অনলাইন ডেস্ক : প্রবাসীবহুল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সিলেট। পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের বিনিয়োগে অনাগ্রহের বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত। তবে গত এক-দেড় দশকে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন এনেছে পর্যটন খাত। এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট।
পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিত সিলেটে গত এক দশকে পর্যটক সমাগম বেড়েছে। ছুটির দিনগুলোয় কোনো হোটেল-মোটেলের কক্ষ খালি পাওয়া যেত না। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পর্যটন খাত।
সাধারণ ছুটি শেষে ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যান্য খাত কিছুটা সচল হলেও পর্যটন খাতে এখনো বিরাজ করছে স্থবিরতা। হোটেল-মোটেল বন্ধ, পর্যটনকেন্দ্রগুলো ফাঁকা, নেই পর্যটকদের আনাগোনা। কবে এ খাত আবার সচল হবে, তাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে ঘোর অন্ধকার দেখছেন উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তাদের মতো বিপাকে পড়েছেন পর্যটন খাতের কর্মীরাও। এরই মধ্যে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। আর বেশির ভাগকেই ছুটি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ছুটিকালীন বেতনও পাচ্ছেন না তারা। এ অবস্থায় হোটেল-মোটেলের অনেক উদ্যোক্তাই ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার কথা ভাবছেন।
সিলেটের বিভিন্ন হোটেলে কাজ করা কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মার্চ থেকেই ছুটিতে রয়েছেন তারা। মার্চের বেতন পেলেও এপ্রিল থেকে বেতন পাচ্ছেন না। সিলেটের পর্যটন খাতের ৯০ শতাংশ কর্মীই এভাবে এপ্রিল থেকে বেতনহীন অবস্থায় রয়েছেন।
সিলেটের হোটেল-মোটেল মালিকরা বলছেন, প্রতিদিন কেবল সিলেটের হোটেল-মোটেল খাতে প্রায় ৩ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সিলেটে তেমন ভারী শিল্প-কারখানা নেই। ট্রেডিং, পর্যটন আর আমদানি-রফতানিই এখানকার প্রধান ব্যবসা। এ তিন খাতের ব্যবসায়ীরাই এখন করোনার কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দ্রুত তাদের ব্যবসা সচল হওয়ারও কোনো আশা নেই।
সিলেটের পর্যটন খাতের উন্নয়নে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন হাসান মোরশেদ। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পর্যটন সেক্টরের সংকট কেটে যাবে না। কারণ মানুষের আয় কমবে। ফলে খরচ কমাবে। আগের মতো পর্যটকরা আসবেন না। এতে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে পর্যটন খাতের উদ্যোক্তাদের। এ কারণে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই করবে।
পর্যটন শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, বছরজুড়েই সিলেটে আনাগোনা থাকে পর্যটকদের। শুক্র-শনিবারসহ সরকারি বন্ধের দিনগুলোয় হোটেলগুলোয় খালি কক্ষই পাওয়া যায় না। আর ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবের সময় তো সিলেটের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় দাঁড়ানোর জায়গাই পাওয়া যায় না। এ অবস্থায় গত ঈদ আর পহেলা বৈশাখে পুরো ফাঁকা ছিল বিছনাকান্দি, জাফলং, রাতারগুল, লালাখালসহ সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র।
নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার হোটেল গোল্ডেন সিটির ব্যবস্থাপক মিষ্টু দত্ত বলেন, মার্চের মাঝামাঝি আমাদের হোটেলে কিছু গেস্ট ছিলেন। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত পুরো ফাঁকা। অথচ কর্মীদের বেতন ও ইউটিলিটি বিল দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের দেড়-দুই লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় এলাকার ইঞ্জিন নৌকার চালক সমুজ মিয়া। হাদারপাড় থেকে পর্যটনকেন্দ্র বিছনাকান্দিতে নৌকা চালান তিনি।
সমুজ মিয়া বলেন, জীবনে কখনো এ রকম বেকার হইনি। বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের আনোগোনা সবসময় লেগেই থাকে। ফলে আয় ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু তিন মাস ধরে এখানে কোনো পর্যটক আসেননি। মানুষের সাহায্য-সহায়তা নিয়ে চলতে হচ্ছে।
সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, এ সংগঠনের সদস্যভুক্ত সিলেটে প্রায় ২০০টি হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। সংগঠনের বাইরেও রয়েছে কিছু।
সিলেট হোটেল, মোটেল ও গেস্ট হাউজ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাহমিন আহমদ বলেন, তিন মাস ধরে হোটেল-মোটেলে ব্যবসা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নেবে।
তিনি বলেন, কেবল হোটেল নয়, পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে সিলেটে অনেক রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের নৌকার মাঝি, পরিবহন সেক্টর, ট্যুরিস্ট গাইড সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।
এ সংগঠনের সভাপতি সুমাত নুরী জুয়েল বলেন, সিলেটে পর্যটন খাতে প্রতি মাসে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। কবে যে এ খাত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে তাও আমরা জানি না।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের এসকেডি আমার বাড়ি রিসোর্টের পরিচালক সজল দাশ বলেন, আমার ব্যাংক লোন আছে ২ কোটি টাকা। ১১ মার্চ থেকে আমার রিসোর্ট বন্ধ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের জন্য চাপ আসছে। সব কিছু মিলিয়ে ঋণের জালে আটকে যাচ্ছি, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া বের হতে পারব না। উল্টো পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি।
লাউয়াছড়ার ট্যুর গাইড সাজু মারচিয়াং বলেন, ঈদের দুই মাস আগে থেকেই অনেকে ফোন দেন। কেউ কেউ বিকাশে অগ্রিম দিয়ে রাখেন। পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে তিন-চারজন সহযোগী রাখতে হয়। কিন্তু এ বছর কোনো পর্যটক আসা তো দূরের কথা, একটা ফোনও আসেনি।