মামুন খান : আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নির্মম ভাবে খুন হয়েছিলেন উনিশ বছরের কলেজ ছাত্রী সোহাগি জাহান তনু। তারও দুই বছর আগে খুন হয়েছিলেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। সারাদেশ তোলপাড় করা এই খুন তিনটির বিচার তো দূরের কথা, হত্যা রহস্যের কোন ক‚ল কিনারা আজ অবধি করতে পারেনি বাংলাদেশের চৌকস আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তনু হত্যার কথা ধরা যাক। আমার গ্রেইড নাইনে পড়া মেয়েকে যদি পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনার পরমপরা বয়ান সাপেক্ষে জিজ্ঞেস করি- মা বলতো, এই খুনটা কে করতে পারে? সদ্য থ্রিলার আর রহস্যোপন্যাস পড়ায় আসক্ত আমার মেয়ে কপালে সামান্যতম ভাঁজের রেখা না ফেলেই রহস্যের আংশিক জট খুলে দৃপ্ত কন্ঠে বলবে, বাবা কাজটা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের কেউ না কেউ করেছে- Its a must. গ্রেইড ফাইভে পড়ুয়া আমার ছেলেটি আবার অতি বাঁচাল। তাকে জিজ্ঞেস করলে সে হয়ত সেকেন্ড খানি মাথা চুলকে বলবে, বাবা যেহেতু পাঁচ বছরেও ঘটনার কোন ক‚ল কিনারা পাওয়া যায়নি সেহেতু কাজটা নিশ্চয়ই জিন-ভূতে করেছে।

এখন দেখা যাক বাস্তবতা কী বলে? গ্রাম-গঞ্জের ছিঁচকে পকেটমার অথবা কথিত আইসিস জঙ্গি, পাতি নেতা অথবা ক্ষমতাধর কাউয়া নেতা, দৃশ্যমান বিষহীন মেছো সাপ অথবা অদৃশ্য জিন ভূত, তা সে যেই হোক না কেন- ক্যান্টনমেন্টের চৌহদ্দিতে ঢুকতে হলে তাকে চেকপোস্টে ছোট্ট করে হলেও একটা সেলাম ঠুকে আসতে হবে। এমন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরে আবৃত একটা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর, কেউ বাইরে থেকে এসে হত্যা ধর্ষণের মত অপরাধ করে যাবে আর পাঁচ বছরেও তার ট্রেইস পর্যন্ত পাওয়া যাবে না- এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনি খুন হবার পরদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিল আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। কথা রাখেনি সাহারা খাতুন। আটচল্লিশ ঘন্টার পর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা এলো গেলো, কিন্তু রাগর রুনির হত্যাকারী আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সাত বছর ধরে অপেক্ষায় আছে বৃদ্ধা জননীদ্বয়, অপেক্ষায় আছে সাগর-রুনি তনয় সে সময়ের ছোট্ট ‘মেঘ’।
মহানবী (সঃ) বলেছেন, “… তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে”। (বুখারী, মুসলিম)

দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে সাহারা খাতুন হয়ত জানতে পেরেছিল হত্যাকারী কারা? কিন্তু হত্যাকারীর ক্ষমতার কাছে সে চুপসে গিয়েছিল, থেকেছিল নিশ্চুপ। নীরবতা ভাঙলে গদি যেমন তেমন তার জীবনটাই হয়ত কেল্লা ফতে হয়ে যেত। আহা সে যদি জানত গদি আর প্রাণ কোনটাই চিরস্থায়ী নয়! যেই গদি আর প্রাণ বাঁচানোর জন্য সাহারা খাতুন সত্য গোপন করেছিল, সেই গদি বা প্রাণ কোনটাই কী সে রক্ষা করতে পেরেছে? অথচ যদি সত্য প্রতিষ্ঠা করে যেত তাহলে সে মরেও অমর হয়ে রইত। বেচারা সাহারা খাতুন- তার উপর অর্পিত দায়িত্ব নিয়ে তাকে কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না?

