বনানী বাবলি : সবুজ : শুভরাত্রি অন্বেষা! কী হলো তোমার? রিং দাও না কতদিন আজ … হয় কী তোমার মাঝে মাঝে?
অন্বেষা : সুপ্রভাত … কী হবে আবার? তোমার শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন …
সবুজ : তোমাকে একটু হলেও তো বুঝতে পারি আমি … মন খারাপ?
অন্বেষা : তুমি কি জানো যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর পড়ানো হয় না?
সবুজ : শুনেছি তবে ডিটেলস কিছুই জানি না….তাহলে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রাণের উদ্ভব এটা বিশ্লেষণ করা হবে কী করে? সাবস্টিটিউট থিওরি কী?
অন্বেষা : জানি না … শুধু তাই নয় খবরে জানা গেলো এই মৌলবাদী রোষানল থেকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, লালন শাহ, ভারতচন্দ্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও নবম শ্রেণীর বাংলা বই সাহিত্য সংকলন থেকে বিদায় জানানো হয়েছে।
সবুজ : তারপর?
অন্বেষা : তারপর অষ্টম শ্রেণীর বাংলা ধ্রæতপঠন থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ণ কাহিনী, সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বই সপ্তবর্ণা থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লাল ঘোড়া বাদ গেছে এবং যুক্ত হয়েছে হবিবুল্লা বাহারের মরু ভাস্কর আর ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্য বই দ্রæতপঠন আনন্দপাঠ থেকে শরৎচন্দ্রের লালু, সত্যেন সেনের লাল গরুটা এবং রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের হৃদয় চলে গেলো ….
সবুজ: চিন্তা করা যায়? শুধু মৌলবাদ নয় এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এই অন্যায়ের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। মৌলবাদকে লালন পালন করছে। একটি গোষ্ঠী, একটি দল
অন্বেষা : ২০১৯ সালের মে মাসে হেফাজতে ইসলাম প্রধানমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছিলো এবং পাঠ্য বই সংশোধনের দাবি জানিয়ে সেইদিন তারা ইসলামী ঐক্যজোট সংবাদ সম্মেলন করে….
সবুজ : বাহ্ চমৎকার …কাদেরকে খুশি করার জন্য এই পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন তা জাতি একবার জানতে চাইলো না? প্রগতিশীল, সমাজ হিতৈষী কিংবা শিক্ষকরা কি ঘুমিয়ে আছেন? বর্তমান বাংলাদেশের প্রশাসন বা সরকার হেফাজতের ১১ দফার প্রতি নতি স্বীকার করে শিক্ষা ব্যবস্থার চরম সর্বনাশ করেছে। আর মৌলবাদীদের জন্য এটা একটি বিশাল সাফল্য।
অন্বেষা : শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি ভাবতে পারা যায়?
সবুজ : আমি কোথায় যেনো পড়েছিলাম বাংলা ট্রিবিউন এই পরিবর্তনের প্রশ্ন করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহাকে। তিনি সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন, “নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে।”
অন্বেষা : এটা মানুষের চোখে ধুলা দেয়ার জন্যই বলা। তিনি নিজের চাকুরী রক্ষার জন্য হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক তাই হয়তো এই উত্তর দিয়েছিলেন …
সবুজ : নিশ্চয়ই…এবং বলানো হয়েছে একজন হিন্দুকে দিয়ে …. ধর্ম ব্যবসা যারা করে দেখো তারা ধর্মের কী লীলা খেলা দেখায়! সোজা কথা হলো বাংলার রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সত্যেন সেন, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে বিদায় করা হয়েছে শুধুমাত্র তাঁরা হিন্দু বলে …. বাংলার আগামী প্রজন্ম তাঁদের সেই অমৃত সাহিত্য সুধা থেকে বঞ্চিত হলো …
অন্বেষা : কী করা বলো? দেশ যে পেছনের দিকে হাঁটছে… শুধু তাই নয়… বাংলা একাডেমি থেকে যে ব্যবহারিক বাংলা অভিধান প্রকাশিত হয়েছে (পরিমার্জিত সংস্করণ: মাঘ ১৪২১/ জানুয়ারি ২০১৫) সেখানে ষাট বা সত্তরের দশকে যে বাংলা সাহিত্যে যে শব্দগুলি ব্যবহার হতো সেগুলি উধাও ১ পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য আরবি শব্দ।
সবুজ: বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ দর্শন যদি না শিখানো হয় তবে এরা শিখবে কী? মৌলবাদীদের কাছে রাষ্ট্র বিক্রি হয়ে গেছে … রাষ্ট্র হয়ে গেছে শোষণযন্ত্র …
