বিদ্যুৎ সরকার : সে সময় এক একটি বাঘ মার্কা সিকির দাপট ছিল সুন্দরবনের এক একটি রয়েল বেংগল টাইগারের চাইতে কোন অংশে কম না। অনেক অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তরিত করে ফেলার অলৌকিক শক্তি নিয়ে তার আবির্ভাব ঘটেছিল। সবার পকেটেই তখন দু’চারটা বাঘ মার্কা সিকি থাকতো, আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য। কখনো কখনো আধুলি বা এক টাকার চাইতে একটি বাঘ মার্কা সিকির চাহিদা বেড়ে যেত বহু গুণ। বিশেষ করে ভার্সিটির ছাত্র ও প্রথম প্রেমে পরা ছেলে-মেয়েদের কাছে এ সিকিগুলোর মূল্য ছিল আকাশচুম্বি। চলতে-ফিরতে ওদের পকেটে রক্ষিত সিকিগুলোর চঞ্চলতায় সৃষ্ট ঝনঝন শব্দে রোমাঞ্চিপ ফোনই ছিল ফোনালাপ ও প্রেমালাপের মাধ্যম। তাও আবার অতিশয় টাকাওয়ালা লোকদের বাসাতেই এটা শোভা পেতো। সে জন্য আমাদের শরণাপন্ন হতে হতো বাঘ-মামা চালিত পাবলিক টেলিফোন বুথে। তাও আবার কিউ দিয়ে অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ সময় ধরে। যার দরুন এ বাঘমার্কা সিকির কদর এবং আদর দুটোই বেড়ে গিয়েছিল বহুলাংশে।
ওরা দু’জন। চঞ্চল, প্রাঞ্জল, উচ্ছল সুদূরের পিয়াসী। বেণী দুলিয়ে স্কুলে যায় যেন এক জল ফড়িং। ধরা যাক ওদের একজনের নাম রোদেলা অপর জনের মেঘলা। কখনো ওরা দু’জন একসাথে আসে আবার কখনো অন্য কারোর সাথে। চোখা-চোখি হোয়ে গেলে চোখ সরিয়ে নিত বড় অনিচ্ছায় অতঃপর একটি মৃদু ছোট্ট হাসির মহরা দু’জনেতে। স্ক্রিপ্টবিহীন কোন একটি শর্ট ফিল্ম হলেও হতে পারতো! একদিন অবিশ্বাস্যভাবে ক্রস কানেকশনের মাধ্যমে ওদের একজনের সাথে ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেল! ব্যাস্, এর পর থেকেই আলাপ, প্রলাপ, বিলাপ এবং প্রতিরোধ, অবরোধ। তখন এই বাঘ মার্কা সিকি দুঃসময়ের পরম সাথী হয়ে গেল যেন। ইচ্ছে করলে সময় অসময় প্রদত্ত বিভিন্ন নাম্বারে সিকির বদৌলতে কথা বলা সম্ভব হতো আমার। পকেটে টাকা আছে কিন্তু, বাঘ মার্কা সিকির অভাব জনিত কারণে ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও কথা বলা সম্ভব হতোনা কখনো কখনো। এমনি এক টানা পোড়েনে একদিন ওদের কাছ থেকে প্রায় আধা এক পাউন্ডের বাঘ মার্কা সিকি দৈবাত পেয়ে যাই। এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! দু’হাত ভরে সিকিগুলো নিয়ে নিলাম আমি মহা আনন্দে।
দিন যায়, কথা থাকে
পাখি ডাকে শাখে শাখে।।
রোদেলা ও মেঘলার সাথে কথা হতো প্রায়ই কিন্তু দেখা হতো মাঝে মধ্যে। একদিন নিউমার্কেটে হঠাত করেই অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল তিনজনের। সে যে কী শিহরণ, জাগরণ রক্ত কণিকায়। ভয় এবং উত্তেজনায় বুকের মাঝে কম্পন হচ্ছিল। ‘My heart is beating….’ গানের লাইনটা হঠাত মনে পড়ে গেল। কথা বলতে বলতে তিনজন হাঁটছিলাম আর আমি মনে মনে ভাবছিলাম এখন কী করা যায়? কী খাওয়া যায়? অথবা কোন উপহার কি দেয়া যায় – এসব আবল-তাবল ভাবনায় অনেকটা বিচলিত হচ্ছিলাম আমি। ‘নভেলটি’ আইসক্রিম শপটি দেখা মাত্র সব চিন্তার যেন অবসান হলো, আইসক্রিমের শীতলতা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল বুঝি! কার কী ধরনের আইসক্রিম পছন্দ, জিজ্ঞেস করতেই একটি মিলনের সুর বেজে উঠলো – ভে নি লা। নরম, শুভ্র, শীতল একের ভিতর তিন। মুখ গহ্বরে এই তিনের সুখ প্রবাহ এনে দিল অনাবিল আনন্দ ধারা। ক্ষণিকের গল্প কথাগুলোও কেমন তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল যেন তিনটি স্বাদে – নরম, শুভ্র আর শীতলতায়।
সেই থেকে আজ অব্দি আমাদের সম্পর্ক, আমাদের ভাল লাগা, আমাদের উপলব্ধি বহিছে এক আনন্দ ধারায়। বেঁচে থাক কলমি লতার সবুজ পাতারা, বেঁচে থাক জল ফড়িং -এর উড়ো উড়ি, বেঁচে থাক দুঃখ জাগানিয়া রাতের স্মৃতিগুলো, বেঁচে থাক সুখময় ভাল লাগার মুহূর্তরা। একটি বাঘ মার্কা সিকি যেন গড়িয়ে গড়িয়ে চলে আজীবন আমার মনের উঠোনে বিরামহীন।