ভজন সরকার : (৩)
একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ভিন্ন ভিন্ন রূপে অলৌকিক শক্তিধর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে থাকেন। শুধু ঈশ্বরে বিশ্বাসই নয়, জাগতিক সুখ-সমৃদ্ধি-সমাধান-সমর্থনের জন্যে ঈশ্বরের কৃপা লাভ করতে চান। এ জগতে তো বটেই মৃত্যুর পরে আরও বেশি সুখী হতে চান। এ পৃথিবীর অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চান মৃত্যুর পরে। এক কথায় সুখের সাগরে অনন্তকাল ভাসতে চান। আর তার জন্যে উপায় যার যার ঈশ্বরের কৃপা পাওয়া। ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্যে যুক্তি-তর্ক এমনকি কান্ডজ্ঞান বিসর্জন দিতেও মানুষের কমতি নেই।

আগেই বলেছি, কিছু মানুষ নিজের কিংবা নিজেদের মতো ক’রে ঈশ্বরতুষ্টির উপায় বাতলে দিয়ে গেছেন সাধারণের কাছে; যার অন্য নাম প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস। কেউ কেউ বা কোনো কোনো ধর্মবিশ্বাসীরা হয়ত সেই অতীতের ঈশ্বরতুষ্টির উপায় একটু সংস্কার ক’রেছেন। ঈশ্বরের বিমূর্ত ধারণাকে দর্শন কিংবা যুক্তির প্রলেপে মুড়ে দেয়ার চেষ্টা করে ধর্মবিশ্বাসের বিধিনিষেধের বাতাবরণকে একটু আলগা করেছেন। আর কেউ এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন, আদিম বা মধ্যযুগের সেই বাতলে দেয়া ঈশ্বরতুষ্টির রীতি-নীতি বা বিধিবিধানকে।

আমরা চাই বা না-চাই, বিশ্বাস করি বা না-করি এ পৃথিবী থেকে অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস, যাকে আমরা ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, গডÑ যা বলি না কেন, সেখানে থেকে এতো সহজে মুক্তি নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-যুক্তির উৎকর্ষ সত্বেও মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে, থাকবে কিছু অজানা-অচেনা অসহায়ত্ব। সেই সাথে রাজনীতি, বৈষম্য, বিভাজন কিংবা অন্যকে শোষণ করার ইচ্ছে তো আছেই। আর এ সবের জন্য ঈশ্বরে বিশ্বাস কখনো আসবে সহজাত হিসেবে আবার কখনো ধর্মবিশ্বাসকে নিজ নিজ স্বার্থে ব্যবহারের মাধ্যমে।
তবে একথাও সত্য যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা যতো বাড়বে, অলৌকিক শক্তিধর ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, গড-এর প্রতি মানুষের বিশ্বাসও ততো কমবে। আর ঈশ্বরের অস্তিত্বে আস্থাহীন মানুষের ঈশ্বরতুষ্টির সাধনা,যার প্রচলিত নাম ধর্মবিশ্বাস, সে সবের প্রয়োজনও আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাবে।

(৪)
কবি আবুল হাসানের কবিতা, “অবশেষে জেনেছি মানুষ একা! জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!”

যত দুর্দন্ড প্রতাপশালীই হোক না কেন, মানুষকে বেশির ভাগ সময়েই নিজের সাথেই থাকতে হয়। নিজের সাথেই পরামর্শ করতে হয়। নিজের সাথেই কথা বলতে হয়। কখনো কখনো যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি দিতে হয়। খন্ডন করতে হয় প্রত্যেকটি যুক্তি ও প্রতিযুক্তিকে এবং পৌঁছুতে হয় সিদ্ধান্তে। যতই সলা-পরামর্শ নিক না কেনো, মানুষকে শেষ বিচারে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় সে সিদ্ধান্তের অনুকুলে।

এই এগিয়ে যাওয়া যে সব সময় অনুক‚ল থাকে সেটাও নয়। অধিকাংশ সময়েই মানুষকে যুদ্ধ করতে হয় চারিদিকের নানান বৈরীতার সাথে। সে জীবন যুদ্ধে অবসাদ আছে, আছে অসহায়ত্ব। সে অবসাদকে, সে অসহায়ত্বকে মোকাবেলা করার জন্যে প্রয়োজন হয় শক্তির। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবনযুদ্ধে লড়াই করার মতো শক্তি কি সবসময় থাকে? পরিবার, সমাজ, রাস্ট্র কি সব সময় সব মানুষের সহায়ক হয় কিংবা হয়েছে কোনদিন?
আজ যে কোন ভাবে যদি এ বদ্ধমূল ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যায় কিংবা সব মানুষকে বোঝানো যায় যে, ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, যিশুসহ এতোদিন বিশ্বাস করে আসা সৃষ্টিকর্তার কোন অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে নেই। যদিও নানা বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী মানুষেরা নানাভাবে এ কথা বলে আসছেন যুগ যুগ ধরে। তাহ’লে একবার ভাবুন তো, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অসহায়ত্ব, যাঁরা এতোদিন নানা বিপদ-বিসম্বাদে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করে বেঁচেছিলেন,যাঁরা ভাবতেন এ পৃথিবীর কেউ সাথে না- থাকলেও উপরওয়ালা একজন সারাক্ষণ তাদের দেখছেন। সেই উপরওয়ালার ইচ্ছেতেই তাঁরা বেঁচে আছেন। সেই উপরওয়ালাই তাঁদের বিপদে ফেলছেন আবার তিনিই রক্ষা করছেন কিংবা মেরে ফেলছেন। সেই উপরওয়ালাই বৃষ্টি দিয়ে ভেজাচ্ছেন, রোদ দিয়ে শুকোচ্ছেন, আবার ছায়া দিয়ে জুড়াচ্ছেন।

“তিনি যেমনি নাচান তেমনি নাচে, মানুষের কী দোষ”। সেই নাচানেওয়ালা সৃষ্টিকর্তা কোথায় আছেন কিংবা আদৌ আছেন কিনা- সে যুক্তিবাদী প্রশ্ন অধিকাংশ মানুষের কাছে অবান্তর মাত্র। এক চরম অসহায়ত্ব- এক মহা অনিশ্চয়তা থেকে মানুষ আত্মসমর্পণ করছে এক ভয়াবহ অলৌকিকতার কাছে- এক মহামারী বিশ্বাসের কাছে।

প্রখ্যাত যুক্তিবাদী লেখক-কবি- অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ একবার নিজের অভিজ্ঞতা বলছিলেন এক আড্ডায়। ঢাকা থেকে নিজের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে যাওয়ার সময় একবার বাস দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ কিন্তু বাস ড্রাইভারের সাহসী ও দক্ষতার জন্যে সে যাত্রায় বাসের প্রত্যেকটি যাত্রী বেঁচে যান। এ কথা বাড়ি পৌঁছে মা-কে বললে, হুমায়ুন আজাদের মা বলছিলেন, “আল্লাহর কাছে হাজার শুকর করো, তিনি তোমাদের বাঁচিয়েছেন”।

এ কথা শুনে হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, “আম্মা একথা কেন বলছেন? আল্লাহ বাঁচাবেন কিভাবে, আল্লাহ তো মারতেই চেয়েছিলেন, বাঁচালো তো বাস ড্রাইভার”।
সহজ মানুষের খুব সরল বিশ্বাস। সব কিছুর পেছনেই সেই উপরওয়ালার ইশারা দেখতে পান। বিশেষ করে পরিস্থিতি যখন নিজের আয়ত্বের বাইরে আর থাকে না।
ছোটবেলায় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি থেকে কলেজ হোস্টেল যাওয়ার সময় আমার ঈশ্বরভক্ত বড়মা (জেঠিমা) ঢাউস আকারের দু’টো তুলসির পাতা কানের গোড়ায় গুজে দিয়ে বলতেন, ‘ভগবান যেন নিরাপদে পৌঁছে দেন”।

