মূল: কার্ল হফ্ম্যান – ভাষান্তরে: সেলিম হিমাদ্রি
sheemadri@gmail.com

গৌরচন্দ্রিকা
সবে তো মাত্র শুরু

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
“চলুন,” নাসিরভাই তাগাদা দিলেন,“সেই সকাল ৫টায় উঠে গেছি। সবকিছুর আগে চা-নাস্তা খেতে হবে।”
ক্যাফের টেবিলটপ মার্বেল পাথরের, দে’য়াল জুড়ে আয়না। ওয়েটারদের পড়নে লুঙ্গি, মাথায় কুশিকাঁটায় বোনা গোল টুপি এবং সবার গালে পেল্লায় দাড়ি।
“এই ক্যাফেটা অনেক পুরানো,” চা খেতে খেতে নাসিরভাই ইতিহাস বলছেন,“ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। এখনও একটুও বদলায় নি।”
সকালের ব্যস্ত ট্রেনযাত্রাটা গেল চার্চগেট লাইনে উঠানামা করে। ভিড় সেই আগের দিনের মতোই। ধস্তাধস্তি, হুড়োহুড়িতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
দুপুরের পর পর ভিক্টোরিয়া টার্মিনাসের কাছে সেন্ট জর্জ হাসপাতাল এসেছি।
“চলুন কিছু মরা দেখে আসি,” নাসিরভাই ভাবলেশহীন গলায় বললেন,“আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাবেন ট্রেনের বলি।”

কথাটা একেবারে বেমানান এবং অসম্ভব শোনালো। তারপরও, নাসিরভাই নাছোরবান্দা। হাসপাতালে তাঁর নাকি চেনাজানা লোকজন আছে, দেখার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে।
প্রথম দেখায় হাসপাতালটাকে একটা বিশাল জগদ্দল পাথরের স্তুপ মনে হয়। ১৯০৮ সনে ব্রিটিশ রাজ তৈরি করে। খিলান করা সবক’টা জানালা খোলা – গুমোট গরম, ধূলা অবাধে ঢুকছে।

খোলামেলা একটা হল – কেমন যেন শুনশান নিরবতা – উপরের সিলিং ফ্যানগুলি ভারি আদ্রতা, গরম খেদানোর চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কিছু পাখির কিচির মিচিরে মনে হয় এখানে প্রাণ আছে। হুইলচেয়ারে বসা একজনের মাথায় ব্যান্ডেজ – ভৌতিক সিনেমার কোনো চরিত্রের জন্য একদম মানানসই। আর একজন ষ্ট্রেচারের উপর শুয়ে।
নাসিরভাই কয়েকজনের সাথে কথা বলে তাঁর বন্ধুর হদিস বের করতে চেষ্টা করছেন। কয়েকটা করিডোর ঘুরেফিরে জানতে পারলেন তাঁর বন্ধু হাসপাতালে নেই – সে-ও নাকি ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে! ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। তবে, নাসিরভাই আমার যোগসূত্রটা ধরতে পারলেন না।

“ঘাবড়াও মাৎ,” সাহস দিলেন, “সবাই আমাকে চেনে। আমি বলামাত্র দেখার ব্যবস্থা করে দিবে। আসুন আমার সাথে। আমার কথা কেউ ফেলতে পারবে না।”
তাঁর কথাই ঠিক, একটুও বাড়িয়ে বলেন নি। তাঁকে দেখামাত্র হাসপাতালের অনেক কর্মচারী যেচে কথা-বার্তা বলছে। কেউ কেউ কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে। বাৎচিতে সন্তুষ্ট হয়ে বাজখাই গলায় বললেন,“চলুন দেখি।” আমিও মুখ বুজে তাঁর পিছু নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলাম।

লম্বা সিঁড়ি ভেঙ্গে হাসপাতালের চৌহদ্দীর বাইরে এসে ঢুকেছি একটা গলিতে। হাসপাতালের সীমানা ঘেঁষে গলির দু’পাশে বস্তি, কিছু পাঁকা ভিটাবাড়ি। বড় বড় দাঁড় কাকের মাথার উপর একটানা কাঁ কাঁ। রোঁয়া ওঠা কয়েকটা কুত্তি দুপুরের রৌদ্রের তোড়ে জিহ্বা বেড় করে হাপাচ্ছে। পোঁড়া কাঠ-কয়লার সাথে মিশেছে কাঁচা ময়লার পেট উগরানো গন্ধ – গলির ভিতর আটকে আছে। কয়েকটা হাঁস-মুরগী আবর্জনায় ঠোঁট ডুবিয়ে রত্ন খোঁজে।
৮ ফুট উঁচু একটা দেয়ালের সামনে এসে নাসিরভাই থামলেন। ঝুল-কালি, ছত্রাকে দে’য়ালের আসল রং বোঝা দায়। লোহার গেটটা এক কব্জার উপর ভর করে কোনোমতে টিকে আছে – নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব থেকে অনেক আগেই মুক্ত। একেবারে খুলে পড়ার ভয়ে বোধ করি ইচ্ছে করেই একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

