হোসনে আরা জেমী : “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” কবি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে টরন্টোতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাচনিক আয়োজিত ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান। অতিথি ছিলেন ড. পবিত্র সরকার এবং আমাদের প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী।

শঙ্খ ঘোষ (জন্ম, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ ) একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞও। তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কবিতাগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার “সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার” লাভ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘এ আমির আবরণ’, ‘উর্বশীর হাসি’, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ ইত্যাদি। সাহিত্যের ক্ষেত্র ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনায় নিয়মিত প্রতিক্রিয়া জানানো ও পথে নামার মধ্য দিয়ে শঙ্খ ঘোষ আজও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বিবেকের ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছেন।

আমাদের এই সময়টাকে সবদিক দিয়ে সর্বার্থে জড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁরই কথায়, ‘শিকড় দিয়ে আঁকড়ে’ আছেন। তাই কবি শঙ্খ ঘোষ-এর কোনও বিশেষ পরিচয় হয় না। তাঁর অস্তিত্বই তাঁর পরিচয়। বাংল কবিতায় প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি তৈরি করে নিয়েছেন এমন এক পথ, যে-পথে স্বল্প যাত্রী, যে পথে সামান্য আলো জ্বলে। সমালোচনায় নিয়ে এসেছেন সর্বজনবোধ্য এক জ্ঞানচর্চার দিশা, সংক্রামকভাবে বারবার সাড়া দিয়েছেন সংকট সময়ে।
ঘুমে জাগরণে চেতনায় হৃদয় জ্বালিয়ে রাখে শঙ্খ ঘোষের কবিতা। তিনি সাঁকো বাঁধার কথা বলেছেন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে সমাজ সচেতনতা। শান্ত কবির কলমে উঠে এসেছে প্রতিবাদের বারুদ। তাঁকে আমরা পাই প্রেমে ও অপ্রেমে, বিক্ষিপ্ত শাণিত তলোয়ারে।
ড. পবিত্র সরকারের কথায় উঠে আসে ১৯৪০ সালে কবিতার দিক বদলের কথা। চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতায় স্পষ্টই দুটো ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। একদিকে ছিল নিও রোমান্টিক কবি অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহরা। অন্যদিকে কবিতায় দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে আসতে শুরু করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়রা। পঞ্চাশের দশকের কবিরা মানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায়, তুষার রায়-রা এই দুই ধারাকেই উড়িয়ে লিখতে এলেন আত্মাখুঁড়ে। স্বাধীনতা, দেশভাগের শূন্যতা, ব্যক্তিগত বিপন্নতাবোধ তাঁদের নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে গেল।

ছন্দে ও কবিতায় কী অসাধারণ মিল, তা আমরা পাই কবির কবিতায়। তিনি কবিতাকে পরিচর্যা করে গেছেনে। তাঁর জীবনদর্শন ছিলো ভিন্ন। শুধুমাত্র প্রকৃতি কিংবা প্রেম নয়, তাঁর লেখনীতে জীবন্ত হয়ে উঠত রূঢ় বাস্তব। রাজনীতি নিয়েও সরব ছিল তাঁর কলম। ১৯৫২ সালে যমুনাবতী কবিতায় স্বাধীনতার পরে কোচবিহারে খাদ্য আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানো এবং কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ লেখেন, ‘যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে, বিষের টোপর নিয়ে।’ কবিতার মাধ্যমে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এ কোন দেশে আমরা অবস্থান করছি।’

বাবরের প্রার্থনা তাঁর বিখ্যাত কবিতা। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে কখনো অবহেলা করেননি। রাজনীতির বাহিরে থেকে মানবিক ট্রাজেডি যখন ঘটে এই উপমহাদেশে নন্দীগ্রাম দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক দিকগুলো দেখতেন। সুন্দরবনের দাঙ্গা, স¤প্রীতি, “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” এই উপমহাদেশের ওপরেই দাঙ্গা থেকে উনি লিখেছেন।
“সহজ যন্ত্রণাহীন এক মৃত্যুর স্বপ্ন দেখি” এই তো কবির চাওয়া। শেষজীবনে কবি ইকবাল তার প্যাশান হয়ে উঠেছিল। মধ্যযুগের মুসলমান কবিরা কি বলেছেন এসব নিয়েও তাঁর ভাবনা ছিল। নিজের সংস্কৃতির দেওয়াল টপকে অন্য সংস্কৃতির দেয়ালে ডুকে পড়েছেন। এই জন্য শঙ্খ ঘোষ আলাদা, গোটা মানুষ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার ঈশ্বর, তাঁকে ভর করেই তিনি এগিয়ে গিয়েছেন।

বেড়ার ওপারে কি থাকে? থাকে মৃত্যুর ডাক তবুও কবিরা কবিতা লেখে-
“যিনি কবির কবিতা আবৃত্তি করছেন তিনিই সেই কবিতার স্রষ্টা।” বলেছেন ড. পবিত্র সরকার এবং এই কথাকে সমর্থন করেন কবি আসাদ চৌধুরী। এইটা প্রত্যেক আবৃত্তিশিল্পীদের জন্য পরম পাওয়া।

কবি আসাদ চৌধুরীর আলোচনায় উঠে আসে কবির মানবিক দিক। কথা বললেন কবির গদ্য নিয়ে। যখন “আয় বেঁধে বেঁধে থাকি” এই কথাটি আজ খুব প্রয়োজন। আসুন আমরা আজ বেঁধে বেঁধে থাকি। আমরা কবিতায় জীবন ও যাপনের বিশ্বায়ন আঁকি!
হোসনে আরা জেমী : কবি ও বাচিক শিল্পী, টরন্টো, কানাডা