সুহেল ইবনে ইসহাক : শত ব্যস্ততার মধ্যেও কানাডার টরোন্টোতে বাঙালীদের মধ্যে অনেক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে আসন্ন ঈদুল ফিতরের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে। চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে হয়তো আগামী সোমবার ২ মে কানাডার মুসলিম সমাজ পবিত্র ঈদুল ফেতর উদযাপন করতে যাবেন। উত্তর আমেরিকার ফিকাহ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগামী রবিবার ১ মে হচ্ছে এবারের ঈদুল ফিতর। আর হিলাল কমিটির সিদ্ধান্ত যদি চাঁদ দেখা স্বাপেক্ষে মিলে যায় তাহলে আমরা সবাই আগামী রবিবারই পবিত্র ঈদুল ফেতর উদযাপন করতে যাচ্ছি। কানাডার টরন্টোতে ডেনফোর্থ এরিয়া এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে যায় কোন উৎসবের মহামিলনে, ঈদ তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলা অনেক খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট, কাপড়ের দোকান, গ্রোসারি দোকান রয়েছে বাংলা সাইনবোর্ড ঝোলানো, যেখানে বাঙালি সংস্কৃতির পোশাক পরিচ্ছেদ খাবার-দাবার পাওয়া যায়। ঈদের মৌসুমে এসব দোকানগুলোতে ক্রেতাদের প্রচন্ড ভীড় দেখে মনেই হয় না কানাডার টরন্টোতে আছি, তখন মনটা চলে যায় সেই লাল-সবুজ দেশের কোনো এক ঈদের বাজারে। চিত্ত মাঝে অন্যরকম এক নস্টালজিয়া কাজ করে। স্মৃতির জানালা দিয়ে অবগাহন করি বাংলা মাকে। তাছাড়া চাঁদ রাতের বাঙালীপাড়া খ্যাত ডেনফোর্থ এলাকাটি মেহেদির সুগন্ধে বিমোহিত হয়ে পড়ে। অজানা এক পবিত্র শিহরণ অনুভূত হয় তখন হৃদয় মাঝে। স্থানে স্থানে বসে মেহেদী দিয়ে হাত রাঙানোর পসরা। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধের অনেকেই মেহেদির রঙে হাত রাঙানোর স্বাদটা মিস করতে চান না। যদিও কানাডাতে ঈদের দিনটি সরকারিভাবে ছুটির দিন নয়, তবুও অনেকেই এই দিনটিতে ছুটি নিয়ে রাখেন ঈদের আনন্দটাকে উপভোগ ও বিনিময় করতে। আর যারা ছুটি নিতে পারেন না বা ছুটি নেন না তারাও সকাল বেলা ঈদের নামাজে হাসিমুখে হাজির হন ঈদের আনন্দটাকে উপভোগ ও বিনিময় করতে। এবং পর পরই তাদেরকে চলে যেতে হয় চাকুরীর গন্তব্যে। এভাবেই নানান বৈচিত্রে, ব্যস্ততার মধ্যেও কানাডার মুসলিম সমাজ বিশেষ করে বাঙালিরা প্রবাস জীবনের নানান প্রতিক‚লতায় ঈদের আনন্দ বিনিময় করে থাকেন। কিন্তু কোভিড-১৯ এর কারণে গত দু’বছর সেই আনন্দে ভাটা পড়েছিল।

ঈদের দিন সকালে দফায় দফায় জামাতে নামাজ পড়ার ব্যবস্থাও থাকে। নামাজ শেষে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলির দৃশ্য বাংলাদেশের ঈদ জামাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।
বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা ঈদ উদ্যাপনের আয়োজন শুরু করে রোজার শুরু থেকে। পুরো এক মাস রোজা শেষে ঈদের আনন্দ উপচে পড়ে মুসলিম কমিউনিটিতে। অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটির লোকজন মসজিদ কেন্দ্রিক ঈদ উদ্যাপন করে থাকে। নারী-পুরুষ সকলেই মসজিদের গিয়ে নামাজ আদায় করে ঈদ কোলাকুলি পর্ব শেষে বিশাল খাবারের আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে সোমালিয়া জ্যামাইকা, সৌদি আরব, সাউথ আফ্রিকার মুসলিম স¤প্রদায় এমনকি মিডল ইস্টের মুসলিম উম্মাহর লোকজনও অংশগ্রহণ করে থাকে। তবে বেশির ভাগ বাঙালি চলে যায় বাংলা টাউনে। ঈদকে ঘিরে হয় বাঙালির পুনর্মিলনী।

