে ফাইনাল করি?”
সুশীলবাবু খুব চালাক মানুষ। নিজে উপযাচক হয়ে কথা বাড়ালেন না। ভাবখানা এমন যে, এ সব সীমান্ত পারাপারে তিনি তেমন আগ্রহী নন। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে আধাঘন্টা পরেই বালুরঘাটের বাসে উঠে পড়লাম।
হিলি সীমান্ত থেকে বালুরঘাট তেমন দূরত্ব না। কিন্তু একটু পরপর চেক পোস্ট। একবার চেক পোস্টে থামলে দশ-পনের মিনিট সময় লাগে। আপাত মনে হতে পারে অনুপ্রবেশ আর চোরাচালানি ঠেকাতে বড় তৎপর। কিন্তু কাল রাতে সুশীলবাবুর বাড়িতে যা শুনলাম, তা থেকে বোঝা যায় এ সমস্ত কিছুই ব্জ্র আঁটুনি ফস্কা গেড়ো ছাড়া আর কিছু নয়। এই সীমান্ত রক্ষীরাও জানে অবৈধ অনুপ্রবেশ আর মাদক দিনের বেলায় এই গণপরিবহনে চলাচল করে না। সে সবের জন্য নির্দিষ্ট কিছু রুট আছে। সীমান্তের দু’পারে তল্লাশির নামে যা হয়, তা আসলে সব লোক দেখানো।
দুপুরের আগেই বালুরঘাট পৌঁছে মনি’দাকে ফোন দিলাম। আগে থেকেই প্রেস ক্লাবের গেইস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা ছিল। বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রেস ক্লাবে যেতে যেতেই গতরাতের কথা বললাম। রুমে ঢুকেই টেপ-রেকর্ডারে গতরাতের কথোপকথন শোনালাম মনিদাকে। মনিদা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন।
মনি’দা বলতে শুরু করলেন, “আমরা ক’মাস থেকে বাঘাবাঘা সাংবাদিক যে ঘটনার পেছনে ছুটে ঘাম ঝরাচ্ছি, তুমি মশাই এক রাতেই সে চক্রের সন্ধান পেয়ে গেলে? আজকে রাতের মধ্যেই বালুরঘাটের পুলিশ সুপারের মাধ্যমে এই চক্রকে ধরার ব্যবস্থা করাতে হবে।”
গেইস্ট হাউজটি মোটামুটি ভাল। একটু বিশ্রাম নিয়ে ক্যামেরার ব্যাগ আর টেপ-রেকর্ডার নিয়ে বের হলাম। বেরোনোর আগে মনিদার পরামর্শেই গতরাতের টেপ-রেকর্ডারের কথোপকথনের আরেকটা কপি করে নিলাম। তারপর ছুটলাম পুলিশ সুপারের অফিসে।
সারাদিন মনি’দাকে নিয়ে পুলিশের অফিসে দৌঁড়ঝাপ শেষে রাতে আবার বালুরঘাট প্রেস ক্লাবের রুমে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘুম ভাঙলো সকাল দশটায় মনিদা’র দরজা ধাক্কায়। দরজা খুলতেই মনি’দার উল্লসিত হাসি, “আরে ভাই, করেছো কী? তোমাকে তো কেউ টেলিফোনে পাচ্ছেই না। তুমি কী টেলিফোন বন্ধ রেখেছো?”