অন্বেষা : আমাদের শিশুদের জানতে হবে মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী নজরুল, অগ্নিযুগের বাঘা যতীন কে ছিলেন…
সবুজ : আরো আছেন অগুনতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প, রাজা রামমোহন রায়, কাঙাল হরিনাথ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, সরোজিনী নাইডু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস আর জানতে হবে ইংরেজ তাড়ানো সেই গল্প … জানতে হবে জালিয়ানওলাবাগের সেই হত্যাকান্ড…
অন্বেষা : এই বাংলার অবিস্মরণীয় কে কে ছিলেন তা যদি না জানি তবে যে গোড়ায় গলদ থেকে যায়। যে জাতি বীরকে সম্মান করে না সেই দেশে বীরের জন্ম হয় না…
সবুজ : তাই তো .. এর কোনো বিকল্প নাই… চেতনা জাগাতে হলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাঠ্য বইতে সংক্ষিপ্ত আকারে থাকা উচিত। তাহলে বঙ্গবন্ধুর অসা¤প্রদায়িক মনোভাবগুলির সাথে ছাত্রছাত্রীরা পরিচিত হতে পারবে …
অন্বেষা : মাস্টারদা সূর্য সেনের কথা কিংবা ধরো এই জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া নাইট হুড উপাধি বর্জন করেন … এসব কথা যদি পাঠ্য পুস্তকে লেখা না থাকে তবে ছাত্রছাত্রীরা জানবে কী করে? উদ্দীপ্ত হবে কী উপায়ে বলো?
সবুজ : বঙ্গবন্ধু শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে কী বলেছেন মনে আছে? ….. বঙ্গবন্ধু সুবিধাবাদীদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেছিলেন, “বাঙালির স্বাজাত্যবোধকে টুটি চেপে হত্যার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বার বার এই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত হেনেছে, আর তাকে প্রাণ দিয়ে প্রতিহত করেছে এদেশের তরুণরা। কিন্তু তাদের মধ্যে বুদ্ধিজীবী স¤প্রদায় ক’জন আছেন? স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সন্তান সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের প্রচেষ্টাই করা হয় নাই। তাঁর কথা বলতে আপনারা ভয় পান। কারণ তিনি ছিলেন হিন্দু। এঁদের ইতিহাস লেখা এবং পাঠ করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই।”
অন্বেষা : হুমম… জানতে হবে বিবেকানন্দ, জানতে হবে দানবীর মহসিন কে, জানতে হবে বীর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কে, জানতে হবে শ্রী চৈতন্য দেব কে, জানতে হবে রাজা রামমোহন রায় কে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কে …
সবুজ : বাংলা সাহিত্য, গান, কবিতা, ইতিহাস থেকেই নুতন প্রজন্মকে জানতে হবে …. শিখতে হবে … ইতিহাস থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করলে ইতিহাস কিন্তু এই ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদদের, এই মৌলবাদীদের, এই জাতির শত্রুদের ক্ষমা করবে না …
অন্বেষা : সা¤প্রদায়িক অশুভ শক্তির জয় তখনই হয় যখন মানুষ এর প্রতিঘাত থেকে সুবিধাবাদী মানুষ নিজেকে সরিয়ে রাখে …
সবুজ : সা¤প্রদায়িক অশুভশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে প্রতিটা মননে সুস্থ মানুষকে … অপশক্তির চাপকে প্রতিহত করবার শক্তি থাকা চাই প্রতিটা প্রজন্মের … সমাজের প্রতিটা কাঠামোতে চাই সংগ্রাম …
অন্বেষা: এসব তো একদিনে হয় নাই … এদেরকে লালন পালন করা হচ্ছে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে…
সবুজ : এই সব সাহিত্যিক, সমাজ বিপ্লবীদের ইতিহাস পাঠ্য পুস্তক থেকে মুছে ফেলার পরিনাম কিন্তু মানুষ উপলব্ধি এখনো করতে পারছে না।
অন্বেষা : হ্যাঁ … মূল্যতো দিতেই হবে … বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার মতো উদ্ধত্য আমরা দেখতে পাচ্ছি।
সবুজ : আত্রাই, নওগাঁতে অহিংস নীতির জনক গান্ধীর ভাস্কর্য কে আজ সা¤প্রদায়িক শক্তির অশুভ আচরণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য লোহার বেষ্টনীতে থাকতে হয় … আমরা দেখতে পাই কিন্তু বুঝতে পারি কি? মিডিয়াতে দেখতে পাচ্ছি গ্রামে গঞ্জে বাংলার বাউলরাও এখন আক্রান্ত হচ্ছে ধর্মান্ধদের মাধ্যমে।
অন্বেষা : এর শেষ কোথায়? আর ভালো লাগে না।
সবুজ : জানি না… ঠিক আছে রাখছি এখন…