আমি জানতাম, কোন বাধায় কাজ হবে না, তাই নিরবে মাথা নিচু করে সে তুলসির পাতা কানে নিয়ে বলতাম, “ঠিক আছে দাও । ঢাকা যাবো বাসে। আর বাস তো আর আমি চালাবো না। চালাবে ড্রাইভার। তাই বিপদ হলে ড্রাইভারের জন্যেই হবে । তাই বাসে উঠেই বাস ড্রাইভারের কানে তুলসির পাতা গুজে দেবো।”

কোটি কোটি মানুষের কি সহজ সরল অথচ প্রবল বিশ্বাস ওই না-দেখা সৃষ্টিকর্তার উপর। অথচ পথের দুর্ঘটনার জন্যে বাস্তবের মানুষগুলোই দায়ী। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের মা কিংবা আমার বড়মার তো কোন আস্থা -ভরসা কিংবা কর্তৃত্ব নেই ওই বাস ড্রাইভার কিংবা বাস্তব জীবনের দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী সকল নিয়ামকের উপর। তাই শেষ ভরসা ওই উপরওয়ালার কাছে!

বিশ্বাস যদি চিরস্থায়ী না হয়, তবে ধর্মীয় বিশ্বাসও চিরস্থায়ী হ’বার কথা নয়। যাঁরা ধর্মীয় বিশ্বাসকে চিরকালীন এবং অভ্রান্ত ও অপরিবর্তনীয় বিশ্বাস বলে বিশ্বাস করে থাকেন, তাঁদের যুক্তিতে কোথাও গড়মিল আছে।

ঠাকুমা-দিদিমাদের কাছে শুনেছি গুটি বসন্ত বা কলেরায় গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যেতো। সৎকার করার মতো মানুষও খুঁজে পাওয়া যেতো না। এসব রোগ থেকে বাঁচতে ঘরে ঘরে প্রচলন ছিল ওলনচন্ডীর মতো নানা পূজা-অর্চনার। এখন সে সব রোগ নেই, পূজা-অর্চনা বা বিশ্বাসও নেই।

আগে প্রচন্ড উৎপাত ছিল সাপের। জংগল ছিল বসত বাড়ির চারিদিকে। অনাবাদি ভিটে ছিল। ইঁদুর বা অন্যান্য পোকামাকড় ছিল। ছিল সাপের উপদ্রপ। তাই ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছি হিন্দু তো অবশ্যই মুসলমান বাড়ি থেকেও মনসা পূজার জন্যে টাকা দেয়া হতো।
এখন মানুষ বেড়েছে। জংগল ভিটেবাড়িতেও হয়েছে মানুষের ঘর-গেরস্থালি। ঘরবাড়িতেও এসেছে পরিবর্তন। মাটির ঘর থেকে উঠেছে পাকা দালান। সাপের আবাসন কমে গেছে। তাই এখন আর মনসা পূজার তেমন প্রচলন গ্রাম বাংলায় মুসলমান তো দুরের কথা হিন্দুদের মধ্যেও তেমন কোথাও নেই।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার দিয়ে মানুষ যতো নিজের অসহায়ত্বকে বশ করতে পারবে, যতো আত্মবিশ্বাসী হয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করতে পারবে, যতো যুক্তিবাদী জ্ঞানের চর্চা করবে; মানুষের ততো অনিশ্চয়তা কেটে যাবে ওই অদৃশ্য “নাচানেওয়ালে”র উপর থেকে, মানুষ ততোই বিশ্বাস হারাবে ওই অদেখা ঈশ্বরের প্রতিও।

(ভজন সরকার : কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)