অনলাইন ডেস্ক : ইয়াবাসহ মাদকপাচার বন্ধে দুই বছর আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। জোরেশোরে চলে কথিত বন্দুকযুদ্ধও। এ সময় বিশেষ নজর দেওয়া হয় ইয়াবাপাচারের সদর দরজাখ্যাত টেকনাফে। তখন অনেকে ধরে নিয়েছিলেন এবার হয়তো মাদকের পাচার ও কেনাবেচা কমে যাবে।

কিন্তু এতদিন পর এসে বার্তা দিচ্ছে উল্টোচিত্রের। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়ছে ইয়াবার চালান। গত শনিবার দুপুরেও ২০ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। আরও বেশ কয়েকটি জেলায়ও মাদক ধরা পড়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়।

ইয়াবা বড়ির মূল রুট কক্সবাজারে গত প্রায় ২ বছরে সাঁড়াশি অভিযানের পর অভিযান হয়েছে। এসব অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একের পর এক লাশ পড়েছে। এমনকি ইয়াবাপাচার বন্ধে ঘটেছে মাদক ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাও। এ ছাড়া দুই দফায় ১২৩ ইয়াবা কারবারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে শপথ নেয় জীবনে আর এ কারবারে জড়াবে না বলে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী সেই অভিযান এখনো চলমান। তার পরও বন্ধ হয়নি ইয়াবার লেনদেন।

প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে দেশে ঢুকছে বড় বড় চালান। চেনা পথগুলো বদলে নতুন পথ দিয়েই সেগুলো আনছে চোরাচালানিরা। তাই এখন প্রশ্ন উঠছে- তা হলে কী ইয়াবাপাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ? কেউ আবার বলছেন, লোক দেখানো বিভিন্ন অভিযান যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের অভিযান কিংবা গৃহীত অন্যান্য কর্মসূচির কারণে ইয়াবাপাচার অনেকটাই কমে এসেছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ মোহাম্মদ খান। এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে টেকনাফ থানায়। গ্রেপ্তার হয়েছেন টেকনাফ থানার আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাস, যিনি ওই এলাকার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাপাচার বন্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করছিলেন বলেই পুলিশের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হয়। এ জন্য টেকনাফে তার প্রায় ২ বছরের কর্মকালে একের পর এক ইয়াবা পাচারকারীরও লাশ ফেলেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী থানা এলাকা থেকেও মাদক কারবারি ধরে এনে ক্রসফায়ার দেন।

গত দুই বছরে প্রদীপ কুমার ও বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর হাতেই ১৪৪টি কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া দুই দফায় ১২৩ ইয়াবা কারবারিকে আত্মসমর্পণও করান ওসি প্রদীপ কুমার। কিন্তু এতকিছুর পরও থামেনি ইয়াবাপাচার। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহতের পর ওসি প্রদীপের ওইসব গৃহীত কর্ম নিয়েও নানা প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। ইয়াবা নির্মূলের নামে টেকনাফ পুলিশের কথিত ক্রসফায়ার ও আসামিবাণিজ্যের বিষয়ও জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারাদেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে সরকার। এতে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় ক্রসফায়ারের পরিসংখ্যান। গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪, বিজিবির সঙ্গে ৬২ ও র‌্যাবের সঙ্গে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। আর টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। অবশ্য এমন অভিযানের পরও কমেনি মাদকের চোরাচালান। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাদকের সরবরাহ বাড়ার তথ্য মিলছে। এমন বাস্তবতায় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের নামে কথিত ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্রের খবর বর্তমানে টেকনাফের সেন্টমার্টিন, শাহপরীর দ্বীপ, দমদমিয়া, লেদা, রঙ্গিখালী, উলুচামারী, মৌলভীবাজার, নোয়াখালীয়াপাড়া, শাপলাপুর, সাতঘরিয়াপাড়া, উখিয়ার আমতলি, পালংখালী, মরিচ্যা, রেজুখাল, আলীকদমের দুর্গম পাহাড় ছাড়াও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়ন, ধুনধুম ইউনিয়নের রেজু আমতলী ঘুনঘুম, তমব্রু, বেতবুনিয়া, আশারতলী, চাকঢালী, ফুলতলী, দোছড়ি ইউনিয়নের লেবুছড়ি, বার্মাপাড়া হয়ে অন্তত ৩১টি রুটে ইয়াবার চালান ঢুকছে।