তনুর প্রথম ময়না তদন্তে ধর্ষণের কোন আলামত খুঁজে পায়নি সংশ্লিষ্ট ডাক্তার। কবর খুঁড়ে লাশ বের করে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করতে হয়েছে। সাগর-রুনির মরদেহ কবর থেকে বের করা হয়েছে ডি,এন,এ সংগ্রহ নামের নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য। কবর থেকে লাশ উত্তোলনের মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে আপনজনদের। কখনও সি,আই,ডি, কখনও ডিবি, কখনও বা র‌্যাব- ডিপার্টমেন্ট বদল হয়েছে, বদল হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তার। তদন্তের নামে বারবার হয়রানি করা হয়েছে আপনজনদের, দিনের পর দিন তাদের উপর করা হয়েছে মানসিক নির্যাতন। একবার না বার বার ধর্ষিতা হয়েছে তনু, বহুবার খুন হয়েছে সাগর-রুনি। সেই তদন্ত কর্মকর্তারা- কহহর না জহহর, আকন্দ না ফাকন্দ, যে নামই হোক হয়ত এখনও বেঁচে আছে। ভেবেছেন বেঁচে থেকে বেঁচে গেছেন? তাহলে প্রশ্ন-আপনারা আর কতদিন বেঁচে থাকবেন? এক দিন, এক বছর, এক যুগ, বড় জোর একশ বছর। তারপর আপনাদের কী প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে না? মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেদিনটির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “আজ আমি তাদের মুখের উপর সীলমোহর দেবো, তাদের হাতগুলো আমার সাথে কথা বলবে, তাদের পা-গুলো সাক্ষ্য দেবে, এরা কি কাজ করে এসেছে”। (সূরা ইয়া-সীন, আয়াত ৬৫)

ধরা যাক নরাধমগুলো প্রাণের ভয়ে অথবা অর্থের লোভে, ঘৃণ্য এই অপরাধের অংশীদার হয়ে গেছে। তাদের অন্তর সীল গালা হয়ে গেছে। কিন্তু এদের পরিবার পরিজন আছে না? স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন? আপনি কী জানতেন না, আপনার স্বামীটি ইচ্ছাকৃতভাবে ভূয়া ময়না তদন্ত রিপোর্ট দিয়েছে? আপনি কি জানতেন না, আপনার বাবা খুনের তদন্তে টালবাহানা করেছে? আপনার কী দায়িত্ব ছিল না, আপনার সন্তানকে প্রশ্ন করা? জেনে রাখেন, এই প্রশ্ন না করার জন্য একদিন আপনাকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
সাগর-রুনি খুন হওয়ার পর কয়েক মাস সাংবাদিকরা আন্দোলন করেছিল। সাংবাদিক নামধারী কতিপয় পা চাটা, তল্পিবাহকের স্বার্থ সিদ্ধি হবার সাথে সাথে সেই আন্দোলন একেবারে তামাদি হয়ে গেছে। আশার কথা এই যে ফি বছর বিশেষ দুই দিনে সাংবাদিক এবং চেতনাজীবীদের বিবেক জাগ্রত হয়। প্রথম পাতায় সাগর-রুনি অথবা তনুর ছবি দিয়ে একটা প্রতিবেদন ছাপানো, টক শোগুলোতে তর্ক বিতর্কের তামাসা, বড় জোর দুই একটা আলোচনা সভা। ব্যস, জাগ্রত বিবেককে আবার ঘুম পাড়িয়ে ওরা চেতনার ফেরিওয়ালা হয়ে যায় বছরের বাকি সময়ের জন্য। পুলিশের ভার্সন পঁঃ ধহফ ঢ়ধংঃব করলেই সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন হয় না। দায়িত্ব পালন হয় অনুসন্ধান করে প্রকৃত সত্য বের করে আনলে তবেই। সেদিন বেশি দূরে নাই, যেদিন প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞসা করা হবে।