মিশ্র জাতি গোষ্ঠীর দেশ কানাডা। সমগ্র পৃথিবী থেকে আসা প্রায় সব দেশের মানুষের সমাগম এখানে। ভিন্নভিন্ন শিল্প, সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে এই দেশ, যেখানে রয়েছে সৌহার্দ্য, স¤প্রীতির নিবিড় বন্ধন। তার মধ্যে মুসলিম উম্মাহর ঈদ আনন্দ সংযোজন বিশেষ দৃষ্টি কাড়ে। যেহেতু সমঅধিকারের দেশ কানাডা, তাই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব রকম সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিভিন্ন অর্গানাইজেশনেরও ব্যবস্থা আছে। ঠিক সেভাবে মুসলিম উম্মাহর মানুষদের জন্যও সুবন্দোবস্ত রয়েছে, রয়েছে ধর্ম, অধর্ম পালনের অবাধ স্বাধীনতা। এখন ঈদের দিন বিশেষভাবে ছুটি দিতে বাধ্য, তাই যার ইচ্ছে সে ছুটি নিয়ে ঈদ উদ্যাপন করছে। তবে যেহেতু ঈদ একদিনে হচ্ছে না বা বছরে একই দিনে পালিত হচ্ছে না সেই কারণে ঈদের দিন সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণাও সম্ভব হচ্ছে না।
কানাডায় ঈদ আনন্দ এখন বেশ সমাদৃত। যেভাবে আমরা বলি, ধর্ম যার-যার, উৎসব সবার। ঠিক একই মানসিকতায় ঈদের আনন্দ অনেক ভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। যার ফলে কানাডা সরকার প্রধানের ঈদ শুভেচ্ছা পাই, এমনকি বিভিন্ন ঈদ আনন্দেও প্রধানমন্ত্রীকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। যে কোনো আনন্দ উচ্ছ¡াসে জাতি, ধর্ম, বর্ণের কোনো বালাই থাকে না। আনন্দ যেন সংক্রমিত হতে থাকে তার নিজ ইচ্ছায়, যেন প্রকৃতির মতো।

ঈদুল ফিতর মুসলিম বিশ্বে বড় ধর্মীয় উৎসব। রমজানের শুরু থেকেই এ দিনটির জন্য মুসলিম বিশ্ব অপেক্ষা করে থাকে। দীর্ঘ এক মাস সংযম ও ত্যাগের সাধনার পর প্রতীক্ষা ঈদের চাঁদের। আনন্দের আবহ নিয়ে দ্বারপ্রান্তে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঘরে ঘরে খুশির বার্তা পৌঁছে দিতে আসে ঈদুল ফিতর। বিশ্বের মুসলিম সমাজকে ঐক্যের পথে, কল্যাণের পথে, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত করে এই ঈদুল ফিতর। ইসলাম ধর্মমতে, ঈদ আসে এবাদত ও মানব কল্যাণের বার্তা নিয়ে। ঈদের আগে রমজান মাসটি হচ্ছে সংযম ও প্রশিক্ষণের মাস। ফিতরা প্রদান, জাকাত আদায় ও ঈদের নামাজের ভেতর দিয়ে এমন কিছু কাজ এবং আচরণ প্রদর্শন করতে হয়, যার প্রভাব পড়ে সারা জীবনে। বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য রমজানের শিক্ষা অপরিহার্য। ঈদুল ফিতর আমাদের সেই বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষাই দেয়।

ঈদুল ফিতর বিশ্ব মুসলিম মননে মাহে রমজানের এক মাস নফসের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ করার পর বিজয় আনন্দ অনুভব নিয়ে আবির্ভূত হয়। “ঈদ” শব্দটির শব্দমূল হচ্ছে ‘আউদ’। এই “আউদ” শব্দের অর্থ ফিরে ফিরে আসা, পুনরাবৃত্ত, পুনরানুষ্ঠিত ও রীতি। ঈদ প্রতিবছর চন্দ্র বর্ষ গণনার হিসাবে নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী ফিরে আসে মুসলিম দুনিয়ায় এক অনন্য বৈভব বিলাতে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব আনন্দ-উৎসব রয়েছে, আমাদের আনন্দ-উৎসব হচ্ছে ঈদ।” সর্বপ্রথম ঈদুল ফিতর পালিত হয় দ্বিতীয় হিজরির পহেলা শাওয়াল শুক্রবার মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ গাযওয়ায়ে বদরে বিজয় লাভের ১৩ দিন