কামাল কাদের : তিন দিনের একটা কন্ফারেন্সে যোগদানের জন্য ইতালির রাজধানী রোমে এসেছি। সময়টা মার্চ মাসের শেষের দিক।
বসন্তকাল আসবে, আসছে ভাব। আকাশে বাতাসে মনোরম পরিবেশ। সাথে আমার সহকর্মী এবং বন্ধুবর মতিনও এসেছে। কনফারেন্সের আয়োজক একটা আন্তর্জাতিক এন,জি,ও সংস্থা। তাদের বড় রকমের একটা অফিস বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে রয়েছে। আমাদের দুই বন্ধুর মাঝে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে, শুধু একটা ব্যাপারে আমাদের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেটা হলো ও রাজনীতি ভালোবাসে আর আমি একে ঘৃণা করি। সে যাই হউক, আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে আজও কোনো ফাটল ধরেনি।
রাজধানী কেন্দ্রস্থলে একটা মাঝারি ধরণের হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোমের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলি আমাদের হোটেল থেকে হাঁটার পথে। তাই খুশি হয়ে বন্ধু মতিনকে বললাম, “ভালোই হলো, রথও দেখা হবে আবার কলাও বেচা হবে”। হোটেলের রিসেপসিনিস্ট একজন রুচিশীল এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য বলে মনে হয়। আমরা দুই বন্ধু যখন হোটেল লাউঞ্জে বসে কথা-বার্তা বলি তখন তিনি হা করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বলা বাহুল্য, আমরা যখন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলি তখন বাংলাতেই বলি।
কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন আমি আর মতিন সকালে কফি ব্রেকের সময় হোটেলের লাউঞ্জে বসে গল্প করছিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে হোটেলের সেই রিসিপশনিস্টি আমাদের কাছে এসে নির্ভুল ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, “জেন্টেলম্যান, যদি কিছু মনে না করো, তোমরা কি বাঙালি?” “হাঁ” বলে আমরা দুজনেই সমস্বরে জবাব দিলাম। আমাদের উত্তর শুনে ভদ্রমহিলাটির মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “কোন বাংলার?”, মহিলারটি আবার প্রশ্ন। “মানে?” মতিন একটু বিরক্ত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো। “মানে হলো, এপার বাংলা, না ওপর বাংলা!” মহিলার নিশ্চিতভাবে জানার আগ্রহ। কথাটি শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, মহিলা দেখছি বাঙালিদের অনেক খবরা খবর রাখেন।
আগেই বলেছি, আমার বন্ধুটি রাজনীতিতে পাকা-পোক্ত। আর তারই জের টেনে সে যেখানে সেখানে তুমুল কান্ড করে ফেলে। অনেক সময়ে, অনেক জায়গায় অপদস্তও হতে হয়েছে। এবেলায়ও তাই হলো। সে মহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে তার রাজনীতি ভাষণ আরম্ভ করে দিলো। “শুনুন মিস, আমরা বাঙালি, আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ। সুতরাং বুঝতে পারছেন, পৃথিবীতে আর কোনো দেশ নেই যার নাম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশে যারা বাস করেন তারাই হলো বাঙালি”। মতিনের কথাগুলি শুনে মনে হলো মহিলা যেন এক বিরাট ধাঁধায় পরে গেলেন। আমি মহিলাটিকে আস্বস্ত করার জন্য বললাম, “কিছু মনে করবেন না মিস, আমার বন্ধুটি কিছুটা আবেগ প্রবণ এবং জাতীয়তাবাদীতে বিশ্বাস করে। তার ভাষায় ইন্ডিয়াতে মানে ওপার বাংলায় যে সমস্ত বাঙালি থাকেন তারা হলেন ইন্ডিয়ান। এই যেমন ইংল্যান্ডে যে সমস্ত লোক ইংরেজিতে কথা বলেন তাদেরকে বলা হয় ইংলিশ। আবার যে সমস্ত লোক অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন তাদেরকে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ান, যদিও তারা ইংরেজিতে কথা বলেন। সে মতে যারা আমেরিকাতে থাকেন, তাদেরকে বলা হয় আমেরিকান, নিশ্চয়ই তাদেরকে ইংলিশ বলা হয় না। একই ভাবে আমার বন্ধুটি আপনাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশী হওয়া যায় না। বড়ো জোর ওপার বাঙালিদেরকে ইন্ডিয়ান বাঙালি বলা যেতে পারে। সে যাই হউক, আপনি ওসব কথা বাদ দিন। আপনি বলুন, কি বলতে চাইছিলেন”। “আমি পুরোনো ঢাকার লোক খুঁজছিলাম, আই মিন, ডাউন টাউন ঢাকার লোক।” মহিলাটি বললেন। “কেন?”
