বিদ্যুৎ সরকার : আমার সামনেই আমার ছায়াটি ক্রমশ: দীর্ঘ হতে হতে ফিকে হয়ে হারিয়ে গেল দিন শেষে সূর্য ডোবার সাক্ষী হয়ে। দুপুরে ছায়াটি ছিল দৃঢ়, কঠিন, বেলা শেষে আমার অস্তিত্ব যেন বিলিন হয়ে গেল আমার দৃষ্টির সীমানায়। জানালার ফ্রেমে আবদ্ধ নীল আকাশ। সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত এ আকাশ, আকাশের রং, পাখিদের কোথাও হারিয়ে যাওয়া, উড়ো জাহাজগুলোর উড়ো-উড়ি। হাত বাড়ালেই আকাশ অথচ, সে আকাশের আস্তিত্বকে ছুঁয়ে দেখতে পারছি কই! স্বচ্ছ এক কাচের দেয়াল আগলে রাখে আমকে আমার আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে থেকে। আমার মনের মাঝে আরো একটি জানালা – দূরের জানালা স্মৃতির জানালা, সুখময় স্মৃতির সুগভীর জানালা, শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় নিপুন একটি জানালা।
শাশার দেয়া বকুল ফুলের মালা শুকনো হয়ে, সুঘ্রাণের স্মৃতি হয়ে ঝুলে থাকে দেয়ালের পেরেকে। পকেট ভর্তি রঙিন মার্বেল মোইন, মতিন সুমনের হাতের পরশ। উষ্ণতা বয়ে আনতো ছুটির দিনগুলোতে। গুলতির ফাঁক দিয়ে বার বার চলে আসতো ক্লাস নাইনের সুতপার কপালের লাল টিপ। নিখিলেশ তোর কি মনে পরে লঞ্চ ঘাটে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রথম সিগারেট খাওয়া, মনে পরে মধুছন্দার সাথে আমাদের খুনসুটি, টিফিন ব্রেকে ওর বইয়ের ভেতর তুই একদিন ময়ূরের পাখনা আর আমি দিয়ে ছিলাম সুন্দর একটি লাল গোলাপ! লাল গোলাপ নাকি ভালোবাসার প্রতীক? প্রায়ই আমরা দু’জন মধুছন্দার বইয়ের ভেতর এটা ওটা ঢুকিয়ে দিতাম। মধুছন্দা এসব জানতো কিন্তু কখনো কিছু বলতো না। বিকেলে স্যারের বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতাম, মধুছন্দাও যেতো, ফিরতাম আমরা একই সাথে একই পথে। ফেরার পথে ও আমাদের এটা ওটা খাওয়াতো বিশেষ করে ওর মায়ের হাতের নানান রকমের মজার আচার। এক সময় আমরা দু’জনেই মধুছন্দাকে ভালোবেসে ফেললাম। কোন দিন যদি ও ক্লাসে না আসতো, প্রাইভেটে না আসতো দু’জনেরই মন খারাপ হয়ে যেত। তখনই বুঝতে শিখলাম ভালোবাসা কাকে বলে!
এ ভাবেই ভালোবাসার বীজ বপন শুরু। একটি ইচ্ছে পূরনের স্বপ্ন দানা বাঁধতে শুরু করলো অজান্তেই। মধুছন্দা, নিখিলেশ তুই ও আমি একই বৃন্তে তিনটি ফুল। বর্ণে, গন্ধে মৌতাত সারা বেলা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বাস্তুচ্যুত হলাম, পরস্পরের থেকে ছিটকে পরলাম এক অনিশ্চিত সময়ের জন্য। সে মুহুর্তে জানা হয়নি কিংবা বলা সম্ভব হয়নি আমাদের পরস্পরের গন্তব্যের ঠিকানা।
প্রায় এক যুগ পর তোর সাথে হঠাৎ দেখা কৃষ্ণনগর রেলের কামড়ায় মুখোমুখি বসে। চিনে নিতে একটুকুও দেরি হয়নি। অতঃপর শৈশব স্মৃতি রোমন্থন, মধুছন্দার প্রসঙ্গও। যার কোনও খোঁজ মিলেনি আজ অব্দি। মধুছন্দা আমাদের কৈশোরের প্রেরণা, ভাললাগার প্রথম কদম ফুল, ভালোবাসার লাল গোলাপের সুরভী। নিখিলেশ, মধুছন্দা ও আমি ভাললাগার প্রথম শিহরণ, ভালোবাসার সুখের গৃহকোণ। অথচ, কেমন করে আমরা বাস্তুচ্যুত হলাম, পরস্পর থেকে দূরে চলে যেতে হলো। তিনজন যেন তিন ভূবনের বাসিন্দা হয়ে গেলাম নিজেদের অজান্তেই।
নিখিলেশকে হঠাৎ খুঁজে পেলেও মধুছন্দার দেখা মিলেনি আজও – হয়তো আর কোন দিনও হবে না। শৈশবের এমন অনেক স্মৃতিই ফুল হয়ে ফোটার প্রত্যাশায় থেকেও কলি হয়ে ঝরে পরে অকালেই। আমাদের স্বপ্ন কুড়ানোর শুভদিনের মহরৎ এমন করেই সময়ের বø্যাক-হোলে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকে মনের গহীনে এক দূরের জানালায়। মধুছন্দা তুমি কোথায় আছো, কোমন আছো? আমরা এখনও আশা করি একই বৃন্তে আবার তিনজন মিলবো দেখে নিও।
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক ও আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা