ভজন সরকার : বাংলা সাহিত্যকে জনপ্রিয় এবং সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বিখ্যাত লেখকদের পাশাপাশি অনেক অখ্যাত-অজ্ঞাত লেখকদের অবদানও অনস্বীকার্য। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রচিত দূর্বল প্রকাশনী থেকে সস্তা দামের এ সব বইপত্র বইয়ের “বাজার” এবং পাঠককে বই পড়ার উৎসাহের ক্ষেত্রে এক বিরাট ভ‚মিকা রেখেছে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই প্রকাশিত হওয়া এ সমস্ত বইকে “বটতলার বই” বলা হয়ে থাকে।

বটতলার বই নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক গবেষণা হয়েছে। সুকুমার সেনের পর অদ্রীশ বিশ্বাসকেই বলা যেতে পারে বটতলার বইয়ের যোগ্য গবেষক। বয়সে তরুণ অদ্রীশ বিশ্বাস ভারতের পশ্চিমবংগের উত্তরবংগের রায়গঞ্জের এক মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গবেষণা করেছেন, “জনপ্রিয় সাহিত্যঃ বটতলা থেকে বাঁটুল দি গ্রেট” বিষয়ে। গবেষণার নাম দেখেই অনুমান করা যেতে পারে বটতলার বই নিয়ে লেখার অধিকার তাঁরই।

“বটতলার বই : প্রথম খন্ড” বইটিতে উনিশ শতকের বিশটি দুস্প্রাপ্য বটতলার বই সংকলিত হয়েছে। বটতলার বই কিংবা বিষয়টি নিয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের এ বইটি এবং অদ্রীশের লেখা গবেষণালব্ধ ভ‚মিকাটি পড়া জরুরী শুধু নয়, আবশ্যিকই বটে। ভ‚মিকাতে আছে সুকুমার সেনসহ এ বিষয়ে অনেক পন্ডিতজনের লেখার উদ্ধৃতি। যেমন, বটতলার বই নামটি কেমন করে এলো, কলকাতার সে সময়ের ছাপাখানার ইতিহাস, বটতলার বইয়ের ভাষা, বিজ্ঞাপন, বিক্রিবাট্টার সমাচার, বটতলার বইয়ের বিষয় এ সব বিষয়ে অজানা-অচেনা বিষয়।

আমি সে ভ‚মিকা নিয়ে আলোচনা করবো না। শুধু এই বিশটি দুস্প্রাপ্য বইয়ের নাম, লেখক, প্রকাশনার কাল-স্থান এবং মূল্য এগুলো অদ্রীশ বিশ্বাসের বই থেকে হুবহু তুলে দেবো। এ তথ্য থেকেই উনিশ শতকের বটতলার বই নিয়ে একটা সম্যক ধারণা পাঠক পেতে পারবেন। যেহেতু তখন প্রকাশ কাল বংগাব্দ (সাল) কিংবা শকাব্দে লেখা হতো, আমি তাই খ্রিষ্টাব্দও উল্লেখ করবো।বানান রীতিও উল্লেখিত বইগুলোতে যেভাবে লেখা সে রকমই এখানে রাখবো।

১। ভাঙ্গাগাঁয়ের মড়ল। শ্রীলোকনাথ নন্দী কর্তৃক বিরচিত। কলিকাতা। সমাচার সূধাবর্ষণ যন্ত্রে মূদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৪ (১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ)। (যাঁহার এই পুস্তক প্রয়োজন হইবেক তিনি বড় বাজারের শিবতলা গলিতে ১। ৯ নং শ্রীযুক্ত বাবু সাতকড়ী নন্দীর ভবনে অনুসন্ধান করিলে প্রাপ্ত হইবেন।) মূল্য ০ আনা মাত্র।
২। কৌতুক শতক। প্রথম ভাগ। “-অরসিকেষু রহস্য নিবেদনং শিরসি মালিখ মালিখ মালিখ।” শ্রীহরিশ্চন্দ্র মিত্র কর্তৃক সংগৃহীত। ঢাকা। নতুনযন্ত্রে মুদ্রিত। ১২৬৯ সাল (১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্য /০ আনা মাত্র।

৩। চোরের উপর বাটপাড়ি। শ্রীমহেশ্চন্দ্র দাস দে প্রণীত। শ্রীনৃত্যলাল দের আদেশানুসারে। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ ( ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

৪। কিসে নাই কি পান্তা ভাতে ঘি। শ্রীমহেশ্চন্দ্র দাস দে প্রণীত। শ্রীঈশ্বরচন্দ্র দাসের আদেশানুসারে। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ ( ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

৫। পড়-বাবা আত্মারাম। শ্রীমহেশ্চন্দ্র দাস দে প্রণীত। শ্রীশ্রীনাথ লাহার আদেশানুসারে। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ ( ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

৬। নেশাখুরি কি ঝকমারি। নাটক। শ্রীমহেশ্চন্দ্র দাস দে প্রণীত। শ্রীশেখ জমিরুদ্দীন কর্তৃক প্রকাশিত। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /১০ আনা মাত্র।

৭। কোনের মা কাঁদে আর টাকার পুঁটলি বাঁধে। নাটক। শ্রীভোলানাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত। শ্রীআনন্দলাল শীলের অনুমত্যানুসারে। কলিকাতা। হিন্দুপ্রেস। নং ৯২ আহিরীটোলা। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্য। ১০ আনা মাত্র।

৮। কলির বউ ঘর ভাঙ্গানী। ভ‚পতিপুর নিবাসী শ্রীমুন্সী নামদার প্রণীত। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

৯। কাশীতে হয় ভ‚মিকম্প নারীদের একি দম্ভ। নাটক। শ্রীমুন্সী নামদার প্রণীত। শ্রীকাজী সফিউদ্দিনের অনুমত্যানুসারে। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। (এই পুস্তক চাঁদনীর ১ নং গলিতে তত্ত¡ করিলে পাইবেন। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

১০। বৃদ্ধা-বেশ্যা তপস্বিনী। কাব্য। শ্রীযুত রামকৃষ্ণ প্রণীত। শ্রীবেহারিলাল দের আদেশানুসারে দ্বিতীয়বার প্রকাশিত। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

১১। হুডকো বউয়ের বিষম জ্বালা। নাটক। শ্রী রামকৃষ্ণ সেন প্রণীত। শ্রীনৃত্যলাল শীল কর্তৃক প্রকাশিত। কলিকাতা। সাহস যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /১০ আনা মাত্র।

১২। লুকয়ে পিরীত কি লাঞ্ছনা। আদ্যরসাশ্রিত কাব্য। শ্রীনন্দলাল দত্ত প্রণীত। কলিকাতা। চিতপুর রোড বটতলা ২৪৬ নং ভবনে বিদ্যরারত্ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দা : ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। শ্রীঅরুনোদয় ঘোষ প্রকাশিত ও মুদ্রিত।

১৩। রোগের মত ওষধি। নাটক। শ্রীসন্ন্যাসিচরণ পাল কর্তৃক বিরচিত।
কলিকাতা। সাহস যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /১০ আনা মাত্র।

১৪। বাল্যবিবাহ উচিত নয়। নাটক। শ্রীযুক্ত ক্ষীরোদগোপাল মিত্র প্রনীত। শ্রীযুক্ত ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় দ্বারা বিবেচিত ও সংশোধিত হইয়া প্রণেতার আদেশানুসারে প্রথম্বার মুদ্রিত হইল। কলিকাতা। সাহস যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ সাল (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ ৯০ দুই আনা।

১৫। রাঁড় ভাঁড় মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা। নাটক। বাদু মহেশ্বরপুর নিবাসী শ্রীপ্যারিমোহন সেন প্রণীত। কলিকাতা। শীল এন্ড ব্রাদার্স যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)।

১৬। কি মজার কলের গাড়ি। নাটিক। শ্রীমুন্সী আজিমদ্দীন প্রণীত। শ্রী কাজী সফিউদ্দিনের আদেশানুসারে। কলিকাতা। গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে এঙ্গো ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত। শকাব্দাঃ ১৭৮৫ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ) (এই পুস্তক চাঁদনীর ১ নং গলিতে তত্ত¡ করিলে পাইবেন।) মূল্যঃ /০ আনা মাত্র।

