ফরিদুর রহমান : সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠেও নিচে নেমে সাড়ে আটটার মধ্যেই নাস্তা শেষ করেছি। হোটেল অলিম্পিয়ার নাস্তায় বৈচিত্র্য আছে, দায়সারা ধরণের কম্পিøমেন্টারি ব্রেকফাস্ট নয়। সেই কারণে সকাল বেলাটা সাধারণত নাস্তায় একটু বেশি সময় লেগে যায়। কিন্তু নয়টায় তিয়ানলিন এসে গেলে এক সাথে কনফারেন্স হলে যাবার কথা। আমি তৈরি হয় বসে আছি, কিন্তু সাড়ে নয়টাতেও চৈনিকের দেখা নেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে কনফারেন্স হলে পৌঁছালে মান্দি অবাক হয়ে বললো, ‘তুমি অলিম্পিয়া যাচ্ছো না?’

‘যাবো বলেই তো এসেছি।’
‘দশটা প্রায় বেজে গেছে, তুমি তাড়াতাড়ি যাও রাস্তার ওপাশে বাস দাঁড়িয়ে আছে।’ মান্দিকে আর বিলম্বের কারণ বলা হলো না, আমি কনফারেন্স হলের পেছন দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এক ছুটে বাসের কাছে পৌঁছে গেলাম। গ্রিকরা বাঙালিদের মতো কিছুটা ধীরে সুস্থে নড়াচড়া করে। কিন্তু আজ দেখলাম অতিথিরা উঠে বসার আগেই উৎসবের কর্মকর্তারা তো বটেই স্বয়ং চালকও উঠে বসে আছেন। আমি বাসে উঠে প্রথমেই তিয়ানলিনকে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমাকে দেখে সে নিজেই ভুলে যাবার জন্যে দুঃখিত এবং লজ্জিত ইত্যাদি বলে যে দৃশ্যের অবতারণা করলো তাতে তাকে আর বকা দেয়া গেল না। শুধু বললাম, ‘চীনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রুতা করেছে এবং সেই শত্রুতা এখন ব্যক্তি পর্যায়ে এসে ঠেকেছে।’

টেম্পল অফ হেরা

গাড়ি চলতে শুরু করেছে, কাজেই তিয়ানলিক কী বললো শুনতে পাইনি। নির্ধারিত সময়ের মাত্র পাঁচ মিনিট পরে, অর্থাৎ দশটা পাঁচে পিরগস ছেড়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো সভ্যতার ইতিহাসের অদিম নগরী অলিম্পিয়ার উদ্দেশ্যে। পিরসগ থেকে প্রাচীন অলিম্পিয়ার দূরত্ব ছাব্বিশ কিলোমিটারের মতো। গ্রিক পুরানের দুই নদী দেবতা কদেয়স আর আলফিয়সের সংযোগস্থলে তিন হাজার বছর আগে যে পরিশীলিত সমৃদ্ধ জনপদের যাত্রা সূচিত হয়েছিল সেখানে পৌঁছে বিস্ময় এবং আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতি স্পর্শ করে গেল। আমরা অলিম্পিয়ার সংরক্ষিত প্রত্ন-এলাকার টিকেট ঘরের সামনে পৌঁছলাম দশটা চল্লিশে। আমাদের টিকেট কিনতে হবে না, অতএব সেদিকে পা না বাড়িয়ে আমরা কয়েকজন শীর্ণ নদী কদেয়াসের সেতুর উপরে এসে দাঁড়ালাম। পুরানের নদী কদেয়াস ঠিক বয়ে চলেছে বলা যাবে না। ঘন সবুজ ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ভরা দুই পাড়ের মাঝখানে একটি মৃত নদী বালির বিছানায় শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পরে সেতুর শেষপ্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে এসে আমরা প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যাই। সেখানে ভিড় জমতে শুরু করেছে। কিন্তু যিনি আমাদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবেন তখন পর্যন্ত তিনি এসে পৌঁছাননি।

হঠাৎ আমার কানের কাছে ফিসফিস শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম। হায় দেবতা জিউস! ইনি যে গতকালের সেই তথ্য-ভাণ্ডার মহিলা। তিনি বললেন, ‘আমরা যাঁর জন্যে অপেক্ষা করছি, তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক এবং প্রত্নতত্ত¡বিদ! গ্রিসের ইতিহাস বিশেষ করে প্রাচীন অলিম্পিয়ার সকল বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য।’

আর্কিওলজিক্যাল সাইটের গেটে দাঁড়িয়ে এবং এদিক সেদিক ঘুরে ফিরে আরো মিনিট দশেক কেটে গেলে এবারে তথ্য বিবরণী আমার কাছে এসে বলতে শুরু করলেন, ‘একজন ব্যস্ত বিদ্যোৎসাহী জ্ঞানী মানুষের একটু দেরি হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে দেশি বিদেশি অতিথিদের এভাবে গেটে দাঁড় করিয়ে রাখাটা অন্যায়।’ আমি হুঁ হ্যাঁ করে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিলেও তিনি নাছোড়বান্দা। বললেন, ‘ওরা কিন্তু ইচ্ছে করলেই আমাদের ছেড়ে দিতে পারে।’ অমি একটু দূরে এলদোরাকে দেখে যেনো তঁাঁর সাথে কথা বলতে যাচ্ছি এমনি ভাবে বললাম, ‘এলদোরার সাথে একটু কথা আছে। তোমার সাথে পরে দেখা হবে নিশ্চয়ই।’

জিউসের মন্দির

ভাগ্যক্রমে প্রত্নতত্তে¡র পণ্ডিত মশাই ঠিক সেই সময়ে এসে হাজির হলেন। তাঁর সাথে সাথেই ইতিহাসের দরজা খুলে গেল এবং আমরা ঢুকে পড়লাম আড়াই হাজার বছর আগের সমৃদ্ধ অতীতে। প্রবেশ পথ থেকে একটু সামনে এগিয়ে পথের দুপাশে পাথরের তৈরি স্তম্ভের ভাঙা টুকরো ছড়ানো দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপক তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। দলের প্রায় সকলেই তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেও অলিম্পিয়ার ইতিহাসের ধারা বিবরণী শোনার কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। বরং সীমিত সময়ের মধ্যে নিজের চোখে যতোটা সম্ভব দেখে নেয়ার জন্য আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। পাথর কুচি ছড়ানো পায়ে হাঁটা পথের দুপাশে কোথাও ধাতব রেলিং দিয়ে আবার কোথাও শুধু নাইলনের মোটা দড়ি দিয়ে পুরাকীর্তি এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে। ছড়ানো ইতিহাসের মধ্যে কিছু খুঁজে পাওয়া বৃথা চেষ্টা না করে আমি শুধু দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। এরই মধ্যে তিয়ানলিন এবং তুরস্কের আরো একজন ডকুুমেন্টারি মেকার এসে আমার সাথে যোগ দিয়েছে। বললাম, ‘তোমরা ইতিহাসের জ্ঞানার্জন না করেই প্রাচীন অলিম্পিয়াতে ঢুকে পড়েছো?’

তিয়ানলিন কিছু না বললেও তুরস্কের মেয়েটি উত্তরে বললো, ‘ইতিহাস গুগল সার্চ করে দেখে নেবো। এখন ভাষণ শুনে সময় নষ্ট করতে চাই না।’

অলিম্পিয়ার ধ্বংস্তসূপের শুরুতেই প্রাচীনতম গ্রিক পুরানের পেলেপসের কথিত সমাধি ক্ষেত্র। সুদূর অতীতে পঞ্চভুজ কাঠামো দিয়ে ঘেরা এই স্মৃতিস্তম্ভ খ্রিস্টপূর্ব প্রায় হাজার বছর ধরেই গ্রিক এবং পরবর্তী সময়ে রোমান যুগে পশুবলির বেদী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবের পরে ধর্মীয় আচার আচরণের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই প্রস্তর কাঠামোর সর্বোচ্চ বেদীতে পেলেপসের উদ্দেশ্যে কালো ভেড়া উৎসর্গের প্রথা সঙ্গত কারণেই বন্ধ হয়ে যায়। পেলোপিয়ন নামের এই সমাধি ক্ষেত্রটি ঠিক কোন জায়গায় এবং কতটা বিস্তৃত তা সম্ভবত পণ্ডিতেরাও নির্ধারণ করতে পারেননি। কাজেই অকারণে সে চেষ্টা না করে আমরা এগোতে থাকি এলোমেলো ছড়ানো প্রাচীন প্রস্তর, ভবনের ধ্বংসাবশেষ এবং সবুজ গাছপালার ভেতর দিয়ে পরবর্তী প্রত্ন-অবশেষের দিকে।

পালায়েস্ত্রা

অনেকগুলো দীর্ঘ কলামের সারি দেখে মনে হয় এই পথে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধাতব শিরস্ত্রাণ পরা বর্শা হাতে গ্রিক যোদ্ধারা এখনই ছুটে আসবে। এই পথের দুপাশেই ছিল মুষ্টিযুদ্ধ ও কুস্তি লড়াই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পালায়েস্ত্রা। এখানে ফ্রি হ্যান্ড বা ইচ্ছে মতো হাতাহাতি, মারপিট, লাথি-গুতা, কিলঘুষি সবকিছুই চলতো, যা মাঝেমধ্যে প্রতিপক্ষের মৃত্যুরও কারণ হতো। তবে এখানে সবকিছুরই ছিল কড়া নিয়ম কানুন, আম্পায়ার বা রেফারির মতো বিচারকদের উপস্থিতিতেই চলতো খেলা এবং প্রশিক্ষণ। তাঁরা ইচ্ছে করলে খেলা বন্ধ করে দিতে অথবা নিয়মভঙ্গকারী খেলোয়াড়কে সাময়িক বা চিরস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধও করতে পারতেন। আড়াই হাজার বছর আগের ক্রীড়ামোদীদের বিচক্ষণতা দেখে বিস্মিত হতে হয়। সেই দূর অতীতের অনেক রীতিনীতি আমরা এখনও অনুসরণ করে চলেছি।

সময়ের সাথে সাথে প্রাচীনকালের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে, হারিয়ে গেয়ে গেছে প্রতœযুগের নানা নিদর্শন। গ্রিক আলতিসের পবিত্র ভূমির ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আকার আকৃতিতে সবচেয়ে বড় ভবনটি দেবতা জিউসের মন্দির। গ্রিসের ডোরিক স্থাপত্যরীতির এই নিখুত নিদর্শনের নির্মাণকাল ৪৭০ থেকে ৪৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রাচীন বিশ্বের সপ্ত-আশ্চর্যের একটি গ্রিক দেবতা জিউসের স্বর্ণখচিত আইভরি মূর্তিটি আড়াই হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে গেলেও জিউসের মন্দিরের অবশেষ দর্শনার্থীদের জন্য এখনো টিকে আছে। জিউসের মন্দির থেকে উদ্ধার করা ব্রোঞ্জের তৈরি উপাসনা বেদী এবং ভবন শীর্ষের ত্রিকোণাকৃতি ভাস্কর্যের অংশ বিশেষ সংরক্ষিত রয়েছে অলিম্পিয়ার আর্কিওলজিকাল মিউজিয়ামে। আমরা জিউসের মন্দিরের সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। পরম প্রভাবশালী দেবতা এবং তাঁর অনুসারীদের কেউই নেই, পড়ে আছে কয়েকটি স্তম্ভ এবং কিছু প্রস্তর খণ্ড।
খ্রিস্টিয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতকে রোমান সাম্রাজ্যের আমলে ক্রীড়াবিদদের আবাসিক ভবন, পুরোনো স্নানাগারের জায়গায় নতুন নতুন স্নানাগার ও সুইমিং পুলসহ জল সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিল। ভূমিকম্প, এমনকি বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেইসব বিশাল ভবন, দীর্ঘ স্তম্ভের সারি এবং উন্মুক্ত সুইমিংপুলের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে যাই। কয়েকটি ছোট সংরক্ষিত স্নানাগারের দেয়াল এবং মেঝের মোজাইক এখন পর্যন্ত গরম জলের তাপ ধরে রাখতে সক্ষম। পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ শতকে মূল ভবনটি মদ প্রস্তুতের কারখানায় রূপান্তর করা হয়। এ ছাড়া একটি ফার্নেসে তৈরি হতো কাচের জিনিস। বিস্ময়ের সাথে এইসব স্থাপনা দেখতে দেখতে একের পর এক ভূমি সংলগ্ন দীর্ঘ দেয়ালে সাজানো পিলারের অংশ এবং প্রস্তর খণ্ডের স্তূপ পেরিয়ে যাই।

শীর্ণ নদী ক্লদেয়াস

আমাদের মতো আরো অনেকেই বোধহয় অধ্যাপকের ইতিহাসে কাস ছেড়ে নিজের মতো ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছেন। ত্রিকোণাকৃতি পাইওনিয়স ভিক্টোরির সামনে দেখা হয়ে গেল দমিত্রির সঙ্গে, একজন তরুণ নির্মাতার কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন প্রবীণ চলচ্চিত্র সংগঠক। যিশুর জন্মের চারশ একুশ বছর আগে স্পার্টার বিরুদ্ধে মেসিনিয়ার বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে নির্মিত বারো মিটার উঁচু এই স্মৃতি স্তম্ভটি এখনও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সম্মুখভাগের বেদীটি বর্তমানে স্থান করে নিয়েছে অলিম্পিয়ার যাদুঘরে।
প্রত্নতত্তে¡র সড়ক ধরে দীর্ঘক্ষণ হাঁটার পরে প্রায় সকলেই বোধহয় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশের সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকায় এসে কাউকে কিছু বলার আগে যে যার মতো বসে পড়েছেন। অনেকেই শুয়ে পড়েছেন বিশাল সব গাছের ছায়ায়। ডিসেম্বরের দুপুরের রোদ আমাদের কাছে খুব কড়া মনে না হলেও গায়ের গরম জ্যাকেট খুলে ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবছিলাম, এই সেই স্টেডিয়াম, যেখান প্রায় তিন হাজার বছর আগে শুরু হয়েছিল বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলাধুলার আসর অলিম্পিক গেমস! তখন তো এটি শুধু ক্রীড়া প্রতিেিযাগিতা ছিল না। ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সার্বজনীন মিলন ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শান্তি, সৌহার্দ্য এবং সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠেছিল অলিম্পিক গেমস। পাহাড়ের ঢালের মতো যে জায়গাটায় আমরা সটান শুয়ে পড়েছি সেখানেই ছিল দর্শক গ্যালারি। দুপাশের গ্যালারিতে চারহাজার দর্শক একসাথে বসে উপভোগ করতো ঘোড়ায় টানা যুদ্ধরথের প্রতিযোগিতা।

বেশিক্ষণ শুয়ে বসে কাটাবার সময় ছিল না। বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রত্নতাত্তি¡ক সংগ্রহশালা অলিম্পিয়ার আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম দেখা বাকি। ফেরার পথে স্টেডিয়াম থেকে বেরোবার সময় প্রথমেই পার হতে হলো একটি সুদৃশ্য তোরণ। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল স্টেডিয়ামের প্রবেশ পথ। গ্যালারিতে বসা দর্শদের চোখ এড়িয়ে একটি সুড়ঙ্গপথ দিয়ে যুক্ত এই তোরণ পেরিয়ে প্রতিযোগী এবং বিচারকেরা স্টেডিয়ামে ঢুকতেন, অনেকটা গ্রিনরুম থেকে মঞ্চে প্রবেশের মতো। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ থেকে ৩২০ অব্দে নির্মিত গেটের উপরিভাগে অর্ধবৃত্তাকার ছাউনি এখন পর্যন্ত কীভাবে টিকে আছে, সেটি আর এক বিস্ময়!

