মনিস রফিক: চলচ্চিত্রের যাত্রাপথ ইতোমধ্যে ১২৫-এ পা দিয়েছে। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নবীন আর শক্তিশালী এই শিল্পমাধ্যমকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ বলা হয়। আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশা আর ভালোবাসার কথা যেভাবে এই শিল্পমাধ্যমে উঠে আসে, তা অন্য শিল্প মাধ্যমে সম্ভব হয় না। মূলত পূর্বের ছয়টি শিল্পের মিথস্ক্রিয়া আর প্রতিফলনে ঋদ্ধ চলচ্চিত্র নামের এই ‘সপ্তম শিল্পকলা’। শুরু থেকে বর্তমানের চলচ্চিত্রের যাত্রাপথটা কেমন ছিল, আর কোন কোন অনুসন্ধিৎসু ক্ষণজন্মা স্বপ্ন দেখা মানুষের স্বপ্নের ফসল এই চলচ্চিত্র, সে সব বৃত্তান্ত উঠে আসবে চলচ্চিত্রকর্মী মনিস রফিক এর লেখায়। চলচ্চিত্র যাত্রাপথের এই বাঁকগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এ।
বাইশ.
জমজ বোন প্রতীতি দেবীর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে ঋত্বিক ঘটক যখন রাজশাহী শহরের পদ্মা পাড়ের রাস্তাগুলোয় দাপিয়ে বেড়াতেন তখন সবে তিনি কৈশোরে পৌঁছেছেন; হাফ প্যান্ট পরা এক কিশোর। ভবা নামেই তাকে চিনতো সবাই। বিকেলের আলোটা একটু নরম হলেই পদ্মার চরে লুটিয়ে পড়া আর ছুটে চলাই ছিল জমজ ভাইবোনের প্রতিদিনকার পরম উচ্ছ্বসিত সুখ।
এভাবে ছুটে চলতে চলতেই ঋত্বিক ছুটে চললেন কখনো কানপুর আবার কখনো কোলকাতায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাইরেনগুলো তখন মাঝে মধ্যেই বিকট শব্দে বেজে উঠতো। ভয়ার্ত খরগোশের বাচ্চার মত গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর সাথে সাথে বাংলার মানুষও তখন অজানা আতংকে বারে বারে কেঁপে উঠতে থাকে। বোমার কুণ্ডলী পাকানো কালো ধোঁয়ায় থেকে থেকেই অন্ধকার হতে থাকে দিক-বিদিকের আলো ঝরা সব সোনালী আকাশ। কোলকাতায় তখন মনন্তর।
কোটি কোটি মানুষের জীবন সংহারী বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন ক্ষীণ হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গেল ঋত্বিক তখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল আর রাজশাহী কলেজ পেরিয়ে বহরমপুরের কৃষ্ণনগর কলেজে; বড় ভাই মনীশ ঘটকের কাছে। সেই সময় চলে ঋত্বিকের কৃষ্ণনগর, কোলকাতায় থাকা আর ফিরে ফিরে রাজশাহীতে আসা; বাবা-মার সাথে বসবাস করা, হৈ হুল্লোড়- নাটক করা, ‘অভিধারা’ বের করা আর রাতের গভীরে পদ্মায় একমনে করুণ সুরে আঁড় বাঁশি বাজিয়ে চলা।
অন্ধকার পদ্মার না দেখা ঢেউগুলো ভেঙে ভেঙে যখন ঋত্বিকের বাঁশির সুর ছুটে চলতো দিক-বিদিক তখনই দিল্লীতে বসে মাউন্টব্যাটেন- র্যাডকিফের অনুগামীরা ভাঙতে থাকে ভারত, ভেঙে ফেলে বাংলা।
কোটি কোটি হিন্দু, মুসলমান, শিখ শেকড়চ্যুত হয় নিমিষেই। ধর্ম ভাগ করে দেয় মহাভারতের ঐতিহ্যময় মহামিলনকে। আর ঘটে যায় সবচেয়ে স্বল্প সময়ে পৃথিবীর এত বেশি মানুষের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের বেঁচে থাকা গভীরের শেকড় ছেড়ে আশ্রয়ের অভিনব অভিবাসন।
