ভজন সরকার : (১)
অফিস থেকে এসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছি। হিলি সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলা। হিলি স্থল বন্দর। আন্তর্জাতিক সীমান্ত। নো ম্যান্স লাইনের এক পাশ ঘেঁষে বাংলাদেশের রেললাইন। অনিয়মিতভাবে যাত্রীবাহী লোকাল ট্রেন চলে। ট্রেন লাইন পার হলেই ভারতীয় সীমান্ত পিলার। রেললাইনের দু’পাশে বাঁশের দন্ড ফেলে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার হয়। স্থল সীমান্ত দিয়ে এপার-ওপার হওয়া দু’দেশের যাত্রীরা বাঁশের ব্যারিকেডের এক পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পারাপার হয়। দু’পাশে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষীরা দাঁড়িয়ে। পাসপোর্ট দেখিয়ে ইমিগ্রশেনের ঘরের দিকে যেতে হয়।
ঢাকা থেকেই ভেবে এসেছিলাম সকালটা বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার কয়েকটা গ্রাম ঘুরে দেখব। স্থানীয় প্রতিনিধি এনায়েত করিমের টেলিফোন নম্বর নিয়ে এসেছি। ভেবেছিলাম বাস থেকে নেমেই এনায়েতকে টেলিফোন করবো। এনায়েত বাসস্ট্যান্ডে এলে সকালের নাস্তা করে দু’জনে ঘন্টা পাঁচেক ঘুরবো। তারপর দুপুরের দিকে সীমান্ত পার হয়ে ওপারের এসাইনমেন্ট।
ভারতের ওপাশে হিলি সীমান্তে রাত্রি যাপন কতটুকু নিরাপদ সে দুশ্চিন্তা অবশ্য হয়েছিল। এ নিয়ে কারো সাথে পরামর্শ করি নি ইচ্ছে করেই। তবে একজনের নাম সংগ্রহ করেছিলাম সুশীলবাবু। সীমান্তে সুশীলবাবুর লোক বললেই নাকি হয়ে যাবে। নির্দিষ্ট লোকজন সুশীলবাবুর বাড়িতে নিয়ে যাবে। এ কি শুধুই গাল-গল্প নাকি বাস্তব! এর সত্যাসত্য জানার জন্যই হিলি সীমান্তের ওপারে কারো সাথে যোগযোগ করিনি। তবে দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা শহর বালুরঘাটের সাংবাদিক সমিতির নেতা মনীন্দ্র রায়ের সাথে কথা বলেছি।
মনি’দার পূর্ব-পুরুষ ’৪৭-র দেশভাগের সময়ে পূর্ববংগ থেকে ওপারে চলে গেছে। তাই আন্তরিকতা এখনো অকৃত্রিম। একবার পরিচয়েই আপনজনের টান অনুভব করা যায়।
মনি’দার সোজাসাপ্টা উত্তর, “তুমি শুধু জানিয়ে রাখবে কবে আসবে, কতদিন থাকবে। বাকীটুকু আমার উপর ছেড়ে দাও।”
মনি’দার কথায় আশ্বস্ত হয়েই হিলি সীমান্তে যখন পৌঁছুলাম তখন সকাল ৭টা। হাকিমপুর থেকে হিলি সীমান্তের দিকে যখন বাস চলছিল, তখন সূর্য উঁকি দিয়েছে দিগন্ত রেখায়। সীমান্তের কাঁটাতারগুলোতে আটকে থাকা শিশিরের উপর ভোরের প্রথম রোদ চিক্চিক করছে। দূরে কুয়াশায় মোড়া গ্রামগুলো একটু একটু করে জেগে উঠছে। সীমান্তের কাঁটাতার চোখ এড়িয়ে গেলে গ্রামগুলো কোন্ দেশের তা চিহ্নিত করা সত্যি কষ্টসাধ্য।
ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নাইট কোচ বাংলাদেশের হিলি সীমান্ত স্থল বন্দরের নির্দিষ্ট স্থানে থামলো। সবগুলো নাইট কোচেরই নিজ নিজ কাউন্টার আছে। খাবারের ও বিশ্রামের জায়গা আছে। অন্য সবার সাথে আমিও বাস থেকে নেমে পড়লাম।
বাস নিচে নেমে আসতেই একজন বললো, “স্যারের ভিসা কি এক নম্বর?”
আমি মাথা নাড়লাম। একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখেই সামনে পা বাড়ালো লোকটি। আমার সামনে দাঁড়ানো যাত্রীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে লাগলো।
আমি শুনতে পেলাম যাত্রীদের সাথে কথোপকথন, “দাদা, ভিসা এক নম্বর হলেও অনেক ঝামেলা আছে। ফর্ম ফিলাপ, ইমিগ্রেশনের ইন্টারোগেশন, কাস্টমসের ঝামেলা সব কিছু আমরাই করে দেব। পাসপোর্ট প্রতি পাঁচ শ’ টাকা করে দিবেন। সকাল সাড়ে ন’টায় অফিস খুলবে। এখন বিশ্রাম নিন, ফ্রেশ হোন। আমাদের লোকই সময় মতো আপনাদের নিয়ে যাবে ইমিগ্রেশনে।”
ভিসা আবার দুই নম্বর হয় নাকি? বেশ কৌতুহল নিয়ে লোকটিকে ডাক দিলাম। বললাম, “আমার এক আত্মীয় এসেছে ওর ভিসা পাসপোর্ট কিছুই নেই। এখন কিছু করে দেওয়া যাবে কি?”
আমার কথা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলাম না। লোকটি ইশারা দিয়ে থামিয়ে দিল, “ঠিক আছে ভিতরে গিয়ে নাস্তা করেন, ফ্রেশ হোন। আমি আপনার সাথে কথা বলবো পরে। আমার নাম প্রদীপ। অন্য কারো সাথে এ নিয়ে আর আলাপ করবেন না। বলা তো যায় না বিপদে ফেলতে পারে।”
প্রদীপকে দেখে আমার বেশ বিশ্বস্তই মনে হলো। “বিসমিল্লাহ পরিবহন”-এ এসেছি। বাসের মালিক এক ধর্মীয় মৌলবাদী দলের ডাক সাইটে নেতা। তাহলে প্রদীপকে কেনো নিযুক্ত করে রেখেছে? প্রদীপের নাম শুনে তো হিন্দু বলেই মনে হলো। সবাই প্রদীপ’দা প্রদীপ’দা বলেই ডাকছে। বাসের যাত্রীদের অধিকাংশই হিন্দু। সে জন্যেই কি এক হিন্দু কর্মচারী নিয়োগ করে ব্যবসায়িক বিশ্বস্ততা বাড়িয়েছে মালিক পক্ষ? অর্থ কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য এমন এক জিনিস যেখানে ধর্ম কোনো বাধা মানে না।
আমি অপেক্ষা করছি প্রদীপের জন্য। প্রদীপ আমার কথিত আত্মীয়কে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই বর্ডার পার করে দেবে। আমি কী ভেবে স্থানীয় প্রতিনিধি এনায়েত করিমকে আর ফোন দিলাম না। প্রদীপ বাসের অধিকাংশই যাত্রীর পাসপোর্টই সংগ্রহ করেছে। তাদের ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এনে দেবে। প্রদীপ বাসের কাউন্টার সংলগ্ন অফিসে পাসপোর্টগুলো নিয়ে ভিতরে গেল। যাত্রীরা নিশ্চিন্তে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করে সকালের খাবারের লাইনে দাঁড়ালো।
একটু পরেই প্রদীপ এলো, “স্যার আপনি তো বলেছিলেন আপনার এক আত্মীয়কে পার করে দিতে হবে। উনার কি পাসপোর্ট আছে? ভিসা না হলেও চলবে কিন্তু হাতে পাসপোর্টটা থাকলে সোজা চলে যাবে ওপারে। আমি সুশীলবাবুকে বলে দেব। উনি রিসিভ করে বালুর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। এতে টাকা একটু কম লাগবে।”
আমি বললাম, “কিন্তু পাসপোর্ট তো”
“আরে স্যার, প্রোব্লেম নাই। কিছু না থাকলেও পার করে দেব। তবে টাকা লাগবে আর দিনের বেলা তো হবে না। রাতে এক ফাঁকে পাঠিয়ে দেব।”
আমি বললাম, “আমার আত্মীয় তো সাথে নেই। উনি কিন্তু মহিলা। একা যাবে। পারবেন তো?”
প্রদীপ একটু সতর্ক হয়ে গেল মনে হচ্ছে। বললো, “স্যার এ কাজে একটু রিস্ক আছে। টিকটিকি তো লেগেই থাকে। তাছাড়া দুই দিকেই ম্যানেজ করতে হয়।”
আমি প্রদীপের ভয় কাটাতে বললাম, “আমি ধামরাই থাকি। ইটের ভাটা আছে। কিন্তু আমার ইটের ভাটার এক হিন্দু মহিলা । সাথে এক বাচ্চাও আছে বছর পাঁচেকের।”
প্রদীপ একটু পিছু হটলো, “নম্বর কেস না তো?”
“না, না। গরীব হিন্দু মহিলা স্বামী ভারতে চলে গেছে কেইস কায়দা খেয়ে।” আমি মনের মাধুরী মিলিয়ে গল্প বানালাম।
“ঠিক আছে দাদা। এ ক্ষেত্রে আমাদের মোখলেস ভাইকে সাথে নিতে হব।” প্রদীপ হঠাৎ করে স্যার থেকে দাদা সম্বোধন করলো।
আমিও বললাম, “ঠিক আছে। আমি ভারতে যাব আজ। ফিরবো দিন সাতেকের মধ্যেই। কিন্তু কথাবার্তা একটু পাকা করে গেলে ভালো হতো। মোখলেস ভাইয়ের সাথে কথা বলতে পারলে একটু ভালো হতো।”
প্রদীপ কথা দিল। যাত্রীদের ইমিগ্রেশন-কাস্টমস করে দিয়েই আমাকে মোখলেস ভাইয়ের সাথে কথা বলিয়ে দেবে। মোখলেস ভাই স্থানীয় সরকারী পার্টির থানা পর্যায়ের নেতা। ধনাঢ্য লোক। আয়ের দৃশ্যত কোনো উৎস নেই। সীমান্তে লোক পারাপারই একমাত্র আয়ের উৎস বলে সবাই জানে। প্রশাসনেও দারুণ খাতির মোখলেস ভাইয়ের। ওপারের পঞ্চায়েত নেতাদের সাথেও বেশ যোগাযোগ।
আমার কল্পিত কেইসটা মোখলেস সাহেবকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলাম। আমি মোখলেস ভাই আর প্রদীপকে সাথে নিয়ে স্থল বন্দর থেকে মাইল খানিক দূরের এক সীমান্তবর্তী গ্রামে পৌঁছুলাম। তখন দুপুর ১২টা গড়িয়ে গেছে। মোখলেস সাহেবের বাড়ির সামনে এক পাকা দালান। মসজিদ। মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। আমাকে আর প্রদীপকে বাইরের ঘরে বসিয়ে মসজিদে গেল মোখলেস সাহেব।
প্রদীপ আমাকে বলছে, “দাদা আপনার তো টাকার তেমন অভাব নেই। কেইসটা একটু জটিল। তাছাড়া নিরাপত্তার একটা ব্যাপারও আছে। আপনার নিজের মানুষ। তাই কেইসটা যেন ভারতী-আশালতার মতো না হয়।”
“ভারতী-আশালতা আবার কী?” আমি ঔৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই মোখলেস ভাই ঘরে ঢুকলো। প্রদীপ ইশারায় ব্যাপারটা চেপে যেতে বললো।
মোখলেস সাহেব প্রার্থনা করে পাক-পবিত্র হয়ে এসেছে বোঝা গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “প্রদীপ যেহেতু কেইসটা নিতে বলছে, তাই নিচ্ছি। ইদানিং ওই নিউজ পেপারওয়ালারা এমন করে পিছু নিচ্ছে। আমার স্ত্রী-সন্তান সেজে আসতে হবে আপনার আত্মীয়াকে। চেহারা সরুত ভালো আর স্মার্ট হলে নিকাব লাগবে না। আমার বিবি হিসেবে আসবে। ওদিন রাতেই সুশীলদার লোকের কাছে পৌঁছে দেব। বাকীটুকু দাদাই দেখবে। আর দুই দেশের ব্যাপার তো, তাই টাকা একটু বাড়িয়ে দিতে হবে।”
আমি সাহসে ভর করে বললাম, “সুশীলদার সাথে আমারও একটু জানাশোনা আছে। হুন্ডির ব্যাপারে আগের বার কথা হয়েছিল। সুশীলদাকে আমিও বলতে পারি, আপনারা যদি সম্মত থাকেন।”
প্রদীপ আর মোখলেস সাহেব নিজেদের মধ্যে আকার-ইংগিতে কিছু কথা চালাচালি করলো। বুঝলাম, আমাকে বিশ্বস্তই মনে করছে ওরা। স্কুল জীবনে যে অভিনয়টা শিখেছিলাম সাংবাদিক হয়ে সেটা আর ঝালিয়ে নিতে পারি নি। এবার মনে হলো সফলই হলাম।
ঠিক করা হলো আমি নিজেই ভারতে সুশীলবাবুর সাথে কথা বলবো। আমি বললাম, “আপনারা যদি একটু টেলিফোন করে বলে দিতেন।”
প্রদীপ বললো, “না, না টেলিফোনে এসব আলাপ নিরাপদ না। আমাদের সঙ্কেত পাঠানোর কিছু জিনিস আছে। আমরা পাঠিয়ে দেব। আপনি দু’টো জিনিস দেখালেই সুশীলদা বুঝবে আপনাকে আমরা পাঠিয়েছি।”
মোখলেস সাহেব বলল, “প্রদীপ ঠিকই বলেছে। সেবার টেলিফোন করতে গিয়েই তো ধরা পড়লাম। মাল ঠিকই পৌঁছে গেল। মাঝখানে টেলিফোন কল ফাঁস হয়ে কী বিপদটাই না হচ্ছিল। হইচই হলো। ব্যবসা-বানিজ্য লাটে উঠার জোগার।”
আমি বললাম, “মাস দুয়েক আগে ভারতী-আশালতার কেইসটা পেপারে বেরিয়েছিল, ওটার কথা বলছেন?”
“আপনিও জানেন। দশ বছরের মেয়েটা ওপারে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। ওই শালা সুশীলের চ্যালারাই মেয়েটাকে পাচার করেছে কিংবা রেইপ করে মেরে পুঁতে ফেলেছে। কিন্তু সবাই বলছে এপারের দোষ। অথচ দেখেন তো, আমরা ঠিক মতোই পাঠালাম।”
আমি অনেকটা নিশ্চিত হলাম ওপারে সুশীবলবাবুর কাছেই সব খবর আছে। আমি আর সময় ক্ষেপন করলাম না। প্রদীপ আমাকে পাঁচ শ’ টাকা না নিয়েই বৈধ ভিসায় ইমিগ্রেশন, কাস্টমস পার করে ওপারে পৌঁছে দিল বিশেষ মর্যাদায়। প্রদীপের অফিস থেকে বিশেষ রঙের একটা লুংগি আর গামছা ভরে দিল।
প্রদীপ বলে দিল, “ওপারে কেউ সুশীলবাবুর লোক বললেই আপনি ‘লুংগি-গামছা’ বলবেন। ওরাই সুশীলবাবুর বাড়ি পৌঁছে দেবে। সুশীলবাবুকে এ লুংগি-গামছা দু’টো দেখালেই বুঝবে আমরা পাঠিয়েছি। তারপর আপনারা কথা বলে নিবেন। লুংগির কালার দেখেই সুশীলদা বুঝবে। ওপারের ব্যাপারটা আপনাকেই ম্যানেজ করতে হবে।”
প্রদীপের কথা মতো আমি ওপারে গিয়ে পৌঁছুলাম। সুশীলবাবুর লোকজন বিশেষ খাতির যতেœ আমাকে সুশীলবাবুর বাড়িতে যখন পৌঁছে দিল তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। এপাড়ার মন্দির থেকে ঘন্টার ধ্বনি বাজছে। দূর থেকে আজানের শব্দও। বুঝলাম মোখলেস সাহেবের বাড়ি থেকে সুশীলুবাবুদের বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। মোখলেস সাহেব আর সুশীলবাবুরা পাশাপাশি-কাছাকাছিই বাস করে। (চলবে)
(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)