পর এবং সর্বপ্রথম আল্লাহর দেওয়া সিয়াম বিধান রমাদানের এক মাস বাস্তবায়নের বিজয় অনুভূতি নিয়ে। ঈদুল ফিতরের মূল তাৎপর্য বিভেদমুক্ত জীবনের উপলব্ধি। ভুল-ভ্রান্তি, পাপ-পঙ্কিলতা মানুষের জীবনে কম-বেশি আসে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। কিন্তু পরম করুণাময় চান মানুষ পাপ ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে সৎপথে ফিরে আসুক। ঈদুল ফিতর মানুষকে এই শিক্ষা দেয় ওহজরত আনাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত একখানা হাদিসে আছে যে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে জানতে পারেন যে, এখানকার অধিবাসীগণ বছরে দুটি দিন খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসব উদযাপন করে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে জানতে চাইলেন, এই যে দুটি দিন উৎসব করো তা কিসের জন্য? তারা বললেন, জাহিলিয়াতের যুগে এই দু’দিন আমরা খেলাধুলা, আমোদ-ফুর্তি ও আনন্দ-উৎসব করতাম। এ কথা শুনে তিনি তাদের বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের দু’দিনের বদলে দুটি উত্তম দিন দান করেছেন আর তা হচ্ছে কোরবানির দিন এবং সিয়াম ভাঙার দিন। ঈদুল ফিতর বা সিয়াম ভাঙার উৎসব এমন এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ-সৌকর্যমণ্ডিত, যা মানবতার বিজয়বারতা ঘোষণার পাশাপাশি আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথ নির্দেশ করে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষ সৃষ্টি করেছেন শুধু তাঁরই ইবাদতের জন্য। মানুষ পৃথিবীতে আসার হাজার হাজার বছর আগে সব মানুষের রুহের কাছ থেকে আলমে আরওয়া বা আত্মার জগতে আল্লাহ শপথ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সমস্ত আত্মাকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন : আমি কি তোমাদের রব নই? সব আত্মাই এক বাক্যে বলেছিল : হ্যাঁ, আপনিই আমাদের রব। এই অঙ্গীকারবদ্ধ মানব রুহ পৃথিবীতে বিশেষ আকৃতির দৈহিক কাঠামোয় অবস্থান গ্রহণ করে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পৃথিবীতে আগমন ঘটে। আল্লাহর কাছে সে যে অঙ্গীকার করেছিল, পৃথিবীতে এসে তা রক্ষা করার মধ্যেই মানব জীবনের সার্থকতা। ঈদুল ফিতর সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ঈদুল ফিতরের দিনে আল্লাহর হক আদায়ের পাশাপাশি বান্দার হক আদায় করারও বিধান সমানভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ধনী-গরিব, আমির-ফকির, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু সব মানুষ মিলে একই আনন্দ অনুভবে এক মহাঐক্য ও সংহতির মিলন মোহনায় এসে দাঁড়াবার এক অনন্য ব্যবস্থা এই পবিত্র ঈদুল ফিতর। মাহে রমজানের এক মাস দিবসের সবটুকু সময় সিয়াম পালনের মাধ্যমে রোজাদার সংযম, সহনশীলতা, দয়া, সমবেদনা ও সৌভ্রাতৃত্বের যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে, তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার যে প্রত্যক্ষ সবকপ্রাপ্ত হয়, তা বাকি ১১ মাস যাতে সমানভাবে জারি রাখতে পারে সেই প্রত্যয়ে বলিয়ান হওয়ার দিন ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরে সব মানুষ যে মর্যাদার দিক দিয়ে সমান তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধনীর সম্পদে দরিদ্রদের যে হক বা ন্যায্য অধিকার রয়েছে তা বাস্তবে পরিণত করার তাগিদ ঈদুল ফিতরে বারবার হৃদয়-মনে, সমাজ-সংসারে জাগ্রত হয়। “কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না, তা হবে না” এই শাশ্বত অনুভূতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই ঈদুল ফিতরের দিন আনন্দ করার, আনন্দ বিলাবার।ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দই প্রদান করে না বরং দুনিয়া ও আখিরাতের সামগ্রিক কল্যাণের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম অস্ত্র দ্বারা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাকে ছোট যুদ্ধ বলেছেন, আর নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করাকে বড় যুদ্ধ বলেছেন। মূলত নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করার যোগ্যতা অর্জন করা খুবই কঠিন ব্যাপার। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে প্রবল ও সত্যনিষ্ঠ করা ছাড়া তা অর্জন করা সম্ভব নয়। সিয়াম পালনের মাধ্যমে অতি সহজে নফসের সঙ্গে যুদ্ধ করার অর্থাৎ নফসকে দমন করার সামগ্রিক যোগ্যতা অর্জিত হয়। ঈদুল ফিতরে সেই যোগ্যতার অভিষেক ঘটে।
অধুনা বাংলাদেশে ঈদ শুধু মুসলিম স¤প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবই নয়, ঈদ আজ বাংলাদেশের একটি সার্বজনীন সামাজিক মহা উৎসবে পরিণত হয়েছে ওআমাদের উৎসবগুলো সার্বজনীন, সবাই হয়তো সব উৎসবে আসবে না, কিন্তু সবার জন্যই দরজা উন্মুক্ত, সুযোগ থাকবে প্রসারিত। সেজন্য রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল দরকার হবে। রাজনীতির ও দলের যাদের অঙ্গীকার হবে বিদ্যমান শাসকশ্রেণীকে হটিয়ে রাষ্ট্রকে জনগণের করা এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা ও বৈষম্য যত বেশি পরিমাণে পারা যায় সরিয়ে ফেলা।
এই উৎসবে সবার জীবন ও উদযাপন নির্বিঘœ হোক। প্রত্যাশা করি শ্রেণী, স¤প্রদায়, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে যাক সমাজের সর্বপ্রান্তে। ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়ানো এবং নিজের আনন্দ অন্যের মধ্যেও বিলিয়ে দেওয়ার যে শিক্ষা ঈদুল ফিতর দিয়ে থাকে, সবার মধ্যে তা সঞ্চারিত হোক।অর্থনৈতিক বৈষম্যপীড়িত সমাজে ঈদের মতো সার্বজনীন উৎসব সবার মধ্যে স¤প্রীতি ও উৎসবের আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের আনন্দ আরও বিস্তৃত হোক। প্রতিটি ঈদে সেই সত্যই আমরা উপলব্ধি করতে পারি।একই সঙ্গে ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোতেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা স্থিতি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি কামনা করি। আমরা চাই, রাজনীতির আকাশে ঘনিয়ে ওঠা কালো মেঘ ঈদের আনন্দরশ্মিতে কেটে যাক। মিলনের বার্তা নিয়ে আসা বাঁকা চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত হোক সবার হৃদয়। এই প্রত্যাশা আরও প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে, এবার ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে জঙ্গি সন্ত্রাসী দমনের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে, এতে যে ধরাও পাকড়াও শুরু হয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবনতির প্রয়াস রয়েছে ও ঈদের আনন্দ সবাই যেন সমানভাবে উপভোগ করতে পারি, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া আমাদের সবারই দায়িত্ব। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, মতভেদ ভুলে গিয়ে সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেয়ার শিক্ষা দেয় ঈদুল ফিতর। রমজান আমাদের চিত্ত শুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে ঈদুল ফিতর সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন।