সাইকেল নিয়ে রাজশাহীর রাস্তায় আর পদ্মার চরে ছুটে চলা ঋত্বিককে এবার ছুটে চলতে হয় পরিবারের সাথে নতুন ভূমির সন্ধানে। নিযুত নিযুত শেকড় ছেঁড়া মানুষের ভয়ংকর কষ্টগুলো ছুঁয়ে যায় তাঁর হৃদয়মন। চোখের সামনে দেখেন কিভাবে মানুষ নিমিষেই রিক্ত হয়ে যায়। কিভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুড়ো খোকাদের বুড়ো সিদ্ধান্তে নিজেদের স্বপ্নকে হারিয়ে ফেলে। ঋত্বিক এমন সব মানুষের বেদনা বুঝেছিলেন, উপলব্ধি করেছিলেন। তাইতো এসব কিছু তুলে ধরতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেলুলয়েডের। সমষ্টিক ব্যথাকে এককভাবেই বহন করতে চেয়েছিলেন, নিয়েওছিলেন। আর বানালেন ‘নাগরিক’, ‘অযান্ত্রিক’, ‘কোমলগান্ধার’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এবং ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র মত সব কালজয়ী চলচ্চিত্র।
‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র নীলকণ্ঠ বাগচীকে দেখলেই আমরা ঋত্বিক ঘটককে কিছুটা হলেও খুঁজে পাই। আমরা বুঝতে পারি ঘরহারা নীলকণ্ঠ বাগচী আশ্রয়হীন মানুষের শেষ আশ্রয়। আমরা উপলব্ধি করি, নীলকণ্ঠ বাগচীই ক্ষয়ে যাওয়া, পচে যাওয়া সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এক শক্ত স্তম্ভ।
প্রতীতি দেবীর সাথে একই মাতৃজঠর ভাগ করে ঋত্বিক ঘটক জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর, ঢাকা জেলায়। সেই সময় তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক ছিলেন ঢাকার ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট। নয় ভাই বোনের মধ্যে ঋত্বিক ঘটক ও প্রতীতি দেবী ছিলেন শেষ সন্তানদ্বয়। ঋত্বিক ঘটকের সব ভাই বোন ছিলেন সেই সময় স্বনামে পরিচিত। সবচেয়ে বড় মণীশ ঘটক পঞ্চাশের দশকে বাংলা সাহিত্য অংগনে ‘যুবনাশ্ব’ নামে খ্যাত ছিলেন। তাঁর মেয়ে মহাশ্বেতা দেবী ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক। দ্বিতীয় ভাই সুধীশ ঘটক ১৯৩৭ সালে জার্মানী থেকে সিনেমাটোগ্রাফী বিষয়ে পড়াশুনা করে দেশে ফিরে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন। তৃতীয় ভাই লোকেশ ঘটক ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন এবং তিনি ভারতীয় নৌবাহিনীর পত্রিকা ‘ওশেনিয়েট’ এর প্রথম সম্পাদক হিসেবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। চতুর্থ ভাই আশিস ঘটক ছিলেন একজন শিল্প প্রাণ মানুষ যার কন্যার সন্তান হচ্ছেন বর্তমানে পশ্চিম বাংলার চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
ঘটক পরিবারের আদি বাড়ি ছিল পদ্মার উত্তর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা পাবনায় ভাঙ্গুরা গ্রামে। কিন্তু ঋত্বিকের জন্মের অনেক আগে ঘটক পরিবারের মূল ভিটে বাড়ি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ফলে ১৯৩৩ সালে ঋত্বিক ঘটকের বাবা চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর পরিবারটি রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। উল্লেখ্য, ঋত্বিক ঘটকের মাতামহ শ্রী মহেশ্বর ভট্টাচার্য ছিলেন রাজশাহীর একজন নামকরা আইনজীবী। রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য বাড়ি করতে চাইলে মহেশ্বর ভট্টাচার্য নিজ কন্যা ইন্দুবালা দেবী ও জামাইকে শহরের মিয়াপাড়ার নিজের জমি বিনামূল্যে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের পিতা সুরেশ চন্দ্র ঘটক শ্বশুরের জমি দানসূত্রে না নিয়ে কিনে নেন এবং জমির মালিকানায় স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই নাম রাখেন। মায়ের জন্ম শহরে বাবা নতুন বাড়ি তৈরি করার পর মূলত এ শহরটিই হয়ে ওঠে ঘটক পরিবারের স্থায়ী আবাসস্থল। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ঋত্বিক ঘটক কখনো কানপুর আবার কখনো কোলকাতায় কাটালেও মূলত সেই সময়ে তাঁর সিংহভাগ সময়ই কাটে এই শহরে।
রাজশাহী শহরে ঋত্বিক ঘটক যে পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেছিলেন তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাঁর জমজ বোন প্রতীতি দেবী বলেন, আমরা যখন রাজশাহীতে, সে সময় সেখানকার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল উঁচু মানের। পুঠিয়ার রাজা, নাটোরের মহারাজা, দীঘাপাতিয়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর শীতকালে সাহিত্য-সঙ্গীত সম্মেলন হত। এইসব সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন আমার বড় ভাই মনীশ ঘটক। আমাদের রাজশাহীর বাড়িতে এই সূত্রে, পদাপর্ণ ঘটেছে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ কুমার সান্যালের। শরৎচন্দ্রের কথা আমার মনে আছে। তিনি চা-কফি ছাড়া কিছু খেতেন না। এত শান্ত আর কথা এত কম বলতেন যে, আমি আমার দাদাকে বলি- ‘এই তোমাদের শরৎচন্দ্র? ইনি তো কথাই বলেন না।’ আমার বড় দাদার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন হুমায়ুন কবীর, সৈয়দ মুজতবা আলী, শেষোক্ত জনের চাচা আইসিএস এস. এম. আলী ছিলেন আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু। সে সময় রাজশাহীতে হিন্দু-মুসলমানের কোন বিভেদ ছিল না। ‘সা¤প্রদায়িক’ শব্দটাই কখনো শুনিনি। আমাদের বাড়িতে মুসলমান স¤প্রদায়ের জ্ঞানী-গুণীজনরা তো আসতেনই। সাধারণ শ্রেণীরও ছিল অবাধ প্রবেশ। হিন্দু-ছেলেদের পাশে বহু মুসলমান ছেলে আমাদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন। শিল্পী জয়নুল আবেদীনও আমাদের বাড়িতে থেকেছেন। মিউজিক কনফারেন্সে যোগ দিতে ৩৫ সালে এসেছিলেন ফয়েজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, তারাপদ ঠাকুর, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁরা আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। উদয় শঙ্করও এসেছেন। তাঁর সঙ্গে ঋত্বিকের ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরে ঋত্বিক উদয় শঙ্করের কলকাতার বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে।
শিশুকাল অবসানের পর, রাজশাহীর আলো-বাতাস টেনেই আমাদের কৈশোর-তারুণ্যের সবুজ পাতা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল।
ঋত্বিক ঘটকের বাড়িটা ছিল শিল্প ও সাহিত্যের বিখ্যাত সব ব্যক্তিদের একটি মহামিলন ক্ষেত্র। ফলে বেড়ে ওঠতে ওঠতেই তিনি প্রতিনিয়ত এই মহামিলন ক্ষেত্র থেকে নিজেকে ঋদ্ধ করতে থাকেন। সেই সাথে বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল পদ্মা। পদ্মা নদীর সাথে তাঁর এক আজন্ম সখ্যতা গড়ে ওঠেছিল। বিকেলে সুযোগ পেলেই জমজ বোন প্রতীতি দেবীর সাথে পদ্মার চরে দাপাদাপি করা ছাড়াও অনেক সময়ই তিনি রাতে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যেতেন। অনেক খোঁজাখুজির পরে তাকে প্রায়ই দেখা যেত রাতের অন্ধকারে পদ্মার পাড়ে মগ্ন হয়ে বাঁশি বাজাতে।