ঘুম চোখে টেলিফোনের সুইচ অন করেই দেখলাম অসংখ্য মিস কল। আমি একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। “আসলে ব্যাপার কী বলুন তো,, মনিদা”।
মনিদা হাতে থাকা লোকাল পেপারের বিশেষ সংখ্যা বের করে আমাকে পড়তে দিলেন। পত্রিকার পাতা খুলতেই দেখি বিশাল সাইজে আমার ফটো প্রথম পাতার লিড নিউজ চার কলাম জুড়ে।
“সীমান্তের নোম্যান্স লাইনের ধানখেতের মাটি খুঁড়ে মা-মেয়ের লাশ উদ্ধার”। আমার ছবির পাশে লিড নিউজ “অবশেষে ভারতী-আশালতা নিখোঁজের রহস্য ভেদ করলেন বাংলাদেশের সাংবাদিক”। আমাকে বিস্মিত হতে দেখে মনিদা আমার হাত থেকে পত্রিকাটি নিয়ে পড়তে লাগলেন।
“ গতকাল বিকেলে বালুরঘাটের পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে এবং ভারতীয় বর্ডার গার্ডের সহায়তায় বাংলাদেশ ভারত সীমান্তের নোম্যান্স লাইনে অবস্থিত ভারতীয় অংশের ধানখেতের মাটি খুঁড়ে দু’টো লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশ দু’টো গত তিন মাস আগে সীমান্ত পারাপারের সময় নিখোঁজ বাংলাদেশী নাগরিক ভারতী দেবী এবং তার ১০ বছরের মেয়ে আশালতার লাশ বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। হিলি সীমান্তের ব্যবসায়ী সুশীল পান্ডের বাড়ির জুয়ার আড্ডার কথোপকথনের টেপ-রেকর্ড শুনে পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সুশীল পান্ডের লোকজন হতভাগা মা ও মেয়ের হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে।
হত্যাকারীরা আরো স্বীকারোক্তি দেয় যে, হত্যার আগে সুশীল পান্ডের বাড়িতেই মা ও মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়। হত্যার পরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতের কাঁটাতারের বাইরে নোম্যান্স লাইনের এক ধানখেতের জমিতে মা ও মেয়ের লাশ পুঁতে রাখা হয়। কাঁটাতারের গেইট একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্থানীয় লোকজনদের জন্য খুলে দেওয়া হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ করা হয়। কিভাবে এই কাঁটাতারের গেইটের ভিতর দিয়ে দু’টো লাশ বাইরে নেওয়া হলো পুলিশ তা তদন্ত করে দেখছে।”
মনিদা বালুরঘাট এক্সপ্রেসের পাতা থেকে আবার পড়তে শুরু করলেন,
“এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ঢাকা জেলার ধামরাইয়ের বাসিন্দা ভারতী দেবীকে রেখে তার স্বামী নিমাইবাবু ভারতে চলে আসেন। পরে ১০ বছরের মেয়ে আশালতাকে নিয়ে অবৈধ পথে ভারতী দেবী স্থানীয় দালাল চক্রের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করার সময় মা ও মেয়ে নিখোঁজ হয়েছেন মর্মে ভারতে অবস্থানরত তাঁদের আত্মীয়স্বজন থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ভারত ও বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি হলেও ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারছিলেন না দুই দেশের পুলিশ প্রশাসন। বাংলাদেশের সাংবাদিক রজত চৌধুরীর সফল অনুসন্ধানের মাধ্যমে অবশেষে এই দুঃখজনক ঘটনার রহস্যভেদ হলো। ময়নাতদন্ত শেষে মা ও মেয়ের লাশ দু’টো নিহত ভারতী দেবীর স্বামী নিমাইবাবুর কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে।”
এই পর্যন্ত পড়ে মনিদা আমার দিকে তাকালেন। আমি ভাবলেশহীন। আমার চোখে তখনো ভারতী দেবী আর তার ১০ বছরের মেয়ে আশালতার গলিত লাশের কল্পিত ছবি। আমি নিজেও চাই নি এভাবে এই চাঞ্চল্যকর নিখোঁজ রহস্যের অবসান হোক। আমি ভাবছিলাম, আমার তথাকথিত সফলতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েও যদি হতভাগা মা ও মেয়ের বেঁচে থাকার সংবাদটা পেতাম? এতো বছর সাংবাদিকতা করেও সফল সাংবাদিক কিংবা সাংবাদিকের সফলতা জিনিসটা আসলে কী তা বুঝলাম না। তবে কি সব সাংবাদিকের সকল সফলত্রা সাথেই এমন মর্মন্তদ কাহিনি লুকিয়ে থাকে? (শেষ)
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা।)