ফরিদুর রহমান : আমাদের বন্ধু, বাংলাদেশের প্রাামাণ্যচিত্রের প্রাণপুরুষ মানজারেহাসীন মুরাদ একদিন বলেছিলেন, ‘আপনি তো ঘোড়ার পিঠে চড়েই ঘুরে ফেললেন সারা দুনিয়া!’
মুরাদকে বলা যেতো, ‘এখন কী আর সেটা সম্ভব! অশ্বের পিঠে বিশ্বভ্রমণ করার মোক্ষম সময় ছিল সেই মধ্যযুগে। চতুর্দশ শতকে ইবনে বতুতা আফ্রিকার শেষপ্রান্তে মরোক্কোর তাঞ্জিয়ার থেকে যাত্রা শুরু করে কখনো ঘোড়া বা উটের পিঠে, কখনো জাহাজে চেপে আবার কখনো কেবল মাত্র পায়ে হেঁটে অতিক্রম করেছেন এক লক্ষ সতের হাজার কিলোমিটার পথ। আমাদের তো বিমানে মাত্র সাত হাজার কিলোমিটার ঢাকা থেকে মিউনিখ যেতেই শিরদাঁড়া বাঁকা হয়ে যায়!’

কথা হচ্ছিল প্রামাণ্যচিত্র ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ নিয়ে। সত্যিই তো! ঘোড়ার পিঠে সওয়ার না হলেও এই ঘোড়া নিয়ে যোগ দিয়েছি চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পাঁচটি উৎসবে এবং সেই সূত্রে হাজার হাজার কিলোমিটরের পথ পাড়ি দিয়ে ঘুরে এসেছি ডজনখানেক দেশ। ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ দেখানো হয়েছে ছত্রিশটি দেশে এবং পরিচালক হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম অন্তত পঁচিশটি দেশ থেকে। কিন্তু যাঁরা নেমন্তন্ন করেন তাঁরা তো আমাদের ট্যাঁকের টাকা বা ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট কোনোটারই খবর রাখেন না। সেই কারণেই দিনারের দীনতা থাকায় সার্বিয়ায়, ক্রোনার অভাবে ক্রোয়েশিয়ায় এবং শেষ পর্যন্ত ‘মালে মাজুল’ হবার কারণে বাড়ির কাছে মালেতেও যেতে পারিনি। চিলি এবং আর্জেটিনা থেকে ‘এসো এসো’ বললেও য়থেষ্ট ‘পেসো’ যোগাড় করতে না পারায় যাওয়া হয়নি। এ ছাড়া ভিসা জটিলতা এবং সময় স্বল্পতার কারণে বাদ দিতে হয়েছে কেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, ইন্দোনেশিয়া ও ইরানের উৎসব।

অশ্বারোহী তাসমিনা

তবে প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনালের মতো একটা মর্যাদাপূর্ণ উৎসব থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। ঢাকায় ডিআইটি ভবনে বাংলাদেশ টেলিভিশন যে বছর তার সম্প্রচার শুরু করে, একই বছর অর্থাৎ ১৯৬৪ সালে জার্মানির মিউনিখে যাত্রা শুরু করেছিল প্রিজনেস। একটানা পঞ্চশ বছরের বেশি সময় ধরে ছোটদের চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নিয়ে যে বিপুল আয়োজন সেটিকে কোনো সাধারণ চলচ্চিত্র উৎসব হিসাবে দেখার কোনো উপায় নেই। বিশ্বের টেলিভিশন জগতের রথী মহারথী, বিশেষ করে যাঁরা চিল্ড্রেন্স টেলিভিশন বা ছোটদের ছবি নিয়ে কাজ করেন দু বছর পরপর প্রিজনেস তাদের জন্যে এক মহামিলনের তীর্থভূমি। ষাট থেকে পঁয়ষট্টি দেশের কম করে সাড়ে চারশ টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা, চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক, এ্যানিমেশন এবং প্রামাণ্য ছবির নির্মাতা, চিত্রগ্রাহক, কলা-কুশলী এমন কি পরিবেশক বা টেভিশনের কর্তাব্যক্তিরাও সুযোগ পেলেই এই সমাবেশে হাজির হয়ে যান। আমি নিজেও ২০০০ সালে একবার বাংলাদেশ টেলিভিশনের হয়ে এবং ২০১৪ সালে একটি বেসরকারি সংস্থার পক্ষে প্রিজনেসের উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। তবে প্রিজনেসের অর্ধশত বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন অনুষ্ঠান এই উৎসবে প্রদর্শিত হয়নি। সেদিক থেকে শুরুতেই প্রতিযোগিতা বিভাগে পনের মিনিটের প্রামণ্যচিত্র ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’র অংশ গ্রহণ নিঃসন্দেহে বিস্ময়ের।

বিস্মিত হবার দ্বিতীয় কারণটি হলো ‘অশ্বারোহী তাসমিনা’ তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোথাও প্রদর্শিত হয়নি, এমন কি প্রদর্শিত হবার যোগ্য বলে বিবেচিতও হযনি। আমার অতি উৎসাহী সহকারী পরিচালক এবং সম্পাদক স্বপ্রণোদিত হয়ে ছবিটি ঢাকার একটি চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠিয়েছিল এবং কিছুদিন পরে জানিয়েছে ছবিটি ফেস্টিভ্যালে দেখানোর জন্য নির্বাচিত হয়নি। সেই কারণে বলা যায় পচিালক-প্রযোজকের উপস্থিতিতে এর প্রিমিয়ার হয়েছে প্রিজনেসেই।

উৎসব কর্তৃপক্ষ আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন সাত দিনের আয়োজনে তাদের দিক থেকে পাওয়া যাবে কেবল তিনদিনের স্থানীয় অতিথি সেবা এবং সকল প্রদর্শনী, উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানসহ নৈশ্যভোজ এবং বিয়ার পার্টি ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ! অতীতে অনেকবার বিভিন্ন দেশে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রথমবারের মতো নিজের একটা কিছু নিয়ে হাজির হবার ব্যাপারটা আলাদা। কাজেই স্বোপার্জিত টাকায় বিমানের টিকেট কিনে হলেও এই উৎসবে যোগ দিতে হবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সে সময় মিউনিখে যাবার একটি অতিরিক্ত প্রণোদনা হিসাবে কাজ করছিল জার্মানিতে আমার কন্যা আনিকার উপস্থিতি। সে তখন মনসেনগ্লাডবাখের হোকশুলে নিদারহাইনে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংএর মাস্টার্সের ছাত্রী। মিউনিখ থেকে ট্রেনে ডুসেলডর্ফ হয়ে মনসেনগ্লাডবাখ মাত্র ঘন্টা ছয়েকের পথ। এক ঢিলে একাধিক পাখি শিকারের এই সুযোগ পেলে যে কোনো বোকাও বুদ্ধিমান হয়ে যেতো।

আমি নিজে একাধিকবার জার্মানিসহ নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড এাবং বেলজিয়াম ঘুরে এসেছি কাজেই ভিসা নিয়ে কোনো জটিলতা হবার কথা নয়। কিন্তু অশ্বারোহীর প্রেেযাজক, যিনি এই স্বল্প বাজেটের প্রামাণ্যচিত্রের জন্যে অর্থের যোগান দিয়েছেন, আমার স্ত্রী মাহবুবা বেগম হেনার ভিসা নিয়েই দেখা দিয়েছিল অনিশ্চয়তা। প্রিজনেস ইন্টারন্যাশনালের আমন্ত্রণ পত্র, ছবির ডিভিডি কপি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং বিমানের কনফার্মড রিটার্ন টিকেট থাকার পরেও সদাশয় জার্মান সরকারের সাক্ষাৎ স্থানীয় প্রতিনিধির প্রশ্ন ছিল, ‘আপনি এর আগে কখনোই ইওরোপে যাননি কেন?’
প্রযোজকের উত্তর ‘আগে কখনো যাবার প্রয়োজন হয়নি বলেই যাইনি।’

প্রিজনেস ফেস্টিভ্যাল ভ্যেনুর বাইরে লেখক ফরিদুর রহমান

‘আপনার মেয়ে তো জার্মানিতে থাকে। আপনি নিশ্চয়ই তার সাথে দেখা করতে যাবেন?’ ভিসা অফিসারের প্রশ্ন। ওদের তথ্য ভাণ্ডারে সবার চৌদ্দ পুরুষের নাম ঠিকানা কর্ম অপকর্ম সবই জমা আছে, কাজেই গোপন করার কিছু নেই। তাছাড়া সত্য অস্বীকার করার দরকারই বা কী! অতএব প্রযোজকের উত্তর, ‘সাত দিনের ফেস্টিভ্যাল শেষে অবশ্যই মেয়ের সাথে দিন দশেক কাটিয়ে আসবো এবং সে জন্যেই তিন সপ্তাহের ভিসার আবেদন করেছি।’

সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখে এ্যাম্বেসি আমাদের বিদায় করে দিলেও দিন সাতেক পরে ইতিবাচক সিল ছাপ্পড় মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিল। টিকেট আগেই নিশ্চিত ছিল। মে মাসের ঊনিশ তারিখে উঠে পড়লাম ইত্তেহাদ এয়ারলাইন্সের বিমানে।

উৎসব শুরু হবে ২০ তারিখ সকালে, কিন্তু আমাদের জন্য মিউনিখের বেতার ভবনের কাছে নির্ধারিত আবাস, হোটেল রিজেন্টের বুকিং দেয়া আছে শেষ তিনদিন অর্থাৎ ২৩ থেকে ২৫ মে। কাছাকাছি সাশ্রয়ী কোনো হোটেলে জায়গা নেই আর যে সব হোটেলে জায়গা আছে সেখানে নিজের খরচে থাকতে গেলে ঢাকের দামে প্রতিমা বিক্রির অবস্থা হবে। আমার অবশ্য ইতিমধ্যেই এয়ারবিএনবি নামের অতিথি নিবাসে হোটেলের অর্ধেক খরচে রাত্রিযাপনের ভালো অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যেও আমার মতো অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ মানুষের অভাব নেই। কাজেই উৎসব এলাকার কাছাকাছি এয়ারবিএনবিগুলোও অতিথিদের জায়গা দিতে পারছে না। কাজেই খানিকটা দূরে, বাসে তিন স্টপেজের মতো দূরত্বে জনৈক উইলির তত্ত¡বধানে প্রথম চারদিন বসবাসের ব্যবস্থা করে ফেললাম।

মিউনিখে শেষবার এসে গেছি মাত্র দু বছর আগে, পথঘাট সম্পর্কে একটা ধারণা আছে। এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে ট্রেনে মিউনিখের প্রধান রেলস্টেশনে পৌঁছাতে পারলে সেখান থেকে এয়ারবিএনবি’র অতিথিশালায় ট্যাক্সিতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। আমাদের হোস্ট উইলিকে মেইল পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম মিউনিখ হফত বানহফ থেকে তোমার ওখানে পৌঁছাবার সবচেয়ে সুবিধাজনক ব্যবস্থা কী? সে উত্তর দিয়েছে, ‘খরচ বাঁচাতে চাইলে ২০ নম্বর ট্রামে উঠে লিওনার্দ স্টপেজে নেমে কয়েক মিনিট হেঁটেই আমার বাসায় চলে আসতে পারো। দুজনের টিকেট ৫.৪০ ইওরো। আর নিজেকে যথেষ্ট ধনী মনে করলে ট্যাক্সিক্যাবে আসতে পারো। সেক্ষেত্রে গুণতে হবে ১৫ ইউরোর মতো।’ আমরা যথেষ্ট ধনী না হয়েও প্রথমবারের মতো ট্যাক্সিতে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। অপরিচিত এলাকা এবং সাথে বাক্স পেটরাও নেহায়েত কম নয়। এসব টেনে আবার খানিকটা পথ হেঁটে এয়ারবিএনবি পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন হবে বলেই একটু বিলাসিতার সিদ্ধান্ত!

মিউনিখ এয়ারপো্ের্ট নন-ইওরোপিয় ইউনিয়নের যাত্রীদের লাইন দীর্ঘ হলেও বেশ দ্রæত ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বিমান বন্দরের সাথেই এয়ারপোর্টের রেল স্টেশন, শহরের সাথে সংযোগের ব্যবস্থাও চমৎকার, বাইরে কোথাও যাবার দরকার নেই। বহুতল ভবনের কোন তলায় আগমন, কোথায় নির্গমন এবং কোন স্তর থেকে ট্রেন ছেড়ে যায় এটুকু জানলেই চলে। উপরে নিচে ওঠা নামার জন্যে বিশাল এলিভেটরে এক সাথে ট্রলিতে লাগেজ বেডিং চাপিয়ে পাঁচ সাতজন যাত্রী অনায়াসে উঠে পড়তে পারে। ভুল বোতাম চেপে দেওয়ায় একবার উপরে একবার নিচে করে শেষ পর্যন্ত সঠিক ফোরে এসে নামলাম এবং টেনে উঠে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ মোটামুটি চল্লিশ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম।

সমস্যা হলো ট্রেন থেকে নামার পরে। এয়ারবিএনবি’র ঠিকানাটা ছিল মোবাইল ফোনে সেভ করা। চার্জের অভাবে ফোন কখন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। নোটবুকে উইলির ফোন নম্বর লেখা থাকলেও ঠিকানা নেই। স্টেশনের কয়েন বক্স থেকে উইলিকে কয়েকবার ফোন করার চেষ্টা করেও ধরতে পারলাম না। বাড়ির নম্বর বাইশ, কিন্তু রাস্তার নাম মনে নেই, এই অবস্থায় কেমন করে সঠিক জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব বুঝতে পারছিলাম না। সঙ্গে একটা আইপ্যাড আছে বটে, কিন্তু ইন্টারনেট কানেকশন না থাকলে এ যন্ত্রটা কোনো কাজের নয়। কেন যে এয়ারবিএনবি হোস্টের ঠিকানা কাগজে লিখিনি বা তার মেইল প্রিন্ট করে নিয়ে আসিনি, তা ভেবে মাথার বিরল হয়ে আসা কেশ ছেঁড়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে ঠিকানা পাবার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার সহযাত্রী এমনিতেই অস্থির, তার সাথে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘ উড়াল এবং রাত্রি জাগরণের কান্তি। ঠিকানা বিভ্রাটের কথা আংশিক শুনেই তিনি আরো অস্থির হয়ে পড়লেন।

আমার এই নাজেহাল অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে এলেন সম্রাট দম পেদ্রো। ব্রাজিলের শেষ সম্রাট যিনি প্রায় ষাট বছর অর্থাৎ আজীবন রাজত্ব করেছেন সেই দম পেদ্রোর নামে মিউনিখের একটি সড়কের নামকরণের রহস্য আমার জানা নেই। কিন্তু সম্রাট তাঁর মৃত্যুর ঠিক সোয়শ বছর পরে আমার একটি উপকার করেছেন। যখন উইলির অতিথিশালার রাস্তার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না তখন মনে পড়েছে সেটির সংলগ্ন সড়কের নাম দম পেদ্রো স্ট্রাসা। আমি একটা ট্যাক্সিক্যাবে উঠে চোখ বন্ধ করে বললাম দম পেদ্রো স্ট্রাসা। সম্রাটের সড়কে ঢুকে যাবার আগে আমি সারাক্ষণ আশেপাশে লক্ষ রাখছিলাম, কোনো ভাবে যদি কাক্সিক্ষত রাস্তার নামটা চোখে পড়ে তাহলে নিশ্চয়ই ঠিকানা বের করে ফেলতে পারবো। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে চালক দম পেদ্রো স্ট্রাসায় একটা চক্কর দিয়ে বাড়ির নম্বর জানতে চাইলে বলে দিলাম বাইশ নম্বর। সে ঠিকই বাইশ নম্বর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে তার বাহন নিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল।

ফেস্টিভ্যালে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে প্রযোজক মাহবুবা বেগম হেনা (বাম থেকে তৃতীয়)

আমি ঠিকই জানতাম ভুল জায়গায় এসে নেমেছি। তারপরেও আশে পাশে খোঁজ নিয়ে পাশের সড়কগুলোর নাম জানতে চেষ্টা করছিলাম। কিছু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আবারো দুই এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। দুজন মিলে গোটা ছয়েক ব্যাগ বাক্স স্যুটকেস টেনে ফুটপাথ থেকে একটু নিরাপদ জায়গায় নেবার চেষ্টা করছি। বাইশ নম্বর বাড়ির পাশেই একটা কিয়স্ক জাতীয় দোকানের সামনে জিনিসপত্রগুলো রেখে আশেপাশের রাস্তার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। দোকানে উপস্থিত আমাদের মতো এশিয়ান চেহারার সম্ভবত শ্রীলঙ্কান লোকটি বাংলা তো দূরে থাক ইংরেজি, হিন্দি এমন কি অল্পসল্প জার্মানও জানে না। কাজেই মাহবুবা বেগমকে কিয়স্কের দরজায় রেখে আমি ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। রাস্তার শেষ মাথায় পথের দিশা না পেলেও একটা হোটেল আবিষ্কার করা গেল। ফিরে এসে প্রয়োজককে বললাম এ ভাবে ঠিকানা খুঁজে পাবার সম্ভাবনা কম, এখন কী করা যেতে পারে! ইতিমধ্যে বৃষ্টি ছেড়ে গেলেও সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, একই সাথে বাড়ছে ঠাণ্ডা। প্রযোজক বললেন, ‘এ ভাবে পথে পথে না ঘুরে এক রাতের জন্যে কোনো একটা হোটেলে উঠে পড়লেও তো হয়। সম্মতির সাথে সাথে আর দেরি না করে, যে লাগেজ অন্তত দুটো ট্রলিতে ঠেলে নিয়ে যাবার কথা সেই পরিমান মালপত্র দুজনে টেনে-হিঁচড়ে-বয়ে-ধাক্কিয়ে রাস্তার শেষপ্রান্ত থেকে একটু বাঁয়ে যে হোটেল দেখে এসেছিলাম সেখানে উঠে পড়লাম।

হোটেলের রিসেপশানে তখন একদল ট্যুরিস্ট ভিড় করে চেক-ইন করছে। এর মধ্যেই কথা বলে একটা রুম নিশ্চিত করে এসে লবিতে বসলাম, ভিড় কমলেই আমাদের ডাক আসবে। তখন বাড়তি ষাট ইওরো গ”চা দেবার মানসিক প্র¯‘তি নিয়ে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে আই-প্যাড বের করে চালু করার সাথে সাথে হোটেলের ওয়াইফাই কানেক্টটেড হয়ে গেল। পর মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো উইলির সর্বশেষ ই-মেইল। নিচে ঠিকানা বাইশ নম্বর হিউবনার স্ট্রাসে। করণীয় ঠিক করে ফেললাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে বেরিয়ে পড়লামহোটেলের রিসেপশান থেকে ডাক আসার আগেই।

আমরা যে কিয়স্কে দাঁড়িয়েছিলাম তার সামনে দিয়ে এগিয়ে একটু বাঁয়ে ঘুরে মিনিট তিনেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম বাইশ নম্বর হিউবনার স্ট্রাসে। অর্থাৎ চিরদিনের অভ্যাস মতো বাঁয়েস্থা খুঁজে ডান দিকের পথ ধরে অর্ধেকটা গেলেই যথাস্থানে পৌঁছে যেতাম অনেক আগেই। (চলবে…)