রাজশাহী শহরের পদ্মা পাড়ের নব্বই ঊর্ধ্ব কাউকে জিজ্ঞেস করলে এখনো জানা যায় যুবক ঋত্বিক যে করুণ সুরে বাঁশি বাজাতেন তা অনেকের হৃদয়ই বিদীর্ণ করে দিত। ঋত্বিক যখন এমন মগ্ন হয়ে বাঁশি বাজিয়ে চলতেন তখনই দিল্লী লাহোরের রাজনৈতিক নেতাদের চলছিলো দেশ ভাগের পরিকল্পনা। সেই সময়ই হয়তো ঋত্বিক ঘটক আঁচ করতে পেরেছিলেন এমন কিছু একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যার মূল্য দিতে হবে কোটি কোটি সাধারণ মানুষদের। সে জন্যই হয়তো ঋত্বিক ঘটকের আটটি কাহিনী চলচ্চিত্রেই দেখা যায় এক ধরনের বেদনার্ত ক্যানভাস।
ঋত্বিক ঘটক পদ্মাকে ভালোবেসেছিলেন আর একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন রাজশাহীর আলো বাতাসের সাথে। মূলত তাঁর চিন্তা চেতনার বিশেষ যে অবয়ব আমরা পরবর্তীতে লক্ষ্য করি, তা গড়েই উঠেছিল তাঁর রাজশাহীর দিনগুলিতে। বাড়ির একেবারে উত্তর পাশেই ছিল রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। দুরন্ত কিশোর ঋত্বিককে অনেক সময়ই খুঁজে পাওয়া যেত গ্রন্থাগারের টেবিলে। গ্রন্থাগারের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় তরুণ ঋত্বিকের উদ্যোগ ও পরিচালনায় মঞ্চস্থ হতে থাকে একটার পর একটা নাটক। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে জড়িয়ে পড়ার আগে আমরা ঋত্বিক ঘটককে একজন নাটকের মানুষ হিসেবে দেখি। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নাট্য আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে নেন। সেই সময় ঋত্বিক ঘটকের সহযোদ্ধাদের মধ্য অন্যতম ছিলেন শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অমর গাঙ্গুলী, বিজন ভট্টাচার্য, মৃণাল সেন, কালী ব্যানার্জী, সলিল চৌধুরী, কলিম শরাফী, হৃষিকেশ মুখার্জী প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় বোম্বে সম্মেলনে ঋত্বিক ঘটকের লেখা ‘দলিল’ নাটকটি প্রথম পুরস্কার পায়। ‘দলিল’ নাটকটি তাঁর ভাবনার যে জায়গাটা প্রবলভাবে স্পর্শ করেছিল সেটা হচ্ছে তাঁর ফেলে আসা রাজশাহীর স্মৃতি। রাজশাহীর পদ্মার পাড়েই মূলত ছিল তাঁর হৃদয়ের এক বিশাল রাজ্য। দেশ বিভাগের ফলে তাঁর সেই রাজ্যকে ছেড়ে আসতে হয়। ফলে ‘দলিল’ নাটকের মধ্য দিয়েই তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, ‘বাংলারে কাটিবারে পারিছ, কিন্তু দিলটারে কাটিবারে পার নাই।’
তরুণ বয়সের ঋত্বিকের কাছে পদ্মার উপস্থাপনা যে কত প্রবল ছিল তা আমরা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করি তাঁর শেষ বয়সের একটি উক্তিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং আরো বেশ কয়েকজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ওরা আমাকে, সত্যজিৎ বাবুকে এবং আরো কয়েকজনকে state guest করে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকায়। প্লেনে করে যাচ্ছিলাম, পাশে সত্যজিৎ বাবু বসে, যখন পদ্মা cross করছি, তখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।
