অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশে সব ধরণের বিদেশী ফল আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ এবং এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় কড়াকড়ির কারণে ফলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

রাজধানীর গুলশানে ফলের বাজার ঘুরে দেখা গিয়েছে বিভিন্ন বিদেশী ফল কেজি প্রতি দাম ১০-৮০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। এমন অবস্থায় ক্রেতারা চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অল্প পরিমাণে ফল কিনছেন। ফলে অবিক্রীত অনেক ফল বাজারেই পঁচে নষ্ট হওয়ার অভিযোগ করেছেন বিক্রেতারা।

ফল বিক্রেতা রুহুল আমিন বলেন, ‘মানুষের চাহিদা আছে, কিন্তু দাম বেশি কিনতে পারে না। অনেক ফল নষ্ট হয়।’

তিনি একটি ব্যাগ ভর্তি লাল রঙের বিদেশী আপেল দেখিয়ে বলেন এখানে তার ৩০০ টাকার বেশি ফল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিদেশী ফল নষ্ট হয় তার।

এদিকে বাজারে ফল কিনতে এসে দাম নিয়ে অভিযোগ করেছেন ক্রেতারাও। একজন ক্রেতা বলেন, তার ডায়েটের জন্য নিয়মিত লেবুজাতীয় ফল ও আপেল কিনতে হয়। কিন্তু গত নয় মাসে দাম কেজি প্রতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আপেল আগে ১৫০ টাকা কেজি কিনতাম। এখন সেটা ২৫০ টাকার নিচে দেয় না। আবার ৩০০ টাকাও চান। মাল্টা ছিল ১৫০ বা ১৮০ টাকার মতো, সেটা এখন ২২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকার মতো। কমলা, আঙ্গুরের দামও বেশি। মানে বিশাল পার্থক্য।’

বাংলাদেশে ডলার সঙ্কটের মধ্যে গত বছরের মে মাসে সব ধরণের বিদেশী ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে ফল আমদানিতে ঋণ সুবিধাও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপে থাকায় গত বছর ব্যয় সংকোচনের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে এবং রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানার ওপর জোর দেয়া হয়। তার অংশ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে সরকার এই কর আরোপ করে।

খাদ্য-পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী ফলকে ২০১২ সালে বিলাস-পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আপেল, কমলা ও নাশপাতিকে বিলাস-পণ্যের তালিকায় রাখা হয়।

এর প্রভাবে আগে যেখানে বিদেশী ফলের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল ৩ শতাংশ, সেটি গত নয় মাস ধরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। তার সাথে আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট রয়েছে।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ফল আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না, তাতে ফলের দাম দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ভোক্তাদের ফলের চাহিদা পূরণে আপাতত দেশীয় ফলমূলের ওপর ভরসা করার পরামর্শ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

বুধবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, ‘ফল তো আমাদের দেশে প্রচুর হচ্ছে। এখন আমাদের দেখতে হচ্ছে যাতে বিদেশী মুদ্রায় অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। এখন দরকার ডলার সাশ্রয় করা। যে জন্য এলসি একটু রেসট্রিক্ট (সীমিত) করা হয়েছে। পরিস্থিতি একটু উন্নত হলেই সেটি খুলে দেয়া হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে যেটা অপরিহার্য, সেটাতেই আমরা বেশি জোর দিচ্ছি।’

ডলার সঙ্কট না কাটলে এবারের রোজার মাসেও বিদেশী ফল আমদানি করা যাবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হয় তা চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয় বরং বিদেশী ফলের ওপর নির্ভরতা বেশি বলে জানিয়েছেন ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোর্টার্স এসোসিয়েশনের দফতর সম্পাদক রাকিব হোসেন।

ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্যমতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিদিন ৮০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। সহজ করে বললে, দেড় থেকে দুই কাপ বা দুই হাতের তালুতে জায়গা হয় এমন পরিমাণ।

