মুরশাদ সুবহানী : বঙ্গসন্তান কবি ও সাংবাদিক আবদুল গনি হাজারী। তাঁর কয়েকটি কবিতা নিয়ে আলোকপাত করার আগে সবাই কমবেশী তাঁর সম্পর্কে জানেন বলেই বিশ্বাস করি তারপরও তাঁর পরিচয় দিয়ে নেওয়া ভাল।বাংলাদেশের একটি ছোট জেলা শহরের নাম পাবনা। এই জেলাটি ছোট হলেও শিল্প-সাহিত্যে খ্যাতি রয়েছে।পাবনায় জন্মেছেন অনেক গুণিজন। এই জেলাকে তাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন, শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীতে।
কবি আবদুল গনি হাজারী তাদেরই একজন। পাবনার সুজানগরের (বর্তমানে উপজেলা) এই মাটির সন্তান কবি আবদুল গনি হাজারী নয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, ১৯২১, ১২ জানুয়ারী বেঙ্গল প্রেসিন্ডেসি বৃটিশ শাসিত ভারতে পাবনা জেলা এর অন্তর্ভূক্ত হয় এই জেলার মধ্যে সুজানগর রয়েছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৬, ১৫ সেপ্টেম্বর।
প্রতিথযশা এই সাংবাদিক ও আধুনিক কবিতার একজন স্বনামখ্যাত কবি আবদুল গনি হাজারী।
হাজারী তাঁদের পদবী। তাঁর পূর্ব পুরুষ লাখপতি হওয়ার পর বাঁশের আগায় বাতি জ্বালিয়ে দিলে বংশানুক্রমে তাঁরা হাজারী পরিবার হিসেবে পরিচিত হ’ন।
কবি আবদুল গনি হাজারী যুগ স্রষ্টা না হলেও খ্যাতিমান কবিদের একজন। তাঁর কবিতার ভাব-ভাষা- শৈলী অপূর্ব। তাঁকে করে তুলেছে উচুঁমানের কবি-সাহিত্যিক।
এই কবি ও সাহিত্যিকের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী নিরবে-নিভৃতে পেরিয়ে যায়।
তাঁর কয়েকটি কবিতার উপর আলোকপাত করা আগে কর্মময় জীবন উল্লেখ করা আবশ্যক।
১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। আবদুল গনি হাজারীর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৭ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আলোড়ন পত্রিকায় সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। এই সালে দেশ বিভাগের পর দিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং জুবলী প্রেসের সহকারি ম্যানেজার পদে যোগদান করেন। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে তিনি মুক্তি, চন্দ্র বিন্দু বাংলা পত্রিকা এবং দ্যা রিপাবলিক নামে ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে তিনি তৎকালীন দ্যা পাকিস্তান অবজার্ভার, দৈনিক সংবাদ, পূর্বদেশ, চিত্রালী এবং ১৯৬৫-১৯৬৮ সালে পরিক্রমা পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ১৯৭২-৭৩ সালে অবজার্ভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের প্রশাসক এবং ১৯৭৪-৭৬ সালে সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ব্যতিরেকেও তিনি লেখক সংঘ, ঢাকা আর্ট স্কুল, ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনসহ বেশ কিছু সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরিচালনার সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
দেখা যায় তিনি শুধু কবি ও সাংবাদিক ছিলেন না ; সামাজিক কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলেন।
আমার ফিরে আসি তাঁর কবিতায়-
কতিপয় আমলার স্ত্রী’ কবিতাটি তাঁর এক অন্যবদ্য সৃষ্টি। নিরেট আধুনিক কবি আবদুল গনি হাজারী বৃটিশ শাসিত সমাজকে দেখেছেন একজন কবি ও সাংবাদিকের দৃষ্টি দিয়ে।