১৭। ইয়ং বেঙ্গল ক্ষুদ্র নবাব। কাব্য। কলিকাতা। হিন্দুপ্রেস। নং ৯২ আহিরীটোলা। শকাব্দাঃ ১৭৮৫(১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)।

১৮। কি মজার শনিবার। কাব্য। শ্রীচন্দ্রকান্ত শিকদার প্রণীত। শ্রীগংগাধর শীল দ্বারা প্রকাশিত। শ্রীমধুসূদন শীল দ্বারা চৈতন্যচন্দ্রোদয় যন্ত্র মুদ্রিত। ৩১৯ নং চিতপুর রোড । কলিকাতা। বংগাব্দ ১২৭০ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)।

১৯। হদ্দ মজা রবিবার। নাটক। বাঘাডাংগা নিবাসী শ্রীশ্যামাচরণ শান্যাল প্রণীত। “সাধিতে দেশের হিত করিয়াছি পণ। মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পতন।” কলিকাতা। শীল এন্ড ব্রাদার্স যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)।

২০। শুনেছ? হনুমানের বস্ত্রহরণ!! শ্রীশ্যামাচরণ শ্রীমানী। একটী উপকথা মাত্র। অজ্ঞতা কুসংস্কার প্রবল যাহার। নিয়ত উথলে তার দুঃখ পারাবার। হিতৈষী জানায়ে লোক করিতেছে ছল। আকাশে চরিল মীন ত্যজিয়া কমল!! কলিকাতা। সাহস যন্ত্রে মুদ্রিত। সন ১২৭০ সাল (১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দ)। মূল্যঃ /১০ আনা মাত্র।

উপরের এ বিশটি বইয়ের নাম, লেখক-পরিচিতি এবং প্রকাশনার তথ্য থেকে উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য এবং সাহিত্যে সমাজের সমসসাময়িক বিষয় কিভাবে তুলে এসেছে সে বিষয়ে একটা ধারণা আমরা পাই। বই যে প্রচলিত সামাজিক বিষয়কে পাঠকের কছে পৌঁছে দিতে এবং জনমত সৃষ্টিতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে, সে ধারনাও সুস্পষ্ট হয় বইগুলোর নাম থেকে।

যেমন, “কোনের মা কাঁদে আর টাকার পুঁটলি বাঁধে” নাটিকাটি উচ্চ পণ নিয়ে মেয়ে বিয়ে দেয়ার সামাজিক প্রথাকে ব্যঙ্গ করে লেখা; “রাঁড় ভাঁড় মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা” সে সময়ের কলকাতা শহর তথা নাগরিক জীবনকে নিয়ে লেখা নাটক; “কি মজার কলের গাড়ি” বইটি তখন সদ্য প্রতিষ্টা পাওয়া রেলগাড়ি নিয়ে মানুষের কৌতুহলকে কেন্দ্র করে রচিত।

বটতলার বইগুলো শুধু যে শহরের মধ্যবিত্তদের কাছে সে সময় জনপ্রিয় ছিল তাই নয়, গ্রামের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষজনের মধেও এর পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছিল ভাষার সহজতা ও বিষয়বস্তুর সমসাময?িকতার জন্য।

উপরের বিশটি বটতলার বইয়ের ঊনিশটিই প্রকাশ হয়েছে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রতি বছর এ রকম অসংখ্য বই পাঠকের পাঠস্পৃহা মিটিয়েছে সে সময়। পুস্তক প্রকাশনা যে একটি ব্যবসা এবং লাভজনক ব্যবসা বটতলার বই দিয়েই মূদ্রাযন্ত্রের মালিক ও প্রকাশকেরা সেটা প্রতিষ্টা করে গেছেন তখন। তাই আজকের বাংলাসাহিত্যের এ অবস্থা ও অবস্থানের পেছনে বটতলার বই বাজার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্টদের অবদানকে খাঁটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই)

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)