কিন্তু বাংলাদেশে যে পরিমাণ ফল উৎপাদন হয় তা দৈনিক মোট চাহিদার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। এক্ষেত্রে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ফলের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ফলের ওপরেই নির্ভর করতে হয় বলে জানিয়েছেন রাকিব হোসেন।

আমদানিকারকরা জানান, সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বিদেশী ফলের চাহিদা বেড়ে যায়। কারণ, এ সময়ে দেশীয় ফলের সরবরাহ কম থাকে। আবার মার্চের শেষ সপ্তাহেই রোজার মাস শুরুর কথা রয়েছে। ফলমূলের চাহিদা আরো বেড়ে যায়।

রাকিব বলেন, ‘বাংলাদেশে সব মৌসুমী ফল। সিজন গেলে ফল থাকে না। কিন্তু ফল ১২ মাস খাওয়া লাগে। অনেকে রোগীর পথ্য হিসেবে ফল কিনে। এটা কোনো বিলাসী পণ্য না, এটা প্রয়োজন। এজন্যই এত ফল আমদানি করা লাগে।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘আমদানিকারকরা এলসি খুলতে পারছে না, ডলারের দাম বেড়ে গিয়েছে, অতিরিক্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। একেক কন্টেইনারে লাখ টাকার লস। এজন্য চাহিদা অনুযায়ী ফল আমদানি করা যাচ্ছে না। এসব কারণে ফলের দাম বেড়ে গিয়েছে‘।

শিগগিরই ফলের আমদানি স্বাভাবিক না হলে এ সঙ্কট আরো বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ‘ফ্রেশ ফ্রুটস’ (তাজা ফল) ও ‘ড্রাই ফ্রুটস’ (শুষ্ক ফল) এই দুই ক্যাটাগরিতে ফল আমদানি করা হয়।

ড্রাই ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে খেজুর, কিশমিশ, বাদাম, ড্রাই চেরি, ড্রাই এপ্রিকটসহ আরো নানা ধরণের শুষ্ক ফল আমদানি করা হয়। আর ফ্রেশ ফ্রুটস ক্যাটাগরিতে রয়েছে আপেল, মালটা, নাশপাতি, আঙুর (সাদা, কালো ও লাল), আম, কমলা, ডালিম, চেরি, ড্রাগন, কিউই, অ্যাভোকাডো, তরমুজ, রামবুটান, ম্যান্ডারিনসহ প্রায় ৫২ রকমের ফল। তবে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়ে থাকে আপেল, কমলা, আঙুর ও মালটা।

ফল আমদানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশ মূলত ভারত, থাইল্যান্ড, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, চীন, ভুটান, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, আফগানিস্তান, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এই দুই ক্যাটাগরির ফল আমদানি করে।

আমদানি করা এসব ফলের মধ্যে ড্রাগন, স্ট্রবেরি, ডালিমসহ ১০ থেকে ১২ ধরণের ফল বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। বাকি কোনো কোনো ফল উৎপাদন না হওয়ায় এসব ফলের প্রায় সবটাই আমদানি করে চাহিদা পূরণ করতে হয়।

এসব ফলের বেশির ভাগ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশেষায়িত কনটেইনারভর্তি হয়ে জাহাজে করে আমদানি হয়। আবার আকাশপথে ও স্থলবন্দর দিয়েও ফল আসে। এই বাহনের ওপরে ফলের দাম ওঠানামা করে। তবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ বিদেশী ফল চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই আসে। পরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়।

সাধারণত প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে গড়ে সাত লাখ টন ফল আমদানি হয়ে থাকে। যার প্রায় ৮০ ভাগ হচ্ছে আপেল ও মালটা। এই বিদেশী ফলের বাজারের আকার প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বলে ধারণা আমদানিকারকদের।

তবে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া এবং ফল আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায়, চাহিদাসম্পন্ন এই পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এতে আমদানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন। সূত্র : বিবিসি