আমরা তাকে কিছুটা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। “সময় করে বলবো, তোমরা তো আপাতত: ব্যস্ত আছো”।
“আপনি কৃতকার্য হয়ে গেলেন”, আমি এক গাল হেসে জানালাম, “আমি পুরানো ঢাকার ছেলে, তবুও বুঝতে পারলাম না, পুরানো ঢাকার প্রতি আপনার এতো উৎসাহ কেন?” “বললে হয়তো তোমরা ঘাবড়ে যাবে, তোমাদের এখন কনফারেন্স ফেরার সময় হয়ে এসেছে। বিকেলে তোমাদের ছুটির পর আমি হোটেলের ‘লনে’ তোমাদের সাথে দেখা করবো, তখন তোমাদের সাথে কথা হবে”।
বিকালের সেশন সেদিনকার মতো শেষ হলো। বাইরে বিরাট ফটকের সামনে ভদ্র মহিলা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারপর আমরা তিনজনে হোটেলের সুন্দর লনে পাতা একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। তিন কাপ চায়ের অর্ডার করা হলো। এরই মধ্যে মহিলার নামটিও জানা হয়ে গেলো। নাম তার মার্থা মিলানো। তিনি আরো জানালেন যে তার ভগ্নিপতি পুরানো ঢাকার ছেলে সে একটা স্কলারশিপ নিয়ে রোমে এম,বি, এ পড়তে আসে। রোমে “ইনস্টিটিউট অফ বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন” ফ্যাকাল্টিতে পড়ার সময় উনার বোনের সাথে পরিচয়। পরিচয় পর্বের পর প্রণয়, তারপর বিয়ে।” দেশে তিনি কেন ফিরে যাননি, সেটা আমি বলতে পারবো না। কারণ সেটা আমি কখনো জিজ্ঞাসা করি নাই। লেখাপড়া শেষ করে রোমেই থেকে গেলেন। এক সময়ে তাদের এক ফুট ফুটে কন্যা সন্তান জন্ম হলো। জীবন ওদের সুখ শান্তিতেই কাটছিলো। একদিন হঠাৎ করে এক অঘটন ঘটে গেলো। যার ফলে ওদের জীবনটাই ওলট পালট হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলো। এক ছুটির দিনে ভোর বেলায় ওরা, মানে আমার বোন, ভগ্নিপতি আর, তাদের বাচ্চা সোনিয়াকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণের জন্য তৈরি হলো। গ্যারেজ থেকে আমার ভগ্নিপতি গাড়ি বের করছে, আর সেই মুহূর্তে অবুঝ ছোট মেয়েটি ছোট ছোট পা ফেলে নিজেরই অজান্তে গাড়ির পিছনের “ড্রাইভ ওয়েতে” দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাপারটা আমার ভগ্নিপতীর চোখের আড়ালে ছিল, তাই গাড়ির পিছনে সোনিয়াকে দেখতে পায়নি। ক্যাচ করে এক বিকট শব্দ করে যখন গাড়িটি থেমে গেলো, গাড়ি থেকে বের হয়ে আমার ভগ্নপতী যে দৃশ্যটা দেখলো, সে দৃশ্য যেন কোনো পিতা মাতার দেখতে না হয়। সোনিয়ার ছোট্ট দেহটা জবাই করা মুরগীর মত কাতরাতে শুরু করলো। ঐ দৃশ্যটা দেখে ববি, মানে আমার ভগ্নিপতি অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার জ্ঞান যখন ফিরলো তখন অলরেডি ববির কন্যা চির নিদ্রায় ঢোলে পড়েছে, তার সাথে ববিও তার বোধগম্য হারিয়ে ফেললো। অর্থাৎ পাগল হয়ে গেলো। কয়েক বছর মানসিক হাসপাতাল থাকার পর এখন সে এক চার্চে বসে সারাক্ষন সময় কাটায়। সে বক বক করে বলে বেড়ায়, “ঈশ্বর আমাকে শাস্তি দিয়েছেন, এ শাস্তি আমাকে গ্রহণ করতেই হবে। আমি কাউকে ভালোবাসি না, শুধু একজনকে ভালোবাসি, সে হলো আমার ঈশ্বর”।
ঘটনাটি শুনে আমাদের দুজনার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর মার্থা অতি বিনয়ের সুরে বললো, “যাবে একদিন ববির সাথে দেখা করতে? ও কারো সাথে কথা বলে না। কখনো সখনো কোনো এশিয়ান পর্যটক দেখলে তাদের সাথে ফিস ফিসিয়ে কি যেন বলাবলি করে”। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় থাকেন উনি”। “তুসকানি (Tuscani) নামের এক শহরে।
রোম থেকে প্রায় ২২৫ /২৩০ কিলোমিটার দূর হবে। তোমরা তো পুরানো ঢাকার লোক, হয়তোবা দেশের লোক দেখলে নিশ্চয়ই খুশী হবে”। “নিশ্চয়ই যাবো” বলে আমরা রাজী হয়ে গেলাম।
আগামী দিন আমাদের কনফারেন্স শেষ হয়ে যাবে তার পরদিনই আমরা তুসকানি যাবার প্রস্তুতি নিলাম। দিনটি ভালোই ছিল।
রোদ্রদীপ্ত ভোর বেলায় আমরা তিনজনে তুসকানির উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। প্রায় ঘন্টা তিনেক ড্রাইভিং করার পর মার্থা আমাদেরকে তুসকানিতে নিয়ে পৌঁছালো। জায়গাটা খুবই মনোরম। এত সুন্দর জায়গা জীবনে খুব কমই দেখেছি। পাহাড়ের চারিদিকে সবুজের সমারোহ। আর সমতল ভূমিতে মাইলের পর মাইল হলুদ রঙের সরিষার ক্ষেত। এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি। মার্থা একটা নিভৃত গ্রামের পাহাড়ের কোলে তার গাড়ী খানা পার্ক করে আমাদেরকে নিয়ে চললো পাহাড়ের উপরের দিকে যেখানে সুউচ্চ চার্চে গম্বুজটি দেখা যাচ্ছে। সরু গলি পথ, এ যেন পুরানো ঢাকাকেও হার মানায়। তবে গলিটি বেশ পরিষ্কার-পরিছন্ন এবং রাস্তাটা পাকা। জানলাম জায়গাটা নাকি পর্যটকদের একটি প্রিয় স্থান। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন এসে এই চার্চে এসে মানত করে যায়। অতি কষ্টে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছলাম। কথিত আছে অনেক বাতের রোগী এই চার্চে হেটে আসার ফলে তাদের বাতের অসুখ নাকি সেরে গেছে। কিন্তু আমাদের অবস্থা একেবারে কাহিল। এরপরে দেখলাম অনিতিদূরে একজন বাদামী রঙের পাদ্রী সাহেব একটা পুশ চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। মার্থা তার হাতটা উঁচিয়ে বললেন, “উনিই আমার ভগ্নিপতী ববি”। আমি পাদ্রী সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম এক সুন্দর চেহারার, মধ্যে বয়সী লোক যার মুখ ভর্তি একগাল দাড়ি আর গোঁফের মাঝে আসল মানুষটি হারিয়ে গেছেন। আমি উনার পথ রোধ করাতে মনে হলো উনি আমার প্রতি ক্ষুন্ন হয়েছেন। একটু রুক্ষ ভাবে ইংরেজীতে বললেন, “কে আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালে?” তারপর কিছুক্ষন একনজরে আমার দিকে তাকালেন আর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রশ্ন করলেন, “ইয়ং ম্যান, হ্যাভ ইউ গোট এনি বিগ ব্রাদার?” আমি ইংরাজীতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন বলুনতো?”। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, তিনি অকৃত্রিম বাংলা ভাষায় আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার বড় ভাইয়ের নাম জামিল কি-না?” কথাটি শুনে আমি তো অবাক।পাদ্রী সাহেব আমার ভাইকে চিনে নাকি?
