মনীষ পাল : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের উপদ্রব শুরু হতে না হতেই কানাডায় অভিবাসন একেবারে থমকে পড়ে। ১৯১৩ সালের সর্বোচ্চ চার লক্ষ অভিবাসীর তুলনায় মাত্র দু বছরের মাথায় ১৯১৫ সালে সে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় চৌত্রিশ হাজার। যুদ্ধের দামামা শেষ হলেও দ্বিতীয় দশকে প্রথম দশকের সেই জনস্রোত আর ফিরে আসেনি। তবুও যুদ্ধপরবর্তী অভিবাসনে বাইরে থেকে আসা মানুষের প্রভাব ছিল বই কি, দ্বিতীয় দশকের শেষের তিন বছর অভিবাসন আবারো জোরালো হতে শুরু করে।

দেশটিতে সেই সময় প্রতি বছর প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ পাড়ি জমায়। কিন্তু দশক না ঘুরতেই আবার ভূরাজনীতিতে অর্থনৈতিক মন্দা আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনিসংকেত দেখা দিতে শুরু করে। বেকারত্বের সংকটে স্থানীয়রা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ভীষণ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠতে থাকে। তিরিশের আগের বছরগুলোতে অতিরিক্ত মানুষের আগমনে দেশটির কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেঞ্জি কিং এবং পরবর্তীতে আর, বি, বেনেট স্থানীয়দের চাপের মুখে অভিবাসন সংকোচনের জন্যে নতুন সব পদক্ষেপ নেন। সেসবের আওতায় শুধু কৃষিকাজে দক্ষ ব্রিটিশ বা মার্কিনীরাই আবেদনের যোগ্যতা রাখে তাও আবার যারা অর্থশালী।

এতোসব বিরূপ পদক্ষেপের মুখে তিরিশের দশকে অভিবাসনের রথ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করে। কানাডায় যত না মানুষ ঢুকেছে, বেরিয়ে গেছে তারো চেয়ে বেশি। এ কারণে বিশ শতকের মধ্যে তিরিশের দশকই একমাত্র ব্যতিক্রম যে সময়ে কানাডায় বিদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের সংখ্যা বাইশ শতাংশ থেকে আঠারো শতাংশে নেমে আসে। এ সময়ে আরো একটি চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটে যায়। বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে সংখ্যায় পুরুষের অভিবাসন ছিল নারীদের তুলনায় বেশি, কিন্তু তিরিশ এবং চল্লিশের দশকের সংকোচননীতির কারণে জনমিতির ধরন বদলে যায়; এই সময় প্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের ষাট থেকে প্রায় সত্তর ভাগই ছিল নারী; লিঙ্গের অসমতায় তা কিছুটা হলেও ভারসাম্য এনে দেয়। যদিও নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লিঙ্গের সমতা নিয়ে অভিবাসনের আগের ধরণ কিছুটা বদলে দিয়েছে, কিন্তু অভিবাসনের অন্যান্য প্রবণতা খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। অভিবাসীদের অধিকাংশই অন্টারিও, ম্যানিটোবা, সাস্কাচেওয়ান, আলবার্টা আর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মতো অর্থনীতি সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে বসতি গেড়েছে। পার্থক্য একটাই, বিশ শতকের মাঝামাঝি তখনকার অভিবাসীরা যেখানে বসবাসের জন্য উপশহর বা শহরতলীকে বেছে নিয়েছে, একই শতকের শেষে এসে তাদের উত্তরসূরিরা বেছে নেয় বড়ো শহরকে।

যা বলছিলাম, অভিবাসনের উল্টোযাত্রায় নতুন অভিবাসীদের অনেকেই ফিরে যায়, বাকিদের জোর করে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর যারা থেকে যায়, তাদের অবস্থা আরো দূর্বিষহ হয়ে ওঠে। তারা স্থানীয়দের বিভিন্ন ধরণের রোষের শিকার হয়; ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে এশীয়রা ভোটের অধিকার হারায়, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও তাদের উপর নিষেধের খড়গ নেমে আসে। ইহুদীরাও নানান বৈষম্যের শিকার হয়, যেসব ইহুদী জার্মানিতে নাৎসি নিপীড়ণের সময় আগেই কানাডায় অভিবাসী হয়, তারাই নতুন ইহুদীবিরোধী মনোভাবের জন্য অনেকটা দায়ী। তিরিশের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রায় আড়াই লক্ষের মতো ইহুদীর অভিবাসন হয়, কানাডায় তখন মাত্র চার হাজারকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়।

এশিয়ার দেশগুলো থেকেও অভিবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। জার্মানির উপর যুদ্ধ ঘোষণার সাথে সাথে শত্রু দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। শরণার্থী বিষয়ে কোনো নীতি না থাকার কারণে যুদ্ধের ধ্বংস থেকে যারা পালিয়ে বাঁচতে চায়, তাদের উপরও শত্রæদেশের উপর নেয়া নীতির খড়গ ঝুলিয়ে দেয়া হয়। স্বভাবতই তাদের মধ্যে ছিল ইউরোপ থেকে ইহুদি শরণার্থীরা। যুদ্ধকালীন জরুরি ব্যবস্থার আওতায় এদেশে আসা অনেককেই জোর জবরদস্তি করে বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় – তাদের মধ্যে ছিল জাপানি অভিবাসী, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উপক‚ল বরাবর একশো মাইলের মধ্যে যাদের ছিল ঘরবসতি। তাদেরকে সন্দেহ করা হয় জাপানি গুপ্তচর হিসেবে, জাপান যদি আক্রমণ করে বসে, তাহলে তারা জাপানকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে।

বহিষ্কারের শিকার অন্তরীণ জাপানী অভিবাসীরা জাহাজের অপেক্ষায়
সৌজন্যে : কানাডিয়ান মিউজিয়াম অফ হিস্ট্রি

কানাডায় অভিবাসনের অনুমতির ব্যাপারটি নিয়ে জনবিতর্ক শেষ হয়েও হয়নি, সেই সাথে অভিবাসন নীতির অগ্রগতিও তেমন এগোয়নি। ১৯১৯ সালের নতুন নীতিতে অভিবাসীদের বহিষ্কার বিষয়ে নতুন নিয়ম জারি হয়, সেই সাথে বহিরাগতদের আগমন কিভাবে ঠেকানো যায়, সেই বিষয়টিও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বযুদ্ধের সময় শত্রু দেশগুলোর নাগরিকদের বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনার পর শ্রমবাজার ভীষণভাবে সংকুচিত হয়ে পড়ে আর দুর্দশা নেমে আসে কৃষি থেকে শুরু করে গৃহকর্মে নিযুক্ত হাজারো কর্মী শ্রমিকদের, তাদেরকে অভিবাসনের সম্ভাব্য তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। সেই সাথে ইতোমধ্যে যারা অভিবাসী, তাদের আপনজনরাও সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়।

তিরিশের দশকের এই বর্জন নীতির ফল দাঁড়ায় নাটকীয়। এই সময়ে গড়পড়তা মাত্র ষোলোহাজার অভিবাসী প্রবেশের অনুমতি পায়, যা বিশের দশকের বছরপ্রতি এক লক্ষ ছাব্বিশ হাজার এর তুলনায় অনেক বড়ো পতন। উনিশ শতাব্দীর পালা বদলের মাহেন্দ্রক্ষণে এক মন্ত্রীর বিখ্যাত উক্তি ছিল- ‘কানাডায় কোনো বর্জন নীতি নেই, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে আগত মানুষকে প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য সীমান্তে প্রহরী মোতায়েন সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’ অথচ মাত্র তিরিশ বছর অতিক্রম না হতেই কানাডার অভিবাসন ঠিক তার বিপরীত নীতিতেই মোড় নেয়। একদিকে সীমান্তে কড়াকড়ি শুরু হয়, আবার অন্যদিকে দেশ থেকে বহিষ্কারের হিড়িক লেগে যায়।

১৯১৯ এর অভিবাসন নীতির অপপ্রয়োগে মহামন্দার সময়ে বহিষ্কারের হার চরমভাবে বেড়ে যায়; সেই সময় প্রায় পঁচিশ হাজার অভিবাসীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। যদিও বেকার জনগোষ্ঠী ছিল এর মূল নিশানা, কিন্তু কারো শারীরিক অসুস্থতা বা তথাকথিত চারিত্রিক অনৈতিকতাও কানাডা থেকে বিতাড়নের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

দারিদ্র্য ছিলো অভিবাসন কর্তৃপক্ষের গৃহীত বর্জন নীতির অন্যতম কারণ। ১৮৬৯ এর অভিবাসন আইনে কপর্দকহীন ব্যক্তিকে আলাদা করে সনাক্ত করা হয়, সেই সময় এরকম কেউ কানাডার সীমান্তে ঢুকে পড়লে তার রক্ষণাবেক্ষণ আর পরিবহনের দায়ভার এসে পড়তো জাহাজের নাবিকের উপর। এসব কড়াকড়ি সত্তে¡ও ১৯৩০ সালে এসে নামমাত্র শারীরিক অসুস্থতা অগ্রাহ্য করবার বিষয়ে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ কিছুটা নমনীয় হয় কিন্তু মন্দা দেখা দেয়ার সাথে সাথে কাজের সংস্থান কমতে থাকে আর সেই সাথে বাড়তে থাকে স্থানীয়দের চাপ। ফলে সরকারের এই নমনীয়ভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। উইনিপেগের একটি উদাহরণ টেনে দেখানো হয়, মন্দা পূর্ববর্তী ১৯২৭-২৮ এ যেখানে ত্রাণের পরিমাণ ছিল একত্রিশ হাজার, মন্দার সময়ে ১৯৩০-৩১ এ এসে সেটি দাঁড়ায় দেড় মিলিয়ন এর উপর, যা আগের সময়ের তুলনায় পঞ্চাশ গুণ বেশি। এই অতিরিক্ত খরচ সামাল দিতে অভিবাসীদেরকেই তুরুপের তাস হিসেবে বেছে নেয়া হয়, স্থায়ী বাসিন্দা অথচ নাগরিকত্ব নেই, তাদেরকে বহিষ্কারের জন্য স্থানীয়দের বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের কাছে আবেদনের বন্যা বয়ে যায়।

সরকার তড়িঘড়ি করে তথাকথিত ‘অনাকাক্সিক্ষতদের’ বিতাড়নের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলে, কানাডা চাকুরীচ্যুতদের বহিস্কার করছে না, যারা কাজের একেবারেই যোগ্য নয়, তাদেরই ফেরত পাঠানো হচ্ছে। নানান রূপে এই অযোগ্যতাকে ন্যায্যতা দেয়া হয় – কখনো কারাগারে বন্দী কারো দণ্ডাদেশকে বহিষ্কারের কারণ হিসেবে দেখানো হয়, আবার কখনো জনগণের করের টাকার দোহাই দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়া হয়। ব্যক্তি অপরাধী, অসুস্থ বা দরিদ্র যাই হোক না কেন, অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয় জনগণের করের উপর বোঝা আর পরিণতি দাঁড়ায় একটিই – দেশ থেকে বিতাড়ন।
এই বহিষ্কারযজ্ঞ জাহাজ এবং রেল পরিবহন ব্যবসায় বরং সুদিন নিয়ে আসে; তারা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজনকে কানাডায় নিয়ে আসে আবার এখান থেকে নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। উনিশশো তিরিশ এবং সাঁইতিরিশ সালের মধ্যে, প্রতি দু থেকে তিনজন প্রবেশের অনুমতি পেলে তার মধ্যে একজনকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। সব মিলিয়ে এই সাত বছরের মধ্যে পঁচিশ হাজার লোককে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। বহিষ্কারের জন্য যাদের আটক করা হয়, তাদের চাপে দেশের নানান জায়গায় বন্দিশিবিরগুলো উপচে পড়ে। এই অমানবিক বিষয়গুলো বিদেশী সরকারের চোখ এড়ায়নি। নেদারল্যান্ডস-এর সরকারের প্রতিনিধি সেদেশ গামী প্রত্যেক বহিষ্কৃতর ব্যাপারে তথ্য জানতে চায়।

জাহাজগুলোও প্রশাসনিক নানান জটিলতার ব্যাপারে তাদের অভিযোগ সরকারকে জানায়। মন্দা সামলাতে কানাডার সরকারের এসব কৌশল ছিলো অকেজো আর তাই শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যেতে বাধ্য হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত আর বলশেভিকদের রুশ বিপ্লব জার্মানি, রাশিয়া, ইউক্রেন এবং আরো অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে সেসময় কানাডায় অভিবাসন ত্বরান্বিত করে। তিরিশের মহামন্দার সময়েও অভিবাসীদের বড়ো অংশ আসে ইউরোপ থেকে, তার বাইরে থেকে আসা অভিবাসী ছিল ছয় শতাংশেরও কম। মন্দার কারণে অর্থনীতিতে বেহাল পরিবেশ, সবকিছুর মতো অভিবাসনেও নেমে আসে স্থবিরতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। অভিবাসন আবার ধীরে ধীরে গতি পেতে শুরু করে যখন যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপীয়রা স্বদেশের বাইরে আবার নতুন জীবনের খোঁজে কানাডাকে বেছে নিতে শুরু করে, কানাডার অর্থনীতিতেও দরকার হয়ে পড়ে নতুন দক্ষ শ্রম।

পরবর্তী সংখ্যায় : অর্থনীতির তেজীভাব ও অভিবাসনের জোয়ার