মনীষ পাল : বহুল আলোচিত এই শতকে অভিবাসীদের অবদান শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে নয়, সেই সাথে তারা অবদান রেখেছে দেশটির বৈচিত্র্যে, তার শহরে নগরে, অর্থনীতিতে। শেষের কয়েক দশকে অর্থনীতির গতিপথের পরিবর্তন হয়, সেই সাথে বাঁক নেয় কর্মসংস্থানের সুযোগ উৎপাদন খাত থেকে সেবা খাতে আর সেসব বদলে যাওয়া শিল্পে অভিবাসীরাই হয়ে উঠে শ্রমের গুরুত্বপূর্ণ জোগাড়। তারপরও সবাই কাজের সমান সুযোগ পেয়েছে, এটা বলা যাবে না। এখনো যেমন, বিগত শতকেও প্রত্যেক অভিবাসীর কর্মসংস্থানের অভিজ্ঞতা তার একান্ত নিজের – লিঙ্গ, বয়স, শিক্ষা, ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার উপর দক্ষতা এমনকি এই দেশে অবস্থানের মেয়াদ ইত্যাকার সব বিষয় অভিবাসীর কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একটা নতুন সমাজে বাস করতে আসা চাট্টিখানি কথা নয়, বিশেষ করে নতুন কাজের সন্ধান, নতুন একটা ভাষা শেখার চেষ্টা বা দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, আইন কানুন বুঝতে পারা প্রভৃতি বিষয়ে অভিযোজনের সময় দরকার। সেই সময়ে সদ্য আগত অভিবাসীদের শ্রম বিন্যাসের চালচিত্র দেখলে এই ব্যাপারটি বোঝা যায় – দীর্ঘদিন ধরে যারা বাস করে আসছে, তাদের তুলনায় সদ্য আগতরা বেকারত্বের বোঝা বয়েছে অনেক বেশি বা কাজের সুযোগ পেলেও সেই কাজ তাদের শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সাথে মানানসই নয় আর স্বভাবতই তাদের উপার্জন থেকে যায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

১৯৯৬ সালের একটা হিসেবে দেয়া যাক। সেই সময় তরুণ ও মধ্যবয়সীদের মধ্যে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ এবং চাকরির সুযোগ দুটোই স্থানীয় বংশোদ্ভূতদের তুলনায় অনেক কম অথচ অভিবাসীরা সাধারণভাবে শিক্ষায় ছিল অনেক এগিয়ে; শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি অভিবাসী কানাডার স্বীকৃত ভাষা দুটোর অর্থাৎ ইংরেজি বা ফরাসির যে কোনো একটিতে যোগাযোগে সক্ষম ছিল। পেশাজীবী কাজে পুরুষ অভিবাসীদের অবস্থান যদিও অপেক্ষাকৃত ভালো ছিল, কিন্তু নারী অভিবাসীরা অর্থনীতি, প্রশাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সরকারি সেবা খাতে স্থানীয়দের তুলনায় অনেক উপেক্ষিত থেকে যায়। উপার্জনের দিক থেকেও তাদের আপোষ করতে হয়। অতীতে সদ্য আগত অভিবাসী এবং স্থানীয়দের মধ্যে বৈষম্য সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই কমে আসে। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব নব্বই এর দশকে সেই বৈষম্যকে আবারো সামনে নিয়ে আসে। স্থানীয়রাও খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল না বরং তাদেরও মন্দার সময়টিতে কাজের জোগাড় করতে বেগ পেতে হয়। বিশ শতকের শেষ দুই দশকে অভিবাসী এবং স্থানীয়দের মধ্যে কর্মসংস্থান এবং বেতন বৈষম্য দুটোই বেড়ে যায়। এতে বোঝা যায়, তখনো নবাগতরা শ্রমবাজারে অভিযোজনের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে কঠিন সময় পার করে।

যদি বলা হয়, কানাডায় বিশ শতক এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সময়, তাহলে খুব বেশি এটা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এই একশো বছরে পরিবর্তন দেখা যায় অর্থনীতি, পরিবার, আইন সবক্ষেত্রে। পরিবর্তনের এই ঘনঘটায় অভিবাসন। ব্যতিক্রম নয়। অভিবাসনের জোয়ার ভাটা অর্থনীতির জোয়ার ভাটার সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত, সেই সাথে অভিবাসনে প্রভাব পড়ে দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের, জাতীয় অভিবাসন নীতির পরিবর্তন। অভিবাসনের ব্যাপ্তি বা চরিত্রে প্রভাব ফেলে যায়। তাছাড়া সারা পৃথিবীজুড়ে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সংযুক্তিও পরোক্ষভাবে অভিবাসনে বড়ো আকারে পরিবর্তন নিয়ে আসে।

