সাজ্জাদ আলী : স্টেফিনি আর আমি পরস্পরের হাঁটা সঙ্গী। গত এক দশক জুড়েই হাঁটাহাঁটিতে আমরা জোটবদ্ধ। গরমকালে প্রতি সপ্তাহের একটি সকাল আমরা বনবাদাড়ে ঘুরি। শীতের মাসগুলোতে কানাডা’র সব বনপথ (ওয়াকিং ট্রেইল) বরফে ঢাকা থাকে। এ সময়ে স্টেফিনির সাথে দেখা হয় না। ফোন ও টেক্সট মেসেজে সম্পর্কটা অটুট রাখি আমরা। প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরুতেই সে নতুন নতুন বনপথের সন্ধানে তত্পর হয়ে উঠে। আজকের এই ওয়াটার ফ্রন্ট ওয়াকিং ট্রেইলটির সন্ধান স্টেফিনিই বলে দিয়েছে। পথটি নতুন, আগে কখনো হাঁটিনি। আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়েছে বটে, কিন্তু সে নিজে আসেনি। গত ৯ বছরের মধ্যে আজই প্রথম বনপথে আমি একা! করোনা’র কার্যকারণেই এমন বিচ্ছেদ উপস্থিত!
আমার এই হাঁটতে বেরোবার কারণ যতটা না স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তার থেকে শতগুণ বেশি মনের প্রশান্তি। আর সে শান্তি’র অনুঘটক যে “স্টেফিনি”, সে কথা আমি যদিওবা অস্বীকার করি; কিন্তু বিশ্বব্রহ্মান্ড তাতে সায় দেবে কেন? লেক অন্টারিও’র পাড় ঘেঁষে এই মেঠোপথটি অপরূপা! দুপাশের বৃক্ষরাজি, বুনো ঘাস, পাখির কিচির মিচির, আপনাজালা ফুল, আছড়ে পড়া জলের ঢেউ, সূর্যালোকে বর্ণিল আকাশের প্রান্তরেখা ইত্যাদি। তবুও মনটা বিষন্ন। এই মুহূর্তে বিধাতা যদি প্রকৃতির অন্য সব শোভা কেড়ে নিয়ে স্টেফিনির হাতখানা আমার কাঁধে যুক্ত রাখত; তবে কি আমি সৃষ্টিকর্তার নামে মামলা ঠুকে দিতাম?
গত এক সপ্তাহ গো ধরে বসে ছিলাম, কিছুতেই একা বেরোবো না। অনেক বুঝিয়েছি স্টেফিনিকে। দুজনের মধ্যে বিস্তর কথা কাটাকাটি, অনুরাগ, তর্ক, বিরাগের পরে তার আবেগের কাছে নত হয়েছি। সঙ্গী না হবার যে গুপ্ত কারণটি সে বলেছে, তা আমার মনের মাঝের শীতের হাওয়া ঝেটিয়ে বসন্ত-বাতাস বইয়ে দিয়েছে। পাঠক বন্ধুদের সে সমীরণের খবরটি বলবো বটে, তবে তার আগে খানিকক্ষণ হেঁটে নি।
গতরাতে সম্ভবত এখানটায় বৃষ্টি হয়েছে। সরু মাটির পথটি ভেজা, কিন্তু কাদাময় নয়। পথের দুপাশে ম্যাপল, ওক, চেস্টনাট ইত্যাদি বিশাল সব বৃক্ষ ন্যাড়া ডালগুলো নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। ডালের ডগায় ডগায় পাতার কুঁড়ি এসেছে, তবে এখনও তা কিশলয় হয়ে ওঠেনি। আর দিন দশেক বাদেই ডালপালাগুলো সবুজ পত্র পল্লবে ভরে উঠবে। তখন গাছদের দাপটে রৌদ্রজ্জ্বল দিনের দুপুরেও এ বনপথ সূর্যালোকের দেখা পাবে না। চারিদিক নিস্তব্ধ, দিনের বেলায়ও ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর পাখির কূজন শুনতে পাই। কোন জনমানব দেখছি না আশপাশে। হয়তো করোনা প্যানডিমিকের কারণে নাগরিকদের বনবাদাড়ে হেঁটে বেড়াবার বিলাসী মন নেই!
চলতে চলতে দেখি বনপথের একটি অংশে খানিকটা ফাঁকা মাঠ, বড় কোনও গাছ নেই সেখানটায়। মাঠের পুরোটা জুড়ে বাড়ন্ত ঘাস আর নানা বর্ণের বুনো ফুল। অসংখ্য পতঙ্গ আর কিছু প্রজাপতি ফুলে ফুলে গিয়ে বসছে। প্রজাপতিগুলো যেন ফুলদের ডাকপিয়ন, একটির খবর আরেকটিকে পৌঁছে দেওয়াই যেন ওদের কাজ। পথের প্রান্ত থেকে মাঠ পেরিয়ে ফুল বনের বিস্তিৃতি লেকের জলে গিয়ে ঠেকেছে। এখানকার বুনো ঘাসগুলো টসটসে ও সজীব, ফুলগুলো সব কমনীয়, জলের আছে অপার স্নিগ্ধতা। আজ এত সব সৌন্দর্য আহরণ করছি বটে, কিন্তু খরচ করতে পারছি না। এগুলো উপহার পেলে যে খুশিতে ফেটে পড়ত, সে তো আজ সাথে আসেনি!