আলোচ্য এই দুই হত্যাকান্ডের তদন্ত ঘিরে বিচারপতিদের হাস্যকর নাটক বেশ উপভোগ্য। নাটকের মঞ্চ কখনও বা জজ কোর্ট, কখনও বা হাই কোর্ট আবার কখনও বা সুপ্রিমকোর্ট। ক্লাউনের মত উদ্ভট পোশাক পরিধান করে এজলাসে বসে বিচারকরা সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাদের ডেকে এনে মৃদু ভর্তসনা উপহার দিয়ে ছেড়ে দেয়। ব্যস আবার ছয় মাস, কি বছরের জন্য তদন্ত হিমাগারে। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহামেদ তার এক লেখায় লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বিচারপতিরা মাছের মত হা করে থাকে টাকা খাওয়ার জন্য’। যুগের পরিবর্তনে বিচারপতিদের আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা শুধু হা করে বসে থাকে না। টাকা আর পদের জন্য এখন চর্বণ, চোষন, লেহনসহ এহেন কোন চৌর্যবৃত্তি নাই যে করে না। একটা মূর্তির আব্রু রক্ষার জন্য এজলাস ফেলে বিচারকরা রাস্তায় মানব বন্ধন করে ব্যাঘ্রের ন্যায় হুঙ্কার দিতে পারে। আর যখন বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে, যখন বিচার প্রত্যাশী নিপীড়িতের আর্তি প্রতিধ্বনিত হয়ে বার বার নিপীড়িতের কাছেই ফিরে আসে, তখন সান্ত¡না কেবল মৃদু ভর্তসনা। ওহে ক্লাউনবর্গ, সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন কড়ায় গন্ডায় হিসেব চুকাতে হবে।

সাগর, রুনি, তনু সহ আরও শত শত হত্যা আর গুম বিগত বছরগুলোতে যারা করেছে সেই হত্যাকারীরা বাইরের কেউ নয়। হত্যাকারী, অথবা তাদের সহযোগী অথবা তাদের নিকটজনের কেউ একজন হতে পারে আপনারই প্রতিবেশী, হতে পারে আপনার ফ্রেন্ড লিস্টের মধ্যে একজন। শুধু হাস্যরস, বিনোদন আর ছবি পোস্টের মধ্যে ব্রাকেটবন্দী না রেখে, আসুন না সোশ্যাল মিডিয়ার মত শক্তিশালী মাধ্যমকে আমরা ব্যবহার করি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অণুঘটক হিসেবে। কারণ আমাকে, আপনাকেও যে একদিন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। কতই না কল্যাণকর হতো, বিচারের দাবি করা পোস্ট যদি একটা দুইটা না হয়ে কোটি কোটি হতো! কোটি পোস্টের মধ্যে একটি পোস্টই যথেষ্ট যদি তা যথাপাত্রে যথা সময়ে আঘাত করে। হতেওতো পারে, খুনি চক্রের নিকটজনদের মধ্যে কেউ একজন বিবেকের দংশনে নিরাপত্তার কোকুন থেকে বেরিয়ে দিনের আলোর সামনা করবে।

গুম, খুন, ধর্ষণ করে যারা বছরের পর বছর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান, পরাক্রমশীল। এত যে প্রবল পরাক্রমশীল নমরুদ, ফেরাউন- তারাও তো ধ্বংস হয়ে গেছে। যারা ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে বা এখনও ঘটাচ্ছে তারা ইতিহাসের খল চরিত্র নমরুদ, ফেরাউনের চাইতেও পরাক্রমশীল হলে হতেও পারে। কিন্তু ওই খল মানুষগুলি হীরক রাজার চেয়েও পরাক্রমশীল হতেই পারে না। হীরক রাজা কারও মুখাপেক্ষী নয়। তাঁর অজ্ঞাতে রাজ্যে কিছুই ঘটে না। হীরক রাজা মহান, অমর, অব্যয়, অক্ষয়। যায় যদি যাক প্রাণ, হীরকের রাজা ভগবান।

হীরক রাজার দেশে বিচার পাওয়া কারও অধিকার না- কৃপার বিষয়। রাজার কৃপা হলে বিচার হবে, কৃপা না হলে এমনি করে কেটে যাবে যুগ যুগ। সাগর, রুনি, তনুদের স্মৃতি মহাকালের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। হয়ত কোন এক নিশুতি রাতে ঘুমানোর আগে ছোট্ট খোকা মায়ের কোলে গল্প শোনার বায়না ধরবে। মা গল্প বলবে, এক দেশে ছিল এক রাজা…। জননীকে বাঁধা দিয়ে খোকা বলবে, ও মাগো মা, অন্য কোন গল্প বল, এক যে ছিল রাজা রানী, অনেক হলো। থমকে যাবে মা। রাজা রাণীর গল্প ছাড়া হীরক রাজার দেশে অন্য কোন গল্প বলা যে নিষিদ্ধ। নাছোড় খোকা আবদার করতেই থাকবে। জননীর দুরু দুরু বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিতে আসবে। তারপর ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে বলবে, শোন বাছা তাহলে- এক যে ছিল তনু, এক যে ছিল সাগর-রুনি…