মঞ্চে প্রবেশের পথ দিয়ে প্রস্থান করে যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেটি টেম্পল অফ হেরা। প্রাচীন গ্রিকরা যে শুধু দেবতা জিউসের অর্চনা করতো তা নয়, সেখানে দেবতাদের রাণী হেরা সগৗরবে বিরাজমান ছিলেন। অর্থাৎ গ্রিকরা হাজার বছর আগেই জেন্ডার ব্যাল্যান্সের ব্যাপারে সচেতন ছিল। প্রাচীন অলিম্পিকে নারীদের দৌড় বা মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণও সর্বক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে।

আনুমানিক ৫৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নির্মিত এই উপাসনালয়ে জিউস এবং হেরার অধিষ্ঠান ছিল একই সঙ্গে একই মন্দিরে। আমাদের শিব-পার্বতী একসঙ্গে থাকতে পারলেও কিংবা রাধা-কৃষ্ণ একই সাথে পূজিত হলেও জিউস- হেরা এক সাথে কেন থাকতে পারেননি অথবা তাদের থাকতে দেয়া হয়নি তা জানি না, তবে দেবরাজ জিউসের জন্যে পরবর্তীকালে পৃথক মন্দির গড়ে তোলা হয়। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকের এক প্রবল ভূমিকম্পে টেম্পল অফ হেরার প্রায় পুরোটাই ধ্বসে পড়েছিল। এখন প্রত্নতাত্তি¡ক ধ্বংসস্তূপ হলেও হেরার মন্দিরের গুরুত্ব মোটেও কমেনি। প্রাচীন যুগের মতো এখনও চার বছর পরপর আনুষ্ঠানিকতার সাথে এখানেই জ্বালানো হয় অলিম্পিক মশাল এবং সে মশাল সারা পৃথিবী ঘুরে এসে শিখা অনির্বান হিসাবে জ্বলতে থাকে অলিম্পিকের মাঠে।

হেরার মন্দির থেকে একটু সামনে এগোলেই মার্বেল ও চুনা পাথরে তৈরি বৃত্তাকার স্মারক ফিলিপপিওন। ৩৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চেরোনিয়ার যুদ্ধে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই স্মৃতি মন্দির। দেবতা জিউসের পবিত্র গিরিখাতে ফিলিপপিওনই হচ্ছে একমাত্র স্থাপনা যা দেবতা নয় মানুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। ফিলিপের পরিবারের সদস্যদের ভাস্কর্য নির্মাণে সোনা ও আইভরির ব্যবহারেও অনেকের ধারণা এখানে নশ্বর মানুষকে অবিনশ্বর দেব-দেবীর সাথে একাকার করে ফেলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন ফিলিপ। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে দেহরক্ষীদের একজনের হাতে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ নিহত হলে তাঁর পুত্র আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট মেসেডোনিয়র দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদেরা মনে করেন ফিলিপের সাত স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধের নিস্পত্তি করতেই দ্বিতীয় ফিলিপ তাঁর জীবদ্দশায় ফিলিপপিওনের অভ্যন্তরে আলেক্সান্ডারের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এটি ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। এখানে এসে অন্তত একটা ছবি না তুলে চলে যাওয়া নেহায়েত বোকামি, তাই তিয়েনলিনের হাতে ক্য্যামেরা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের স্মারক মন্দিরের সামনে।

অলিম্পিয়ার আর্কিওলজিকাল সাইট থেকে বেরিয়ে মিউজিয়ামের পথে হেঁটে যেতে যেতেই চোখে পড়ে এথেন্সের সড়ক দ্বীপের সারি সারি কমলা গাছের মতো প্রতœতত্ত¡ যাদুঘরের কাছেই বেশ কয়েকটি গাছে পাকা কমলা ঝুলছে। তিয়েনলিন প্রথমে হাত উঁচু করে কমলা ধরার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পাঁচ ফুট উচ্চতার চীনা তরুণীর পক্ষে হাত বাড়িয়ে কমলা ছিঁড়ে আনা সম্ভব হলো না। পরে সে লাফিয়ে উঠে পরপর দুটি কমলা গাছ থেকে পেড়ে ব্যাগে ভরে ফেললো। আমি বললাম, ‘কমলাগুলো ভীষণ টক হবে, খেতে পারবে না।’ তিয়েনলিন বললো, ‘আমার মনে হচ্ছে মিষ্টি হবে। তবে টক হলেই বা ক্ষতি কী! অলিম্পিয়ার আড়াই হাজার বছর আগের কমলা।’ চলবে…