আর এ পাচারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবহার হচ্ছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের কারবারিরা তাদের বাকিতেও কোটি কোটি টাকার ইয়াবা দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা সেগুলো বিক্রি করেই পরিশোধ করছে টাকা। আর পাচারে প্রতিদিনই ব্যবহার হচ্ছে নিত্য নতুন কৌশল। গত কয়েক মাস ধরে বড় বড় ইয়াবার চালান ভারত হয়ে সিলেট, ফেনী, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এসব রুটে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে অনেক চালান জব্দও করেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, স্থলপথে কড়াকড়ি আরোপ করায় ইয়াবা কারবারিরা এখন সরাসরি সমুদ্রপথকে বেছে নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে চালান আসে কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে। এ ছাড়া মহেশখালী-কুতুবদিয়া গভীর সমুদ্র চ্যানেল ব্যবহার করে চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও খুলনায়ও পাচার হচ্ছে ইয়াবার চালান।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস) ড. এএফএম মাসুম রব্বানী বলেন, ‘মাদকের চাহিদার পাশাপাশি প্রবাহ এখনো আছে। আমাদের অভিযানও চলমান। ইয়াবাপাচার বন্ধে আমরা নতুন করে পলিসি নেব। সব ধরনের মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। আমাদের একাধিক টিম টেকনাফে কাজ করছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগে থেকেই মিয়ানমারের ইয়াবা পাচারকারীরা বাকিতে ইয়াবা বিক্রি করছে। আর এ দেশীয় কারবারিরা সেগুলো বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করে।’

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আয়াছুর রহমান আমাদের সময়কে অবশ্য বলেন, ‘ইয়াবা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আছে। গত দুই বছরে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। পরিস্থিতি এখন অনেকটা ভালোর দিকে। তবে রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোই এখন ইয়াবার ডিপো। তারা নিজেরাই নেটওয়ার্ক তৈরি করে ইয়াবা বাজারজাত করছে। তাদের সঙ্গে নতুন অনেক লোক যুক্ত হচ্ছে।’

এদিকে বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের দুর্গম পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা চোরাচালান বেড়েছে। গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ে বাহিনীটি একাধিক অভিযান চালিয়ে ১৫ লাখের বেশি ইয়াবা বড়িসহ ৯৯ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১২ ইয়াবা কারবারি।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের সর্বশেষ তালিকায়, কক্সবাজারে ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা ১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে শুধু টেকনাফেই রয়েছে ৯১২ জন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় কক্সবাজারের শীর্ষ ইয়াবা কারবারি আছে ৭৩ জন। তবে তালিকাভুক্ত বড় বড় গডফাদার এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে তাদের মাধ্যমে ইয়াবা বড়ি দেশে প্রতিদিনই ঢুকছে। শুধু বদল হচ্ছে গডফাদার আর পাচারকারী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘পৃথিবীব্যাপী মাদক চোরাকারবারি হচ্ছে। যে সরকারের সদিচ্ছা আছে তারাই তা দমন করতে পারছে। আর যে সরকারের সদিচ্ছা নেই তারা পারছে না। আমাদের সরকারও যতদিন পর্যন্ত আন্তরিক না হবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মাদক বন্ধ করা যাবে না। সবই একই সূত্রে গাঁথা। আর সরকার জানে না এমন কোনো কিছু আছে নাকি?’

নেহাল করিম বলেন, ‘শুধু লোক দেখানো ক্রসফায়ার দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়, আর আসল মাদক কারবারিদের টাকার বিনিময়ে উল্টো সুযোগ করে দেওয়া হয়। যাদের সঙ্গে ভাগবাটোয়ারায় না মেলে তাদের ক্রসফায়ারে হত্যা করে সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেওয়া হয়। তা হলে কীভাবে মাদক বন্ধ হবে?’

জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, যত মাদক বিক্রি হয় ধরা পড়ে তার মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে গত বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হয়েছে ৫৩ কোটির মতো, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা (প্রতি বড়ি দেড়শ টাকা)। আর দেশে ৬৬ থেকে ৭০ লাখ লোক মাদকাসক্ত বলে মনে করা হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, মাদকের পেছনে বছরে তারা প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে।