জেমস ক্লিয়ার : অভ্যাস মানুষকে তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত করে। যখন একজন মানুষ এক জীবনে বিষ্ময়কর কিছু অর্জন করেন তখন আমরা মনে করি মানুষটি নিশ্চয় যাদু জানেন। বিষ্মিত হই, ভাবি কিভাবে সম্ভব। অসলে তার মৌলিক স্বভাবই তাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। মানুষের পারিপার্শিক অবস্থা, মানসিক ও শারিরীক অবস্থা, ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধ, মূল্যবোধ ইত্যাদি মানুষের অভ্যাস গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখে। মানুষ চেষ্টা করলে খুব সহজেই অনেক ভাল অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন এবং খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেন। মানুষ তার আচরণে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন করে জীবনে বিশাল সফলতা পেতে পারেন। অভ্যাসে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ পরিবর্তন ঘটিয়ে কিভাবে নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করা যায় তা নিয়ে লেখক, উদ্যোক্তা এবং আচরণ বিশেষজ্ঞ জেমস ক্লিয়ার তার নাম্বার ওয়ান নিউ ইয়র্ক টাইম সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থ ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। তিনি জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরোসায়েন্স থেকে ধারণাগুলি সংগ্রহ করেন যাতে ভাল অভ্যাসগুলিকে অনিবার্য এবং খারাপ অভ্যাসগুলিকে অসম্ভব করে তোলা যায়। সহজে বোঝা যায় এমন একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এ যাবৎ ৪ মিলিয়নেরও বেশি সংখ্যক ‘এ্যাটমিক হ্যাবিট’ গ্রন্থটি বিক্রি হয়েছে। গ্রন্থটি সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছেন উন্নয়ন সংগঠক ও অনুবাদক কোরবান আলী।
চার.
মৌলিক প্রাথমিক নীতিমালা
অভ্যাসে অতি সূক্ষ্ণ পরিবর্তন কেন মানুষের জীবনে বিশাল সাফল্য এনে দিতে সক্ষম
নীতিমালা-১
সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ অভ্যাসের বিষ্ময়কর শক্তি
২০০৩ সালের একদিন ব্রিটিশ সাইক্লিংয়ের ভাগ্য বদলে যায় যখন গ্রেট ব্রিটেনে পেশাদার সাইকেল চালকদের সংগঠনটির গভর্নিং বডি ডেভ ব্রেইলসফোর্ডকে পারফর্মিং ডিরেক্টর হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এ সময় গ্রেটব্রিটেনে পেশাদার সাইকেল চালকরা প্রায় একশ বছরব্যাপী মধ্যম মানের সফলতা পেয়ে আসছিলেন। ১৯০৮ সালে গ্রেট ব্রিটেনের সাইকেল চালকরা অলিম্পিক গেমসে মাত্র একটি স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। এবং তারা সাইক্লিংয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগীতার আসর ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ এ আরও অনেক বেশি খারাপ করেছিলেন, ঐ টুর্নামেন্টে ১১০ বছরে কোনও ব্রিটিশ সাইক্লিস্ট কখনও কোন ইভেন্ট জিততে পারেননি।
আসলে ব্রিটিশ সাইক্লিংয়ের সাইকেল চালকদের পারফরম্যান্স এতটাই খারাপ ছিল যে ইউরোপের শীর্ষ বাইক প্রস্তুতকারকরা দলটির কাছে বাইক বিক্রি করতে অস্বীকার করেছিল। কারণ অন্যান্য পেশাদার সংগঠন দেখবে ব্রিটিশ সাইকেল চালকরা একই সাইকেল ব্যবহার করে খুবই খারাপ পারফরম্যান্স করছে। তারা ভয় পেয়েছিল যে তাদের বিক্রয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্রেইলসফোর্ডকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ সাইকেলিং সংগঠনটিকে একটা নির্দিষ্ট গতিপথে পরিচালানোর জন্য। একটি কৌশলের জন্য তাকে আগের কোচদের থেকে আলাদা করা যায়। সেটা হচ্ছে একটা নির্দিষ্ট কৌশলের প্রতি তার নিরলস লেগে থাকা। তিনি ‘প্রান্তিক সাফল্যের সমষ্টির’কথা বলেছেন। অর্থাত প্রতিটা কৌশল প্রয়োগের শেষে একটা সূক্ষ সাফল্য খুঁজে ফেরার দর্শন। আপনি যে কৌশলই অবলম্বন করেন না কেন তাতে আগের চেয়ে উন্নতির একটি ক্ষুদ্র ব্যবধান অনুসন্ধান করা। ব্রেইলসফোর্ড বলেন, ‘পুরো নীতিটি এই ধারণা থেকে এসেছে যে আপনি যখন সাইকেল চালনায় সম্পূর্ণভাবে হতাস হয়েছেন এবং তারপর আবার শুরু করে আপনি আগের চেয়ে ১ শতাংশ উন্নতি পেলেন, এতে হতাস হবার কোন কারণ দেখি না, যখন আপনি সকল প্রান্তিক সাফল্যগুলোকে একত্রিত করবেন তখন একটা বিশাল উল্লেখযোগ্য সাফল্যের মালিক হবেন।’
ব্রেইলসফোর্ড এবং তার সহকর্মী কোচবৃন্দ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমন্বয় দিয়ে শুরু করেছিলেন। যেমনটি আপনি একটি পেশাদার সাইক্লিং দলের কাছ থেকে আশা করেন। বাইকের আসনগুলিকে নতুন করে ডিজাইন করলেন যাতে আসনগুলি আরও আরামদায়ক হয়। আরও ভাল গ্রিপের জন্য টায়ারে অ্যালকোহল ঘষার রেওয়াজ শুরু করলেন। তারা পেশাদার সাইকেল চালকদের বৈদ্যুতিক পোশাক পরতে বললেন যাতে সাইকেল চালানোর সময় পেশীর আদর্শ তাপমাত্রা বজায় থাকে। একটি নির্দিষ্ট ওয়ার্কআউট প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক ক্রীড়াবিদের পার্ফরমেন্স নিরীক্ষা করার জন্য বায়োফিডব্যাক সেন্সর ব্যবহার করেন। দলটি একটি বায়ু সুড়ঙ্গে সাইকেল চালনায় বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের তৈরি পোষাক পরীক্ষা করেন এবং তাদের আউটডোর সাইকেল চালকদের ইনডোর প্রতিযোগিতায় একই পোষাক পরে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন, এক্ষেত্রে পোষাকটি অনেক হালকা এবং আরও অ্যারোডাইনামিক প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু তাদের এ সমস্ত ক্ষুদ্র প্রয়াস গুলো কখনও থেমে থাকেনি। অল্প একটু ভালো করার জন্য তারা নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

ব্রেইলসফোর্ড এবং তার সহকর্মীবৃন্দ উপেক্ষিত এবং অপ্রত্যাশিত বিষয়গুলা যাচাই-বাছায়ের কাজে সদা জাগ্রত, তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ১ শতাংশ উন্নতি। তারা বিভিন্ন ধরণের ম্যাসেজ জেল পরীক্ষা করে দেখেন কোনটি দ্রæততম সময়ের মধ্যে পেশীর স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। তারা প্রত্যেক পেশাদার সাইকেল চালকের সর্দিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমিয়ে আনার জন্য একজন সার্জন নিয়োগ দিয়েছেন, তিনি তাদের হাত ধোয়ার সর্বোত্তম উপায় শেখাবেন। তারা বালিশ এবং তোষকের ধরন নির্ধারণ করেছেন যাতে করে প্রত্যেক প্রতিযোগী সর্বোত্তম রাতের ঘুমের স্বাদ পায়। এমনকি তারা প্রতিযোগী দলটিকে পরিবহণের জন্য যে বাস ব্যাবহার করেছেন সেটির ভিতরের অংশে সাদা রঙ করেছেন, যা তাদের সামান্য ধূলিকণা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। এত তুচ্ছ বিষয় সাধারণত অলক্ষিত থেকে যায় কিন্তু সূ² ধূলিকণা যতœ সহকারে প্রস্তুতকৃত বাইকের কর্মক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।
এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস গুলোর সমন্বয়ে শত শত সূক্ষ উন্নতি সঞ্চিত হয়। ফলে ভালো ফলাফল মানুষের কল্পনা শক্তির চাইতেও দ্রুত গতিতে অর্জন সম্ভব হয়েছিল।
ব্রেইলসফোর্ড দায?িত্ব নেওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পর, ব্রিটিশ সাইক্লিং দল ২০০৮ সালের অলিম্পিকে সড়ক এবং ট্র্যাক সাইক্লিং ইভেন্টে আধিপত্য বিস্তার করে। বেইজিং অলিম্পিক গেমসে বিস্ময়করভাবে তারা ৬০ শতাংশ স্বর্ণপদক জিতেছে। চার বছর পর যখন অলিম্পিক গেমস লন্ডনে অনুষ্ঠিত হল তখন ব্রিটিশরা নয়টি অলিম্পিক সেটে অলিম্পিক রেকর্ড এবং সাতটিতে বিশ্ব রেকর্ড করেছিল।
একই বছর ব্র্যাডলি উইগিন্স প্রথম ব্রিটিশ সাইক্লিস্ট ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ জয় করেন। পরের বছর তার সতীর্থ ক্রিস ফ্রæম ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ জিতেছেন এবং তিনি জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে জয়ী হন। কোচবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ব্রিটিশ দলকে ছয় বছরের ছয়টি ‘ট্যুর ডি ফ্রান্সের’ মধ্যে পাঁচটিতেই জয় এনে দেয়।
২০০৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত দশ বছরে ব্রিটিশ সাইক্লিস্টরা ১৭৮টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন এবং ৬০টি অলিম্পিক বা প্যারালিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছেন এবং পাঁচটি ‘ট্যুর ডি ফ্রান্স’ জয় করেন। এটি সাইক্লিংয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দৌড় হিসেবে বিবেচিত।
কিভাবে সম্ভব হল? কিভাবে সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ প্রয়াস, আপাতদৃষ্টিতে যেগুলো খেল প্রয়াস মনে হয়েছিল সেগুলোই অতিসাধারণ ক্রীড়াবিদদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নে রূপান্তর করল? কেন ছোট উন্নতিগুলি এত গুরুত্বপূর্ণ? এবং কিভাবে আপনি আপনার নিজের জীবনে এই পদ্ধতিকে কাজে লাগাবেন?
কেন সূক্ষাতিসূক্ষ অভ্যাসগুলো পরিশেষে বিশাল পার্থক্য বয়ে আনে
একটি মুহুর্তের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করা বা হেলায় হারিয়ে দেয়া যেমন সহজ ঠিক তেমনি ভাবে প্রতিদিনের সামান্য উন্নতির প্রকৃত মূল্যকে অবমূল্যায়ন করাও সহজ। প্রায়ই আমরা নিজেদেরকে বোঝাই যে বিশাল সাফল্যের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপের প্রয়োজন। ওজন কমানো, একটি নতুন ব্যবসা সৃষ্টি করা, একটি বই লেখা, একটি চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা বা অন্য কোনো লক্ষ্য অর্জন করা হোক না কেন আমরা নিজেদের উপর পৃথিবী-বিধ্বংসী উন্নতি করার জন্য চাপ সৃষ্টি করি। এমন কথা সকলেই বলে থাকেন।
একদিক থেকে বিবেচনা করলে ১ শতাংশ উন্নতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কোন বিষয় না আবার এটি কোন মানুষের দৃষ্টিও আকর্ষণ করে না – তবে দীর্ঘমেয়াদে সংখ্যাটি অনেক বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে । একটি ক্ষুদ্র উন্নতি সময়ের ব্যাবধানে বিষ্ময়কর সাফল্য এনে দিতে পারে । এ সমস্ত ক্ষেত্রে গণিত যে ভাবে কাজ করে: আপনি যদি একটা বছরের প্রতিদিন ১ শতাংশ উন্নতি করেন, তবে বছর শেষে সাঁইত্রিশ গুণ উন্নয়ন হবে। বিপরীতভাবে আপনি যদি বছরের প্রতিদিন ১ শতাংশ খারাপ করেন তবে আপনি প্রায় শূন্যে নেমে আসবেন। একটা ছোট্ট জয় বা অবনতি দিয়ে শুরু করলে সময়ের ব্যাবধানে সেটা অনেক বড় আকার ধারণ করে।
প্রতিদিন ১% ভাল
বছরে প্রতিদিন ১% অবনতি= ০.৯৯ ৩৬৫ = ০০.০৩
বছরে প্রতিদিন ১% উন্নতি= ১.০১ ৩৬৫ = ৩৭.৭৮
অভ্যাস ব্যক্তির উন্নতির যৌগিক ফলাফল। চক্রবৃদ্ধি সুদ যেভাবে অর্থের বৃদ্ধি ঘটায় একই ভাবে আপনি যতবার আপনার নির্দিষ্ট অভ্যাসটির পুণরাবৃত্তি ঘটাবেন অভ্যাসের প্রভাব বা ফলাফলও চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়বে। কোন নির্দিষ্ট দিনে লাভের পরিমান অতি সামান্য হতে পারে এক মাস বা এক বছর পরে লাভের পরিমান একটা বিশাল সংখ্যায় পরিনত হবে। দুই, পাঁচ বা দশ বছর পরে পিছন ফিরে দেখলেই ভালো অভ্যাসের মূল্য এবং খারাপ অভ্যাসের প্রতিফল আকর্ষণীয়ভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।..(চলবে)
কোরবান আলী, অনুবাদক, টরোন্ট, ক্যানাডা।