তাঁর দৃষ্টি বীক্ষণ সমাজের নানা দিকে প্রসারিত ছিল।তিনি বৃটিশ শাসিত ভারতে শোষণ, দরিদ্রতাকে তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায় এই ভাবে-
“প্রত্যুষের অন্ধকারে তোমার দুটি হাত আকাশের দিকে যখন/ পৃথিবীর সৌন্দর্যে যখন নিমগ্ন প্রার্থণা/ বাগানের শিশির ঘাসে তখন শুভ্র শিউলিরা ঝরে পড়ে/ ঈশ্বরের হয়ে মানুষের কারুকার্যের মত।ৃহায় আমার সোনার দেশ/প্রার্থণার প্রভাতে তোমাকে সত্য মনে হয়/অথচ সূর্যের প্রাখর্যের নিচে আমার দারিদ্রকে লুকিয়ে রাখা যায় না।” (প্রত্যুষের অন্ধকারে দুটি হাত, জাগ্রত প্রদীপ)।
“…আমাদের পশ্চাতে ষ্টীমারের প্রথম শ্রেণীর ডেকে চারজন সপ্তাহান্তিক সাহেব/বিয়ারের ফেনায় ঠোঁট ভিজিয়ে/ দাবার কুটিল ছকে নিবদ্ধ এবং রাজ্যের ভাগ্য কারো তির্যক চিন্তায় ধার্য—/ আমাদের সাক‚ল্য জিম্মা চৌষট্টি ছকের ধাঁধাঁয়/চিন্তিত কামড়ে বিধৃত চুরুটের মত আগুনের অদৃশ্য অপচয় অনিবার্য/.. মা ফাতেমার ফুটন্ত হাঁড়ির সামনে/দীর্ঘ প্রতীক্ষ মাসুম শিশুর কান্না/অন্নপর্ণার অবুঝ স্মৃতির হাঁড়িতে নবান্নের স্বপ্ন কাঁজি।” (অন্নপুর্নার দেশ/ কাব্যগ্রন্থ জাগ্রত প্রদীপ)।
শস্য ভান্ডারে পরিপূর্ণ দেশের অবস্থা বৃটিশ শোষণে শূন্যতায় পর্যবসিত হয়েছে কবি সেটাকে তুলে এনেছেন সুনিপুণভাবে কবিতার পংক্তিতে। কবি দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে, বৃটিশ সাহেবরা বিয়ার খেয়ে আর চুরুটের টানে দাবার ছকে কীভাবে বঙ্গদেশকে শোষণ করা যায় সেই কুটিল খেলায় মত্ত। অন্যদিকে, মা ফাতেমার সামনে না খাওয়া শিশুরা বসে আছে এই আশায় এখুনি নামবে ভাত হাঁড়ি থেকে।এই অবুঝ শিশুরা জানেনা ওই হাঁড়িতে শুধুই মা পানি ফুটাচ্ছেন। ওতে কোন চাল নেই।ক্ষুধার্ত মা শিশুদের বুঝ দিতে চাইছেন এই হাঁড়িতে ভাত চড়ানো হয়েছে। বাছারা আর একটু সবুর করো।
কিন্তু হায় কৃষকের সোনা ধান এখন আর তাদের গোলায় নেই। খুব অল্প কথায় সেই সময়কে কবি আবদুল গনি হাজারী কবিতায় আবদ্ধ করেছেন।
‘মনে হয় সত্যই
বিছানায় শায়িত রোগীর
দুরারোগ্য ব্যাধি-
বললেন ডাক্তার
তাঁর স্খলিত কাচের আয়নায়
স্বরচিত হতাশার ছায়া।
এখন ঈশ্বরকে ডাকুন, তিনি বললেন-
কেননা তিনিই সকলের নিদান
আমরা নিমিত্ত মাত্র।.
দেহের সর্বত্র খুঁড়ে
দেখতে হবে
কোথায় লুকিয়ে আছে ব্যাধি।
প্রত্যুষের জানালা ধরে যখন
শিউলির শরীর বেয়ে এক ফোঁটা শিশিরের
সহৃদয় সূর্যের ঢালু দিয়ে
নেবে আসা দেখছিলাম
তখন আমার মনে হয়নি
আমি অসুস্থ।
আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ?
নিষ্ক্রান্ত ডাক্তারের ক্ষীয়মাণ কাশির শব্দ
অন্য প্রশ্নে ভ্রুক্ষেপহীন।
এ রোগ কি তবে তারও দেহে রয়ে গেল
পৈত্রিক হয়ে?
[আমার অকালমৃত্যুর পর
রুগ্ন পৃথিবীর আশ্বাসহীন কল্যাণ — কি যান্ত্রিক!]
দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত কবির মন চিন্তায় এক অমোঘ সত্যকে উন্মোচন করেছেন। চিকিৎসক হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণার জন্য বলছেন। কারণ চিকিৎসক বুঝতে পারছেন, এই রোগীকে ভালো করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। প্রত্যুষে জানালা দিয়ে শিউলী শরীরে শিশির বিন্দুকে সূর্যের ঢালু দিয়ে নেবে আসা দেখে মনে বিশ্বাস জেগে উঠেছে রুগী সুস্থ।
এই কবিতার তৃতীয় স্তবকে কবি বলছেন, ডাক্তারের ক্ষীয়মাণ কাশি। এই রোগ কি চিকিৎসকের দেহে থেকে গেলো পৈত্রিক হয়ে? কবির প্রশ্ন তাঁর অকাল মৃত্যুর পর রুগ্ন পৃথিবীর আশ্বাসহীন কল্যাণ-কি যান্ত্রিক!
