বিদ্যুৎ সরকার : উত্তরের খোলা জানালাটি শাশার ভীষণ প্রিয়। এ যেন তার মনের জানালা। খুলে দিলেই বহে সুবাতাস, প্রাণ জুড়োয় মন জুড়োয়। খোলা জানালায় চোখ রাখলেই সুদূরে দৃশ্যমান পাহাড়। পাহাড়ের সুনীল সীমা রেখা মিশে আছে আকাশের নীল প্রান্তিকে। ধু ধু প্রান্তর পেরিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে নৃ-গোষ্ঠীর সুখময় জীবন যাপন। ওরা প্রকৃতি প্রেমি। প্রকৃতি তাদের ভালোবাসায় সিক্ত। প্রকৃতিও তার ছায়া সুনিবিড় স্নিগ্ধতা দিয়ে বুকের মাঝে টেনে নেয়, আপন করে নেয় গভীর আলিংগনে। প্রকৃতি প্রদত্ত এ দেহ-মন আবার প্রকৃতির মাঝেই বিলীন হয়ে যেতে হবে কোন একদিন। এ বিশ্বাস তদের আরো ভালোবাসতে শেখায়, ভালোবাসতে প্রলুব্ধ করে। তারা জানে প্রতিটি ভালোবাসা অপর এক ভালোবাসার সূতিকাগার। ভালোবাসা ভালোবাসার জন্ম দেয়। ভালোবাসলে ভালোবাসা পাওয়া যায় – তাতো অজানা নয়। তবুও আমরা জেনে-শুনে প্রকৃতি ধংস করে যাচ্ছি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত বিরামহীন। শাশা প্রকৃতি প্রেমি। প্রকৃতির সাথে তার বন্ধন দৃঢ়। শাশা ও প্রকৃতি যেন একে অপরের সম্পূরক। নানান ফুল, লতা-গুল্ম ছাড়াও আছে বিভিন্ন ফলবতী গাছ-গাছালির সমাহার। যারা শা শার হাতের পরশে আজ পরিপূর্ণ, বিকশিত। ফুলে ফলে ভরে আছে বাড়ির চারিপাশ। সবুজাভ পরিবেশ বান্ধব শাশার বাড়ি তার ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেম। এখানেই বুঝি তার সমস্ত সুখের বীজ বপন করা আছে সংগপোনে। তার বাড়ি, তার গৃহ, তার খোলা জানালা এক অনুপম সুখের ঠিকানা। শাশার ইচ্ছে প্রকৃতি বেষ্টীত হয়েই যেন আজীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। একটু বাতাসে পাতা ঝরার উৎসব শুরু হয়ে যায় উঠোন জুড়ে। এ এক অন্যরকম ভাল লাগা, যা কি না মনের ভেতর ভিন্ন রকম অনুরনন সৃষ্টি করে। রাতের গভীরে পাহাড়ের উপত্যকা থেকে ভেসে আসে আদিবাসীদের মধুর গান। মাদল বাজিয়ে তারা জীবনের গান গায়, মাটির গান, পাহাড়ের গান। দারুন মাদকতা মিশে আছে তাদের গানের কথা ও সুরে। নিঝুম রাতের ধ্রæব তারা হয়ে শাশা বুদ হয়ে শুনে পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনিত চাকমা, মরং, শাওতালদের জীবন গাঁথা। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো খোলা জানালা গলিয়ে শাশার সফেদ বিছানায় লুটিয়ে পড়ে। শাশা তখন তার প্রিয় জানালার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। এমন জোছনার রাতগুলোতে পাহাড়ের ঢালে নির্মিত মাচানে একাকী বসে গীটার হাতে পাহাড়ি গান গায় একটি পাহাড়ি ছেলে। প্রতিবারই তার প্রিয় গানটি দিয়ে তার গান গাওয়া শেষ করবে। ভারি মিষ্টি গলা। অনেক দিন পর শা শা জানতে সমর্থ হলো ছেলেটির নাম ‘জ্যাকসেং’। একদিন তার প্রেমিকা পাহাড়ি পথে চলতে গিয়ে পা ফসকে খাদে পড়ে মৃত্যু বরণ করে।
‘নাসেক নাসেক হাপাল গিলা
খিলাবো আজি আমরা………’
সেই মৃত প্রেমিকার উদ্দেশ্যে তার এ গান। শাশার মন খারাপ হোয়ে যায় যখন জ্যাকসেং এ গান দিয়ে তার গান গাওয়ার পর্ব শেষ করে। হু হু করে উঠে তার মন। একটা কষ্ট মাখা দলা তার কণ্ঠের মাঝ খানে এসে বুঝি আটকে যায় বার বার। তারও কি এমন কোন দুঃখময় ঘটনা স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে? তারও কি পাহাড়ের উপত্যকা ছুঁয়ে যাওয়া এমন গানের কলি আছে? তারও কি গীটারের সাথে মধুর স্বরে গান গাওয়ার এমন কোন কন্ঠ ছিল?
বিদ্যুৎ সরকার : লেখক, আলোকচিত্রী, টরন্টো, কানাডা