আমি অতি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি আমার ভাইকে চিনেন কি করে?”। পাদ্রী সাহেব উত্তর দিলেন, “তোমার ভাই জামিল আমার বাল্য বন্ধু ছিল। জামিলের সাথে তোমার চেহারার এতো মিল ,আমার যেন মনে হলো বিশ বছর পর আমার প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেলাম”। আমাদের এ রকম বাংলায় কথা -বার্তা শুনে মার্থা একদম থ হয়ে গেলেন।
পাদ্রী সাহেব বলে চললেন, “প্রায় বিশ বছর আগে ঢাকা ছেড়ে এসেছি। তুমি তখন ছোট ছিলে। তুমি এখন আমার দিকে ভালো করে তাকাও, দেখো চিনতে পারছো কিনা?” আমি বললাম, “সরি স্যার, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আপনাকে চিনতে পারলাম না”। দাঁড়ি, গোঁফ আর লম্বা চুলের আড়ালে সত্যিই পাদ্রী সাহেবকে চিনতে কষ্ট হোচ্ছিল। “তাই স্বাভাবিক,” তিনি বললেন, “আমার নাম ববি বিমল বর্ধন, তোমার বিমলদা। কি এখন কিছু মনে পড়ছে? তোমার ভাই জামিল আর আমি ঢাকার সেইন্ট গ্রেগরী ইস্কুলে একসাথে পড়তাম। পরে তোমার ভাই ঢাকা কলেজে আর আমি নোটরেডম কলেজে ভর্তি হই। গেন্ডারিয়া দিন নাথ সেন রোডে একই পাড়ায় থাকতাম, তাই কলেজ বদল হলেও আমাদের বন্ধুত্ব অটল ছিল”। এবার আমি উনার মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম। তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। সেই পরিচিত হাসিটি আজ অনেক দিন পরে মনের দুয়ারে ভেসে উঠলো। তার সাথে আমি প্রায় লাফ দিয়ে চিৎকার করে বললাম, “হাঁ, চিনেছি, আমাদের অতি প্রিয় বিমল দা। আপনাদের গ্রামের বাড়ী মানিকগঞ্জে বড় ভাইয়ের সাথে কতবার যে গিয়েছি, সে কি ভোলা যায়। আপনার মা -বোন আমাদের কত আদর যত্ন করতেন! আপনার বরাতে ঢাকার সদরঘাটে খ্রিস্টান মিশনারী সোসাইটি থেকে পালা পর্বনে কত যে নিমন্ত্রণ পেয়েছি সে গুনে বলা যাবেনা”। আমার এই পুরানো দিনের কথায় বিমলদাকে খুবই আননন্দিত দেখাচ্ছিল।
এই ফাঁকে আমি সাহস করে বিমলদাকে প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, বিমলদা আপনার এ বেশ কেন? আপনার মতো প্রতিভাবান লোকের আমাদের দেশে প্রয়োজন ছিল এবং এখনো আছে। আর এই নিভৃতে, অজ পাড়াগাঁয়ে কেন বাস করছেন?” বিমল দা আমার লম্বা প্রশ্নগুলি শুনে কিছক্ষন গুম হয়ে রইলেন। তারপর শুরু করলেন, তার জীবন কথা। “তোমাকে এক কথায় তোমার সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে না, তবুও চেষ্টা করছি। এখানে সবাই ভাবে আমি একটা পাগল ছাড়া আর কিছু নই।
হয়তো বা তাই। আমি এখানে এসেছি ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে, কারণ আমি শুধু একজন কে ভালোবাসি এবংতিনি হলেন আমার প্রভু। আমি পাপ করেছি এবং এখন আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি। তা না হলে নিজের মেয়েকে কেন ওমন ভাবে আমি মেরে ফেলবো! যে দিন থেকে মেয়েকে হারালাম, সেদিন থেকে বুঝলাম, এই ধরণীটাই হলো পাপ পুণ্যের বিচার স্থান। এখন আমি আমার পাপের ফল ভোগ করছি। কবে কখন শেষ হবে জানিনা।
— আপনি এমন কি কাজ করেছেন যে, বিবেকের তাড়নায় জীবন সমন্ধে এতো উদাসীন?
