ইউসুফ কামাল : পাঁচ.
জীবনের বাস্তবতার সাথে তাল মেলাতে ধীরে ধীরে সবাইকেই আপন আপন গন্ডির সাথে একসময় মিশে যেতে হয়। নোমান গাজীপুরের এক নামে পরিচিত হওয়ার মত পরিবারের সন্তান, সামাজিক ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ওরা। শহরের মধ্যে ওদের বড় বড় দুইটা মার্কেট ছাড়াও ঢাকা ময়মনসিংহের মধ্যে চলাচলকারী কয়েকটা বাসের মালিকানা ওর পরিবারের। পিতামাতার ও একমাত্র সন্তান তাই পরিবারের ইচ্ছা পৈতৃক ব্যবসায় হাল ধরুক। ব্যবসার প্রতি নোমানের খুব একটা আকর্ষণ না থাকলেও নগদ টাকা হাতে আসতেই ধীরে ধীরে মনোনিবেশ করতে শুরু করলো। আস্তে আস্তে পারিবারিক ব্যবসার অফিসে বসা শুরু করে দিল সে। শাহেদ চলে এলো কুমিল্লার বড়ুরায় ওর নিজস্ব এলাকায়, সময় কাটানোর উদ্দেশ্য নিয়ে সাময়িকভাবে এলাকার এক কলেজে জুনিয়র শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলো। সবার কথা, বসে না থেকে কলেজে আসা যাওয়া করো। ভালো কিছু হলে চলে যেও। কথাটা শাহেদের পছন্দ হওয়ায় ঢুকে পড়লো শিক্ষকতায়। নিজের এলাকার কলেজ বলে সবাই ওকে ভালোই সন্মান দিতো, বেতনও ভালোই। সপ্তাহে দু’তিন দিন কথা হয় নোমানের সাথে, কুশল বিনিময় আর কথার মাঝে মুল আলোচ্য বিষয় ছিলো ইলা বিষয়ক নতুন তথ্য সংগ্রহ করা।
প্রথমদিকে নোমানের কাছে ইলার তরফ থেকে ঘন ঘন চিঠি আসলেও পরের দিকে বিরতিটা বাড়তে লাগলো। কারণটা ওর চিঠিতেই বোঝা গেল, একটা প্রতিষ্ঠানে সাময়িক চুক্তির আওতায় সেলস্ ডিপার্টমেন্টে নিয়োগ পেয়েছে। পারফরমেন্স ভালো হলে নিয়মিত হিসেবে নিয়োগ পাবে। খবরটা দুজনের কাছেই স্বস্তিদায়ক, দুজনই ভাবলো অন্তত: দাঁড়ানোর জায়গাটা তো হলো। তবে ওর অন্যান্য বিষয়গুলো কেমন যেন ধোয়াশা হয়েই রইলো, ইলা যতক্ষণ না নিজের থেকে কিছু না বলছে উপযাচক হয়ে কিছু জানতে চাওয়াটা সমিচীন নয় বলে কেউই তা করলো না। তা ছাড়া বিষয়টা খুবই ব্যাক্তিগত ও স্পর্শকাতর। মাঝে মাঝেই পুরনো খেরো খাতা খুলে শাহেদ হারিয়ে যাওয়া জীবনের ছবিগুলো সামনে আনতে চেষ্টা করে। বেশির ভাগ ছবিগুলোই যেন ফেড আউট হয়ে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, ইচ্ছে করলেও যেন পাতাগুলো খোলে না। বিবর্ণ হয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মেই যেন ঝাপসা হয়ে আসে অযতেœ পড়ে থাকা ছবির মতো, হাল্কা হলদেটে রং ধারণ করে। ব্যাক্তিগত জিদের সাথে ব্যাক্তিত্বের সংমিশ্রণে ইলাকে শাহেদ ভিন্ন চরিত্রের একটা মানুষ হিসাবেই ধরে নিয়েছে। ঠিক জিদ না বলে এটাকে একজন স্বাধীনচেতা মানুষের চরিত্রও বলা যেতে পারে অন্তত এটা শাহেদের ধারণা।

নোমানের মহসিন হলের ২৪২ নং কক্ষের সেই দিনের স্মৃতিগুলোর সামান্যতম অংশও হারিয়ে যায়নি শাহেদের মন থেকে। প্রথম থেকে শেষ অংশগুলো একের পর এক অবিকল বাঁধা পরে আছে মনের মধ্যে সংগোপনে। যৌবনের প্রারম্ভের ভালোলাগা মানুষকে একান্তে পেয়েও ইলা সামান্যতম বিচ্যুত হয়নি তার স্বামীর কথা মনে করে, ব্যাক্তিগত নীতির সাথে সাময়িক আবেগকে প্রশ্রয় না দেয়ায় তার মনোবলের দৃঢ়তা কতটুকু শক্ত সেটা সেদিন ঠিকই বুঝেছিলো শাহেদ। আর তাই সেদিনের পর থেকে কেমন যেন একটা ভিন্নতর ভালোলাগা শ্রদ্ধাবোধও শাহেদের মনের মধ্যে এসে গিয়েছিলো, মুখে কিছু না বল্লেও মনের ভিতরে আরো একটু উঁচু স্থানে বসিয়ে দিয়েছিলো অজান্তেই। সে দিন যেন নতুন করে ভালোবাসার এক দুর্লভ পাঠ শিখে ফেলেছিলো, আর সেটা হলো সত্যিকারের ভালোবাসার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা যেন একটা অপরিহার্য় বিষয়। আর সেটাই প্রচন্ড ভাবে ধরে রাখে একে অন্যকে পরস্পর পরস্পরের প্রতি, যার মূলমন্ত্র হলো বিশ্বাস।

মাস ছয়েক পরে সুপিরিয়র সার্ভিসের বিজ্ঞপ্তি দেখে ভবিষত জীবনের আদ্যোপান্ত চিন্তা করে শাহেদ দরখাস্ত জমা দিলো। আর সেই সাথে রীতিমত ব্যাস্ত হয়ে পড়লো পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে। পরীক্ষা দিয়ে মোটামুটি সন্তষ্ট হলো সে নিজেই। পরীক্ষা শেষের পনেরো দিনের মাথায় দারুনভাবে ধাক্কা খেলো ও সরাসরি ইলা’র চিঠি পেয়ে। বুঝতে বাকী থাকলো না যে নোমানের মাধ্যমেই ওর ঠিকানা পৌঁছেছে ইলার কাছে। কোনো আবেগ মিশ্রিত চিঠি নয় বরং একজন বন্ধু যেমন করে তার পরম হিতৈষী বন্ধুর কাছে নিজের পরিস্থিতি বর্ণনা করে পরবর্তি করণীয় বিষয়াদি সম্পর্কে জানতে চায় ঠিক তেমনি। বিদেশ বিভূইয়ে একাকী একজন মেয়ের বড় রকমের দু:শ্চিন্তাগ্রস্থ হওয়ার মতোই বিষয়, কিন্তু চিঠির ভাষায় সে ভেংগে পরেছে এমনও বোঝায়নি। বরং শাহেদের উদ্বিগ্নতা ধারণা করেই ইলা লিখেছে, এ সব দেশে এই ধরনের অসহায় নারীদের সাহায্য করার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। চিন্তা করো না আমি অনেক ভালো আছি, দোয়া করো আমার জন্য। ইলা জানালো প্রতিবেশী এক ভারতীয় মহিলা ইলার এই দু:সময়ে তার প্রতি যে সহানুভূতি দেখিয়েছে সেটার ঋণ সে কখনই শোধ করতে পারবে না। প্রথম দিকে তার বাসাতেই আমাকে রেখে দিয়েছিলো ডরমেটরীতে সিট না পাওয়া পর্যন্ত। ঐ মহিলা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সেখানেই ইলা’কে সাময়িক চুক্তিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

চিঠির শেষে শাহেদ কি করছে? সেই সাথে ভবিষত জীবনের কর্মপন্থা নিয়েও পরোক্ষভাবে জানতে চেয়েছে। শাহেদও তার ভবিষত জীবনের চিন্তার কথা অকপটে খুলে বলেছে ইলার কাছে বিশ্বস্ত আপনজন মনে করেই। বিষয় যেটা বোঝা গেলো তা হলো, পারিবারিকভাবে যেহেতু ওরা খুবই ঘনিষ্ঠ। তাই বিষয়টা নিয়ে বাইরের লোক জানাজানির মতো কোন ঘটনা যাতে না হয় সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে সবাই একমত হয়েছে। ইলা অবিনাশের কাছে না থেকে আলাদাভাবে একটা ডরমেটরীতে নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। ওদের দুপরিবারের সম্মতিতেই দু পক্ষ পৃথকভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইলার কথায় মোটামুটি এটুকুই বুঝতে পারলো শাহেদ। ইলার চিঠির মূল অংশ জুড়েই ছিলো অবিনাশের সাথে ওর বনিবনা না হওয়ার মূল কারণ। ভ্যাগ্যান্বেষনে আমেরিকায় আসা হাজারো যুবকের মতো অবিনাশকেও এক মেক্সিকান মহিলার সাথে অর্থের বিনিময়ে স্বামী স্ত্রী হতে হয়েছিলো নাগরিকত্ব পাওয়ার লক্ষ্যে।

পরে আবার দু’বছরের মাথায় নিজেদের ভিতরের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক উভয়েই যে যার মতো দুপথে সরে গেছে কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে মার্থা, অবিনাশের ঔরসজাত কন্যা। যার মায়া অবিনাশ ছাড়তে পারছে না, হাজার হোক নিজের মেয়ে বলে কথা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে মার্থার দায়িত্ব অবিনাশ নিজেই নেবে, কোর্টে মুচলেকা দেওয়ার পর কোর্টের সিদ্ধান্তেই ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়েছে। শাহেদ বুঝলো এটা ইলা কোন রকমেই মেনে নিতে পারেনি। স্বপ্ন ভংগের বিরাট একটা ক্ষত নিয়ে সে কেমন করে এমন অনৈতিক চরিত্রের একটা মানুষ যে তার স্বামী, সেই অবিনাশের সাথে সে কি ভাবে সারাজীবন কাটাবে? জোড়াতালি দিয়ে একটা মানুষকে সারাজীবন মেনে নিয়ে চলতে হবে, এটা কি সম্ভব? ঘুণাক্ষরেও সে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে পারে সেটা ইলা বা তার পরিবারের কেউই চিন্তা করেনি।

ইলার নিজস্ব চারিত্রিক স্বকীয়তা যে প্রবল সেটা শাহেদ জানে, আর জানে বলেই কোন নীতি বিবর্জিত কাজ যে ইলা মেনে নিতে চায় না সেটা শাহেদ জেনেছিলো ওর বাবা যখন শাহেদের সাথে সম্পর্ক হওয়ার কথা জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে কাউকে না জানিয়ে সিলেটের এক মহকুমা শহরে চলে গিয়েছিলেন। সুদীর্ঘ তিন মাস সে সবার সাথে কথা বন্ধ করে রেখেছিল প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে যার ফলশ্রুতিতে তিন মাস সে স্থানীয় কলেজেও ভর্তি হয়নি, বলেছিলো পড়াশুনা আর করবেই না।
তবু চলার নাম যেহেতু জীবন তাই তো চলতেই হয়। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, হিউষ্টন, টেক্সাস, ইউএসএ