‘…প্রখ্যাত আত্মার অমরত্বের প্রতীক্ষা না রেখে..
প্রসৃত ডাক্তারের অনির্ণেয় সিদ্ধান্তকে
ঘৃণা করতে ইচ্ছা করে
প্রত্যাসন্ন মৃত্যুর ছায়াকে পদাঘাত করার সিদ্ধান্তে।” (বিছানায় শায়িত রোগী, জাগ্রত প্রদীপ )
চিকিৎসক যখন বাঁচাতে পারছেন না, মৃত্যু যখন অবধারিত; ঈশ্বর একমাত্র নিমিত্ত।
এই কথা ভেবে কবির মনে এই ভাবনার উদয় হয়েছে।
কবি আবদুল গনি হাজারী একজন নিরেট আধুনিক কবি। তিনি যা দর্শন করেছেন, সেটাকে কবিতার ছন্দে বন্দী করেছেন দক্ষভাবে।
যদিও যুগ উত্তরে গিয়ে তিনি যুগস্রষ্টার আসন পাননি। যাঁরা যুগ সৃষ্টি করে সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছেন যুগস্রষ্টা না হয়েও অনেক কবি অমরত্ব লাভ করেছেন, তাদের সাহিত্য কর্মে। কবি আবদুল গনি হাজারী তাদেরই একজন।
‘‘আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
তোমার দিকে মুখ ফেরালাম
হে প্রভু আমাদের ত্রাণ করো
বিশ্রামে বিধ্বস্ত আমরা
কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু আমাদের স্বামীরা
অগাধ নথিপত্রে ডুবুরি
অতঃপর হে প্রভু
আমাদের রাত্রির শরীর পানসে
জানালার চাঁদ নিরক্ত
ব্যবহৃত দেহ
নাকডাকা স্বামী
বিনিদ্র রাত
এবং ট্র্যাংকুইলাইজার
আমরা কতিপয় আমলার স্ত্রী
হে প্রভু
যে-কোন একটা কাজ দাও
নিজেদের নিক্ষেপ করি
তার গহ্বরে।’’ (কাব্য গ্রন্থ কতিপয় আমলার স্ত্রী)
কতিপয় আমলার স্ত্রীর আর্তনাদ তাঁরা বিশ্রামে বিধ্বস্ত। তাদের রাত্রের শরীর পানসে। কতিপয় আমলার স্বামী আর তাঁদের স্ত্রীর অবস্থা সুনিপুণভাবে তুলে এনেছেন কাব্য-শৈলী ভাষা দিয়ে। আমালাদের বিত্ত –বৈভব আর স্ত্রীদের চাহিদার চিৎকার। কতিপয় আমলা ফাইলে ডুবে গিয়ে
স্ত্রীদের রাতকে বিপন্ন করেছে। স্ত্রীদের প্রার্থণা প্রভুর কাছে ‘‘ হে প্রভু
যে-কোন একটা কাজ দাও
নিজেদের নিক্ষেপ করি
তার গহ্বরে।’’
‘‘কবি আবদুল গণি হাজারী ১৯৭২ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯১ সালে সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য একুশে পদক (মরণোত্তর ) লাভ করেন। তিনি ‘ কতিপয় আমলার স্ত্রী ‘ কাব্যের জন্যে ১৯৬৪ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন।’’
তাঁর রচিত কাব্য গ্রন্থ হলো; সামান্য ধন (১৯৫৯), কতপিয় আমলার স্ত্রী, সূর্যের সিঁড়ি (১৯৬৫), জাগ্রত প্রদীপ (১৯৭০)। অনুবাদ গ্রন্থ স্বর্ণগর্দভ(১৯৬৪), সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ‘মন: সমীক্ষা(১৯৭৫)। রম্য রচনা : কালপেঁচার ডায়েরী (১৯৭৬)। কবি ও সাংবাদিক আবদুল গনি হাজারীর ৪৫তম মৃত্যু বার্ষিকীতে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: (শিল্প- সাহিত্যের সেবক, বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক রাইটার, অ্যাডভোকেট জজকোর্ট, পাবনা,বাংলাদেশ। ফ্লোরিডা, ইউএস প্রবাসী।