খুরশীদ শাম্মী : চৈত্র দাহ! শস্য ক্ষেত ফেটে চৌচির। বাস থেকে নেমে প্রায় দুই মাইল আলপথ ধরে হাঁটে তাপস। তেষ্টায় কাতর, পা দু’টো ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। ওই তো, নিজের বাড়ি পৌঁছেছে দৃষ্টির সীমানায়। অসুস্থ মা নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে করে প্রহর গণনা। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সন্তান ফিরছে নিজের ঠিকানায়। বাড়ির বউ-ঝিয়েরা ব্যস্ত রন্ধনশালায়, মশলা পেষা, মাছ কোটা, বড় মোরগটাও বাঁধা হয়েছে বাঁশের খাঁচায়।

তাপসের ব্যাকুল মন মানে না বারণ। ফিরে ফিরে দেখে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের ধুলোমাখা পথ। দৃষ্টি হারায় পাশের বাড়ির আঙিনায়। আলেয়ার আলোয় ছেয়ে যায় অন্তর। বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন। অন্তর পোড়ে, মানে না শাসন। চোখ বন্ধ করে বাড়ায় চলার গতি। চোখ বন্ধ করলেই কি অদৃশ্য হয় মন? মন সে তো স্মৃতিসম্ভার। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জ্বালায়। নিয়ে যায় নিষিদ্ধ গলি।
“ ‘জল দেবে, অঞ্জলি? এক গেলাস জল।’

পাশের বাড়ির বাংলাঘর। গলা উঁচিয়ে ডাকে জ্যাঠামশাই, ‘অঞ্জলি, কে এসেছে দুয়ারে?’
– বাবা…
– কথা বলছিস না কেন?
– বাবা.., একজন পথিক জল খেতে এসেছে।
– এদিকে পথিক এলো কোথা থেকে? দেখি তো। কোথায় যাবে সে?
– নিশ্চয়ই বহুদূর! (কণ্ঠ আটকে যায় অঞ্জলির)

– পাশের বাড়ির এই কুলাঙ্গার তোর পথিক হলো? জল দিবি না ওকে। বলছি ঘরে যা, অঞ্জলি। এ বাড়ির সীমানায় ওকে দেখলে আমি চিতা জ্বালিয়ে দেবো।”

কুঁজো বুড়ি যতীনের মা লাঠিতে ভর করে দাঁড়ায় পথ আগলায়ে। ভেঙে দেয় তাপসের নিষিদ্ধ গলির চলাচলা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সন্দেহের সুরে সে বলে, ‘তাপস না? বাড়ি আইলা বহুদিন বাদে। তোমারে এক বস্ত্রে গেরাম ছাড়া কইরা তোমার জ্যাঠা ভালো কিছু করে নাই। ভগবানের কৃপায় ফল পাইছে সে সুদে-আসলে। ভালাই করছ সময় মতো মায়ের বুকে ফিইরা আইসে। তোমার মায়ের পরানটা আছে তোমারে দেখবার লাইজ্ঞাই। যাও, বাড়ি যাও তাড়াতাড়ি। মাত্রই ঝাইড়া আইলাম তারে। তোমারে দেখবার লাইজ্ঞা ধড়ফড়াইতেছে তার অন্তর।’

– একমাত্র মায়ের জন্যই তো গ্রামে ফিরে আসা। নইলে এই গ্রাম আমারে চিতায় চড়ায় রাতদিন। তুমি নিজের যত্ন নিও, তোমারও তো বয়স হয়েছে। চলি এবার, মায়ের কাছে যাই।
– যাই বলে যেতে নাই রে। অমঙ্গল আনে।
– ঠিক আছে। আসি।
হুলস্থূল লেগে যায় তাপসের উপস্থিতিতে। ব্যাগ নিয়ে ঘরে তোলে ভাইপো, জলচৌকি আনে ভাইঝি, শুচিবাই মায়ের কাছে পাঠানোর পূর্বে শুদ্ধি করণের দায়িত্ব নেয় বৌদি। ‘ঠাকুরপো, জল রাখা আছে শৌচাগারে। স্নান না করলেও হাত-পা ধুয়ে লও।’
উবু হয়ে মায়ের পায়ে চুমু খায় তাপস। কেঁপে ওঠে মা। নির্মল মায়ায় কণ্ঠ জড়িয়ে ডাকে, ‘খোকা! এলি বুঝি? দেখি তোর বদনখানি, কতটা মলিন করেছে শহরের পাথরকুচি।’

স্তব্ধ তাপসের দৃষ্টি। শয্যাশায়ী মায়ের শিয়রে পাড়হীন সাদা থান পরিহিত অঞ্জলি দাঁড়িয়ে। তার বিবর্ণ সিঁথি চক্ষু খোঁচায়। চোখের নিচে রাত জেগে সলতে পোড়া চিমনি কালি। উভয়েই বাক্যহারা। মূক। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে মা, ‘খোকা, আমার মানিক।’
মা, তুমিও কি পারতে না দিতে একটা খবর আমায়?
খবর পাঠাই কেমনে? তোর জ্যাঠা বাঁইচা থাকতে দিছেনি তারে এই বাড়ি আইতে? মাত্র চল্লিশ দিনই তো হইল তোর জ্যাঠা মরার।

জল দেবে অঞ্জলি? এক গেলাস জল। তেষ্টা পেয়েছে বড়। পরান শুকায়ে কাঠ।
আমার হাতে জল? আমি যে অপয়া, অকল্যাণের হেতু হয়েছি বারংবার।
তোমার হাতের জল আমার আমৃত্যু অধিকার। অকল্যাণকে আমি প্রণতি করি, তোমাতে অনুরাগ। ধুলোপড়া স্মৃতি হবে স্বচ্ছ বর্তমান, বিবর্ণ সিঁথি রাঙবে নবারুণ, বাজবে সানাই, পুরাতন স্বপ্নে গাঁথব মালা এবার এলেই বৈশাখ। দেবে কি? এক গেলাস জল!