ঈদে রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী সহ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সুমতি প্রত্যাশিত। প্রার্থনা করি, সামাজিক জীবনের মতো রাজনীতিতেও ভেদাভেদ ভুলে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে আমাদের নেতৃবৃন্দ এক কাতারে দাঁড়াবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক সৌজন্যবোধও জাগ্রত দেখতে চাই এ ঈদে । প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা সহ রাজনৈতিক দলসমূহের প্রধান নেতারা ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করেন। নিছক আনুষ্ঠানিকতার বদলে জাতীয় ইস্যুতে ভাববিনিময় হলে জনমানসে তাদের ভাবমূর্তি কেবল উজ্জ্বল হবে না, গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু সমাজ বিনির্মাণের পথও প্রশস্ত হবে।মত ও পথের যে ভিন্নতা, তা সামষ্টিক সমৃদ্ধির পথে বাধা নয়, বরং বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।প্রধান দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার যে আশঙ্কার কথা কোথাও কোথাও উচ্চারিত হচ্ছে, ঈদুল ফিতরে প্রদর্শিত পারস্পরিক সৌজন্য ঈদপরবর্তী ব্যবহারিক জীবনে স¤প্রসারিত হলে সব আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা কেটে যাবে বলে বিশ্বাস করি। ঈদুল ফিতরের বর্ণিল পোশাক, বহুমাত্রিক আয়োজন বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে ঐক্যের সেই পথ নির্দেশিত হোক ওসবার মাঝে ছড়িয়ে যাক ঈদের খুশি। সব শ্রেণী, স¤প্রদায়, ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ ভেদাভেদ ভুলে ঈদের আনন্দে নিজেদের রাঙিয়ে তুলুক। ঈদুল ফিতরের শিক্ষা সঞ্চারিত হোক সবার মধ্যে।যদিও আমরা এখন নগর সংস্কৃতি শিখছি। অন্যের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে। তবু ভালোবাসা আছে বলেই এখনো ছুটিতে অবসরে গ্রামে ফিরতে চাই। নগর সংস্কৃতির জীবনযুদ্ধের মধ্যেও যেটুকু ভালেবাসা আমাদের রয়েছে, তা যদি আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি, শিশুদের ভেতরে ভালোবাসা তৈরি করতে পারি, তাদের ভালোবাসতে শেখাই, তাহলেই আমাদের দেশ, আমাদের পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে। ঈদ মানে তো আনন্দ। সেই আনন্দ যদি আমরা সবাই ভাগাভাগি করতে না পারি, আমার আনন্দের সঙ্গে অন্যকেও জড়িয়ে নিতে না পারি, তাহলে তার পূর্ণতা কোথায়? শুধু ঈদের দিনেই নয়, প্রত্যাশা করি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমাদের সব স্থিতি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোতেও বজায় থাকুক।সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সব মতভেদ ভুলে আজ একে অপরকে বুকে জড়ানোর দিন; সাম্য, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, মিলনের দিন। সবাইকে ঈদ মোবারক।
সুহেল ইবনে ইসহাক: টরোন্টো, কানাডা