— জীবন সমন্ধে আমি উদাসীন নই, বরং এখানে এসে আমি নুতন জীবন পেয়েছি। কেউ জানেনা আমার মনের কথা। আজ তোমাকে আপনজন মনে করে আমার পাপের কথা বলছি :—
“ঢাকা থেকে রোমে যখন স্কলারশিপ নিয়ে আসলাম ,তখন বয়সে তরুণ। মনে প্রাণে নিজেকে খুব বাহাদুর ভাবতাম। অহংকারে যেন মাটিতে পা পরতোনা। অহংকারই যে [পতনের মূল, তার জাজ্বল্য উদাহরণ হলাম আমি। বৃত্তির টাকা এতো পাওয়া যেত যে, থাকা, খাওয়া খরচ করেও অনেক টাকা বেঁচে যেত। ছাত্র অবস্থায় টাকা জমিয়ে একটা গাড়ী কিনে ফেললাম। তারপর গাড়ী করে দিন রাত হই হই করে বেড়ানো যেন নেশার মতো হয়ে গেলো। একদিন রোববার ভোর বেলায় ফুল স্পীডে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিলাম। রাস্তা ঘাট প্রায় খালি ছিল। পথে এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে “জেবরা ক্রসিং” দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো। আমি আমার গাড়ীটি এতই জোরে চালাচ্ছিলাম যে, জেব্রা ক্রসিং এ গাড়ীটাকে ঠিকমত থামাতে পারিনি, এর ফলে ওরা দুজনে আমার গাড়ীর ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পরে যায়। পিছনে তাকিয়ে দেখি রাস্তা রক্তে ভেসে গেছে। পুলিশের ভয়ে গাড়ী থামালাম না। নির্জন রাস্তা ছিল, কেউ আমাকে দেখলোনা। এখন ভাবি, একজন নিশ্চয় দেখেছিলেন আমার এই অপকর্ম। তিনি হলেন প্রভু ঈশ্বর। তাকে তো ফাঁকি দেয়া যায় না। সেদিনই আমি রোম শহর থেকে পালিয়ে সোজা চলে গেলাম ফ্লোরেন্সে (florence) শহরে।পরদিন সংবাদ পত্রের মারফত জানা গেলো যে বাচ্চাটি মারা গেছে এবং তার মা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ফ্লোরেন্সে যেয়ে আবার নুতন করে জীবন শুরু করলাম”। কিছুক্ষন নীরবতা থেকে বিমলদা আবার শুরু করলেন তার কাহিনী।
“অনেক বার মনে হয়েছে ,পুলিশের কাছে ধরা দিই, আবার প্রত্যেকবার পিছিয়ে গিয়েছি পুলিশের সাজার ভয়ে। এই ঘটনার কয়েক বছর পর আমরা বিয়ে করলাম। আমাদের একটা মেয়ে হলো। সুখেই দিন কাটছিলো। একদিন আমি আমার পাপের ফল পেলাম ,তা না হলে কেন আমি আমার আদরের সন্তানকে আমারই গাড়ীতে চাপা দিয়ে মেরে ফেলবো !! তখন থেকে বুঝতে পারলাম সন্তান হারানো কাকে বলে। সব সময় আমার বিবেক আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, তুমি যে মায়ের সন্তানকে হত্যা করেছো, তারই ফল তোমাকে পাইয়ে দিলাম, তোমাকে সারা জীবন প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে। এর থেকে তুমি পরিত্রান পাবে না।
বিমলদা আবার একটু থামলেন, মনে হলো কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বললেন, “কোথাও কোনো শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই এখানে চলে এলাম। শান্তি পেয়েছি কিনা জানিনা,তবে আমার প্রভু ভগবানকে খুঁজে পেয়েছি। মানুষের মাঝেই ভগবান, আর জানলাম মানুষকে ভালোবাসতে পারলেই ভগবানকে পাওয়া যায়। এই পুশ চেয়ারটাকে নিয়ে একান্ত মনে হাঁটি, আর ভাবি আমার সোনিয়া ওই পুশ চেয়ারটায় বসে আমার সাথে কথা বলছে, আমার কাছেই আছে। লোকে বলে আমি একটা পাগল। পাগল আমি ঠিকই, আর সেটা ভগবানকে ভালোবাসার পাগলামী। এরই মাঝে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। মার্থাকে বললাম, “চলুন ফিরা যাক”।
বিমলদার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিমলদা নির্বাক, নিশ্চুপ। শুধু দেখলাম, তার চোখ দিয়ে মুক্তার মতো জল ছল ছল করছে। গাড়ীতে উঠলাম। পিছন ফিরে তাকাতে সাহস হলো না, কারণ বিমলদার বিষণ্ণ মুখখানি দেখে মনটা খারাপ লাগছিলো। শুধু মনে মনে বললাম, “ববি বিমল বর্ধন, তুমি যেন তোমার বাকি জীবনটা শান্তিতে থাকো, এটাই আমার ভগবানের কাছে প্রাথর্না”। শেষ
ইলফোর্ড, ইংল্যান্ড