পড়ন্ত বয়সে পদ্মা দেখে ঋত্বিক ঘটকের এই কান্নার পেছনের একটি ইতিহাস রয়েছে। আর সে ইতিহাস হচ্ছে, এ পদ্মা ছিল তাঁর জীবনের পরম সঙ্গী যাকে তিনি ধারণ করেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। পদ্মা তাঁর মনে এনে দিয়েছিল এক বিশালত্বের পৃথিবী, যাকে হারিয়ে তিনি আত্মিকভাবে শূন্য ছিলেন। ফলে আজীবন তিনি যে কয়েকটা চলচ্চিত্র বানিয়েছেন তাতে ঘুরে ফিরেই এসেছে পদ্মা নদী। ‘কোমল গান্ধার’ (১৯৬১) ছবির শুরুতেই মঞ্চস্থ নাটকের বাস্তুত্যাগী বৃদ্ধ বলে উঠেন, আমি ক্যান্ এই পদ্মা ছাইড়া যাবো! আমি ক্যান আমার বাপ দাদার ভূমি ছাইড়া যাবো!’ ঋত্বিক ঘটক তাঁর ছবির কিছু চরিত্রই তৈরি করেছেন তাঁর বিপ্তি মনোজগতের চাপা পড়া কথাগুলো সবাইকে জানিয়ে দেবার জন্য।
রাজশাহীর আলো-বাতাসে বড় হওয়া ঋত্বিক রাজশাহীকে ভালোবেসেছিলেন, আর ভালোবেসেছিলেন বাংলাকে। ফলে তাঁর প্রিয় শহরটি ছেড়ে যাওয়ার বেদনা নিয়ে তিনি যে ছবিগুলো নির্মাণ করেন সেগুলোর প্রায় সবকটিই ছিল তাঁর মত বেদনাকান্ত মানুষগুলোর ছবি। রাজশাহী শহর ও পদ্মা তাঁর মনে এমন এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল যে ১৯৭১ সালের মুুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি যে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন তার নাম দেন ‘দুর্বার গতি পদ্মা’। মূলতঃ পদ্মা তাঁর মনোজগতে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল তা প্রভাবিত করে তাঁর চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণ এবং সাহিত্য রচনায়। এটাও বলা যেতে পারে, তাঁর চলচ্চিত্র ও লেখাগুলো এমন একটা বিশেষ ধারায় যাচ্ছিল, যার মূলে ছিল তাঁর নিজভূমি থেকে শেকড়চ্যুত হওয়া।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ যেসব লক্ষ কোটি মানুষদের শেকড়চ্যুত ও নিঃস্ব করেছিল, ঋত্বিক ঘটকও ছিলেন তাঁদেরই একজন। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে জোরপূর্বক অভিবাসন মানুষের জীবনে যে কি ভয়াবহ পরিণতির কারণ হতে পারে ঋত্বিক তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তার উপলব্ধিজাত বোধ থেকেই তিনি সমষ্টির কথা বলতে চেয়েছিলেন আর সমষ্টির ব্যথা ধারণ করতে চেয়েওছিলেন। আর সেই কারণেই তিনি আজীবন সেলুলয়েডের ফিতেয় এসব তুলে আনতে চেয়েছিলেন। তাঁর আটটি কাহিনী চলচ্চিত্রে আমরা লক্ষ করি মূল চরিত্রগুলো এক রকম গৃহহারা। অথবা নতুন গৃহের সন্ধান করে বেড়াচ্ছে। আর এই নতুন গৃহ মানেই তাঁর মনোজগতে লুকিয়ে থাকা পদ্মার ধারে সেই বাড়ি যেখানে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রথম ভাগ।
দেশ ভাগের ফলে রাজশাহী শহরের যে বাড়িটি ঘটক পরিবার ১৯৪৮ সালে ছেড়ে গিয়েছিলেন সেখানে ঋত্বিক আর ফিরে আসেননি। ১৯৭২ সালের পর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বেশ কয়েকবার তিনি বাংলাদেশে আসেন। কিন্তু তিনি রাজশাহীতে আসেননি। হয়তো একজন পাশপোর্টধারী বিদেশী হয়ে তিনি তাঁর নিজের গৃহের সামনে এসে দাঁড়াতে চাননি। অথবা তাঁর মনোজগতে নিরন্তর যে গৃহের ছবি সদা জাজ্বল্যমান ছিল সেটার আলো তিনি নিভিয়ে ফেলতে চাননি। (চলবে)