ঘাসবন মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে জলের কিনারায় পৌঁছুলাম। মৃদুমন্দ বাতাসের কারণে স্বচ্ছ নীল জলে আজ ঢেউয়ের তেমন তেজ নেই। দক্ষিণ দিকটায় দুখানি বড় পাথরখন্ড আড়াআড়ি শুয়ে আছে। আরো ছোট ও মাঝারি সাইজের সহস্র পাথর টুকরা জলের গভীর অব্দি ছড়িয়ে আছে। জুতসই একখানা পাথরের উপরে বসে কান্তি জুড়োনোর উদ্যোগ নিলাম। সমুখে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জলরাশি। এক ঝাঁক বুনো রাজহাঁস (কানাডিয়ান গুচ) ভাসতে ভাসতে আমার ১৫/২০ ফুট দূরে এসে স্থায়ী হলো। শিশু হাঁসেরা মায়ের পিঠে চড়ছে, আবার জলে নামছে। এক জোড়া হাঁস অতি মমতায় একে অন্যের ঠোটে ঠোট ঘষছে, কখনো বা আলতো করে কামড়ে দিচ্ছে। হংসদের এই প্রণয়লীলায় করোনা’র কোনই আপত্তি নেই। ভাইরাস মশায়ের যত আক্রোশ সব মানব-মানবীর অনুরাগে!
হাঁসদের এই অন্তরঙ্গতা দেখে আমার একাকীত্বের যন্ত্রণা বহুতর হল। বিরক্ত হয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। জলের কিনারা ঘেঁষে সমান্তরালে এঁকেবেঁকে পথটি এগিয়েছে। খানিক এগুতেই বনের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটা ঠকঠক শব্দ কানে এলো। শব্দটির উ্তস খুঁজতে কান খাড়া করে পথ ছেড়ে বনের মধ্যে হেঁটে এগুলাম। কিন্তু কোথা থেকে আসছে শব্দটি? পাতাবিহীন গাছগুলোর মস্ত সব ডালে শব্দের প্রতিধ্বনি আমাকে দ্বিধায় ফেলে দিল। একবার মনে হয় শব্দটি মাথার ওপরে, আবার মনে হয় ডানে, কিন্তু হেঁটে এগুতে থাকি সামনে। এমনতর পরিস্থিতিতে সর্বদা যে আমার সহায় হয়, আজ তো আমাকে সে একা পাঠিয়েছে।
আরো মিনিট দশেকের গোলকধাঁধা পেরিয়ে দেখি মিলউড জাতের একটি উডপিকার পাখি (কাঠ ঠোকরা’র প্রজাতি) তার শক্ত ঠোট দিয়ে ঠুকে ঠুকে মোটা গাছের উঁচু ডালে গর্ত খুঁড়ছে। এটাই হবে তার এ বছরের গ্রীষ্মকালীন আবাস। এখানেই এই কাঠুরে পাখিদের প্রণয়মিলনে আরেক জোড়া পাখির জন্ম নেবে। এই গর্তটিই পরিবেশের বৈরিতা থেকে রক্ষা করবে ওদের অনাগত ছানাদের। খানিকক্ষণ কাঠ ঠুকে পাখিটি যেন কান্ত হয়ে পড়লো। হঠাত জোড়ার অন্য পাখিটি কোথা থেকে উড়ে এসে কাজে যোগ দিলো। আর প্রথম পাখিটি ফুড়–ত করে উড়াল দিলো। জগতে টিকে থাকার কি অকান্ত পরিশ্রম ওদের! ঠকঠক শব্দে যেন বন-মাতাকে ওদের আগমনী বার্তা জানাচ্ছে।
ঠোটের ডগায় পোকামাকড় জাতীয় কিছু একটা খাবার নিয়ে প্রথম পাখিটি ফিরে এলো। দ্বিতীয় পাখিটির পাশে বসে যেন বললো, কাজ পরে হবে; এসো আগে খেয়ে নি! কাঠ ঠোকরা দুটি একে অন্যের পাখার মধ্যে পাখা গুঁজে পরম মমতায় ঠোটে ঠোটে খাবারটুকু ভাগ করে খাচ্ছে। অপূর্ব সে সহমর্মীতা! এই পরম মিলনের উপযুক্ত ক্ষণটি ধারণ করবো বলে ঘাড়ে ঝোলানো বেল্ট থেকে ক্যামেরাটি ছাড়িয়ে তাক করে বসে রইলাম। এমন একটি ছবিই হতে পারে আমার হাঁটা বন্ধু’র জন্য শ্রেষ্ঠতম উপহার।
আমি কি জানিনে যে, আমাকে একা ওয়াকিং ট্রেইলে পাঠিয়ে স্টেফিনি মনোকষ্টে আছে। করোনাকালীন স্যোশাল ডিসট্যান্সিং এবং ফিজিক্যাল ডিসট্যান্সিং আমাদেরকে সঙ্গ ছাড়া করেছে। উপায়হীন আমরা, স্বাস্থ্য সচেতন তো থাকতেই হবে। তবে নানান কৌশলে আমি তাঁকে আশ্বস্ত রাখার চেষ্টা করেছিলাম যে, আমরা “৬ ফুট দূরত্ব” রেখেই হাঁটব। কিন্তু তাঁর সেই একই কথা, বনবাদাড়ে গিয়ে তোমার সাথে “ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স” রাখার অভ্যাস তো আমার নেই!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)