অনলাইন ডেস্ক : করোনা সংকট দেশের চলমান রাজনৈতিক বোধের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা ও উপলব্ধি যুক্ত করবে বলে মনে করেছেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক।
তিনি বলেন, আমি আশা করি, করোনা সংকট রাজনীতির প্যারামিটারে অনেক নতুন চিন্তা ও উপলব্ধি যুক্ত করবে। আমরা যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন উৎসাহব্যঞ্জক কিছু যুক্ত করতে পারি তাহলেই নতুন পৃথিবীতে নতুন করে যাত্রা শুরু করতে পারব। করোনা হয়তো এই নতুন পৃথিবীর দ্বার উদঘাটনের ক্ষেত্রে একটা সুযোগও সৃষ্টি করেছে। আমরা রাজনীতিবিদরা যদি সেই দূরদৃষ্টি, অভিজ্ঞা ও কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিতে পারি তাহলে দেশের জন্য ভালো কিছু হবে।
সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। করোনাভাইরাস পরবর্তী নতুন পৃথিবী কেমন হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সাইফুল হক বলেন, গত কয়েক শতকে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীতে মহামারী এসেছে। এগুলোর পরবর্তী সময়ে মানুষ কিছু শিক্ষা নিয়েছে। আবার অনেক বিষয়ে শিক্ষা নেয়নি। কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার মতো বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়নি বলে এ ধরনের দুর্যোগে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার বাইরে থেকে গেছে। তাই মানুষের সুস্থতা, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো ভবিষ্যতে মুনাফালোভী সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেয়া যাবে না। এখানে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আমার দেশের রাষ্ট্রপতি যেমন চিকিৎসা পাবেন, একজন শ্রমিকও তেমনি চিকিৎসা পাবেন- এমন একটি মানবিক ব্যবস্থা যদি গড়ে তুলতে না পারি তাহলে সংকটগুলো কিন্তু ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সংঘাতের রাজনীতির অবসান চাই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে সরকার আস্থায় নেবে। দ্রুত জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন করার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি কিভাবে কার্যকর করা যায় তা ভাবতে হবে। এবার কিন্তু সেই সুযোগ সরকারের সামনে ছিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের সমালোচনা করাই শুধু বিরোধী দলগুলোর দায়িত্ব নয়। সরকারের ভুল ধরিয়ে দেয়া, বিকল্প সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাকে হাজির করা এবং সেই ভিত্তিতে তাদেরও মানুষের কাছে যেতে হবে।
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের এ যাবৎ গৃহীত পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা দেখছি শুরু থেকেই সেখানে একটা সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা ছিল। সংক্রমণকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার যে প্রয়োজন ছিল সেখানে উপলব্ধির একটা খাটতি লক্ষ করা গেছে। ৬ মাস পরেও এখনও আমরা অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতকে দূর করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, রাজনৈতিকভাবে এর দায়-দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও একটা বড় দায়-দায়িত্ব আছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও এই সময়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারেননি। সরকার সচিবকে সরিয়ে দিয়েছে, ডিজিকে অপসারণ করেছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় শুধু কয়েকজন ব্যক্তিকে পরিবর্তন করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। আমি মনে করি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ না করলে তাকে পদ থেকে অপসারণ করতে হবে। বর্তমানে সরকার হার্ড ইমিউনিটির অঘোষিত তত্ত্বে সরকার উদ্বুদ্ধ কি-না আমি সেটা জানি না। তবে এ ব্যাপারে আমার আশঙ্কা আছে। কিন্তু সেটা খুবই ভয়ানক এবং বিপজ্জনক। জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল কোনো সরকার এ ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে না।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে দেয়া দরকার ছিল। আর জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ। এটা আমরা আমাদের বাম গণতান্ত্রিক জোট থেকেও বলেছি। কারণ সব কিছুই তো মানুষের জন্য। মানুষ যদি বাঁচে তাহলেই তো উন্নয়ন থেকে শুরু করে সব কিছুর সুফল ভোগ করা যাবে। সরকার এই সময়ে অনেক মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ হ্রাস করতে পারত। আমি আশা করি, সরকারের বোধোদয় হবে। করোনা মোকাবেলায় পৃথিবীতে উদাহরণ যেগুলো আছে, সেই ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি মনে করি, সরকারের সামনে এখনও সুযোগ আছে।
করোনার মতো এতবড় সংকটেও দেশের সব রাজনৈতিক শক্তি সমন্বিতভাবে কেন কাজ করতে পারল না? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৩ এপ্রিল বাম জোট জাতীয় পরামর্শ সভার আয়োজন করেছিলাম। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোট, বাম জোটসহ যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদীদের দল ছাড়া আমরা কিন্তু সবাইকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধি শেষ পর্যন্ত আসেনি। আমরা বলেছিলাম, জাতীয় দুর্যোগকে জাতীয়ভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। সেজন্য আমাদের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করব। সেখানে সরকারের দায়িত্ব ছিল সব বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়া। সবাইকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি করা যেত। একটা পরামর্শ কমিটি দাঁড় করাতে পারত। তাহলে মানুষের মধ্যে একটা বল বা ভরসার জায়গা আসত। এমনকি সরকারের দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতাও চিহ্নিত করা সম্ভব হতো। কিন্তু বাস্তবে সরকার একলা চলো নীতি অবলম্বন করল।
তিনি বলেন, গত নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, সেখানে এবার সরকারের সামনে বড় একটা সুযোগ ছিল করোনা মহামারী ও বন্যার মতো দুর্যোগকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা, আলোচনা করা। তাহলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে প্রশ্নটা আছে, তার অনেকখানি সামাল দেয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। এক ধরনের গায়ের জোরে সব কিছু করছে। তারা মনে করেছেন যেভাবে ক্ষমতায় আছেন, সেভাবেই গায়ের জোরেই করোনাকেও মোকাবেলা করা যাবে। কিন্তু সব কিছু তো আর গায়ের জোরে করা যায় না।
সরকারের আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা প্রসঙ্গে সাইফুল হক বলেন, রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ একটা পুরনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলটি গত নির্বাচনে ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে সরকারে এসেছে। প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় এসেছে। ঐতিহ্যবাহী দল হিসেবে সরকার পরিচালনায় যে কর্তৃত্ব, নৈতিক জোর থাকার দরকার ছিল দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত নির্বাচনের পরে সেটা এখন অনেক দুর্বল। যে কারণে সরকারের কোনো কথা কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে না। আস্থার মধ্যে রাখতে পারে না। এটা আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক পরাজয়। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই দলটির শাসনামলে মানুষের ভোটের অধিকার নেই। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা বলে কবি লেখন সাংবাদিক থেকে শুরু করে অসংখ্য মানুষকে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।