মূল বিল্ডিংয়ের ছাদ টিনের। সামনের খালি জায়গাটা ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল, কাটা ডাল-পালা আর অকেজো টায়ারের দখলে। দাঁড় কাকগুলির রাজত্ব্য সবখানে – দেখছে, অপেক্ষায় আছে। কর্কশ ডাকে জানান দেয় – তারা আছে আমাদের সাথে।
আমরা এসেছি হাসপাতালের মুর্দাঘরে – লাশ কাটা ঘর। বাইরে বেঞ্চে বসা দু’জন লোকের সাথে খুব দ্রুত গলায় হিন্দিতে আলাপ করছেন নাসির ভাই।

“কার্ল, বসেন,” নাসিরভাই নির্দেশ দিয়ে নতুন দু’জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন – বয়স্কজন সন্তোষ, তার ছেলে, সঞ্জয়। সন্তোষের বয়স ৫৫, লম্বা গরণের মুখ, টিঁকালো নাক, প্রায় রোমানদের মতো, চিকণ গোঁফ। হাফ-প্যান্ট, কাঁচাপাকা চুলে মেহেদী, তার উপর নাইকে গল্ফ ক্যাপ, পায়ে ছেড়াখোড়া স্যান্ডেল। সঞ্জয়ের বয়স ২৫, চোখে হাল ফ্যাসানের সানগ্লাস।

নাসিরভাই পকেট থেকে মটর দানার সমান ভাং এবং কল্কে বের করে দিলেন। ঝিম মারা গরমের মধ্যেও বাপ-ছেলে ধুমছে কল্কে টানছে। মাথার উপর কাঁকের কাঁ কাঁ। হিন্দিতে বাৎচিত শেষ হতে নাসিরভাই বললেন,“বাপ-ছেলে পেশায় ডোম, হাসপাতালের সব ময়নাতদন্তের কাটাছেড়ার দ্বায়িত্ব তাদের। আপনার কী জানতে বা দেখতে ইচ্ছে হয় বলুন, সব বলবে, সাথে মর্গটা ঘুরিয়েও দেখাবে।”

সন্তোষ আমাকে নিয়ে লাশ কাটা ঘরে ঢুকেছে: ২০ বর্গ ফুটের, পাঁকা মেঝে হলেও স্যাঁতস্যাঁতে ভাব দূর করতে কোনো ধরনের বিশেষ রংয়ে লেপা হয় নি। দেয়ালের অবস্থা আরও খারাপ – সময়ের ছাপে কালো এবং ছত্রাকে ঢেকে আছে। ঘরের মাঝখানে মার্বেলের দুই টেবিল – অবশ্যই ময়নাতদন্তের জন্য।

ঘরের এক কোণার কয়েকটা তাকে অগোছালোভাবে রাখা প্লাষ্টিকের বৈয়াব।
“পিত্ত,” একটা বৈয়াম দেখিয়ে সন্তোষ বলল। দেখতে মনে হয় রক্তে চুবানো এক টুকরা স্পঞ্জ। “নাড়িভ‚ঁড়ি, হৃদপিন্ড। সবক’টা বৈয়াবে শরীরের কোনো না কোনো অংশ রাখা আছে।”
সাদা এনামেলের একট ট্রেতে ষ্টেইনলেস ষ্টিলের হাতুড়ি, বাটাল, কাঁচি – সবগুলিতে গভীর কালো দাগ, দানা দানা কিছু লেগে আছে। আতঙ্ক গ্রাস করছে আমাকে: একধারে প্রচন্ড গরম-ঠান্ডা লাগছে।
“প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৩ টা লাশ পাই ট্রেনের কারণে,” সন্তোষ বলল,“প্রায় ৭৫ ভাগের কোনো নাম-ঠিকানা নেই, বেওয়ারিশ হিসেবে খাতায় টুকে রাখতে হয়। কিছু কিছু লাশ আসে একেবারে ছিন্নভিন্ন – চিনবার উপায় থাকে না। আত্মহত্যাকারীর লাশ, বেহেড মাতালের ট্রেনে কাটা লাশ। কিছু আসে বয়স্ক লোকজনের – ভিড়ের মাঝে পড়ে দিশেহারা, সোজা হার্ট এটাকে মারা যায়।” কোনো এক ফাঁকে দরজা খোলা দেখে একটা হাঁস ভিতরে ঢুকে প্যাঁক প্যাঁক করছে।

মৃত্যু – বিভৎস, উৎকট মৃত্যু – ভারী করে রেখেছে ঘরটাকে।
কতই না আচার-অনুষ্ঠান, কতই না গাল ভরা বিশেষণ, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত, মহিমান্বিত, গৌরবগাঁধা – একাধারে দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিংরানো অভিব্যক্তি, আবার পরম পূঁজনীয় আরাধনার বেদীতে আসীন – সব ঘটছে দুর্জ্ঞেয়, দুর্বোধ্য এক সত্তাকে ঘিরে – মৃত্যু – একমাত্র ভারতেই তার ভয়াল চরিত্রের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ধরা পড়ছে। পার্থক্য এ’টুকু, আমি যেন মৃত্যুটাকে দেখছি পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো কোনো একজনকে দেখার মতো করে।

এক মিনিট আগে আপনি ট্রেনে উঠেছিলেন কাজে যেতে অথবা পরিবার-পরিজনসহ বেড়িয়েছেন হাওয়া খেতে, স্মরণীয় সময় কাটাতে। পরের মিনিটে আপনি আবিস্কার করলেন শুয়ে আছেন নোংরা এই লাশ কাটা ঘরের লাশ কাটা টেবিলে। (চলবে)