আশির দশকে প্রথম ভিয়েতনামী শরণার্থী দলের কুইবেকে আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করা হয়
সৌজন্যে : দ্য কানাডিয়ান এনসাইক্লোপিডিয়া

তাই গত একশো বছর অভিবাসন এক নাজুক সময় অতিবাহিত করে। বিশ শতকের শুরু হয় সর্বোচ্চ সংখ্যক অভিবাসী দিয়ে, কিন্তু এক দশক থেকে পরের দশকে সেই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে উঠানামা করে। তিরিশের দশকে মন্দায় অভিবাসনে নেমে আসে স্থবিরতা। তারপরও শতাব্দীর শেষের দিকে অভিবাসীদের সংখ্যা এমনভাবে বেড়ে যায় যা কানাডার নীট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অভিবাসনের অন্য পরিবর্তনগুলো একধরণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দিয়ে বোঝা যায় – যেমন লিঙ্গের অসমতা সারা শতাব্দী ধরেই ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। এই প্রবণতার পেছনে দুটো কারণ রয়েছে – প্রথমটি হচ্ছে, দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং মহামন্দার সময় পুরুষ অভিবাসীদের সংখ্যা যায় কমে আর উল্টোদিকে শেষ পঞ্চাশ বছরে পারিবারিক অভিবাসনের কারণে নারীদের সংখ্যা যায় বেড়ে। তাই সময় যত এগোয়, অভিবাসীদের সংখ্যায় লিঙ্গের ভারসাম্য ততো বাড়তে থাকে।

এখানে আরো একটি প্রবণতা আমরা দেখতে পাই। বসবাসের জন্য অভিবাসীরা শহরকেই প্রাধান্য দেয়, এমনকি বিশ শতকের প্রথমদিককার অভিবাসীরাও শহরকেই বেছে নিতে শুরু করে। শতকের শেষে এসে সেই প্রবণতা আরো জোরালো হয়। নবাগতদের বড়ো একটি অংশ বসবাসের জন্য মূলত তিনটি বড়ো শহরকেই বেছে নেয় – টরন্টো, ভ্যানকুভার আর মন্ট্রিল।
এদিকে গত একশো বছরে অভিবাসী নির্বাচনে সরকারের নীতিরও বারবার পরিবর্তন হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপ ছাড়া পৃথিবীর অন্য অংশ থেকে অভিবাসী নিয়ন্ত্রণ করবার লক্ষ্যে প্রথম পঞ্চাশ বছরে যাবতীয় চেষ্টা চালানো হয়। এতে কোনো কার্যকর সুফল মেলেনি। তাই ষাটের দশকে সরকার নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়, আর সেই থেকে কানাডায় প্রবেশের অনুমতির জন্য অভিবাসীদের জন্মস্থান এর বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়। পরিবর্তিত নীতিতে পারিবারিক একত্রীকরণ, অর্থনৈতিক অবদান এবং মানবিক বিবেচনা নতুন করে প্রবিধানে সংযোজন করা হয়। এসব পরিবর্তনের ফলে, কানাডায় অভিবাসীদের উৎস দেশের গঠনকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তারই ফল দাঁড়ায়, ১৯৯৬ সাল নাগাদ কানাডায় অভিবাসীদের অর্ধেকেরও বেশির জন্মস্থান অন্য সব দেশে, ব্যতিক্রম শুধু যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইউরোপ। একেই বলে ইতিহাসের নিয়তি বা নিয়তির ইতিহাস। যে দুটো দেশ আর একটি মহাদেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিক কানাডায় ঢুকতে পারতো না, আজ শতাব্দীর শেষে এসে কানাডায় অর্ধেকেরও বেশির বসবাস অন্য সব দেশের নাগরিকের, শুধু সেই তিনটি বিশেষ দেশ বা মহাদেশ ছাড়া।

এমন সব যুগান্তকারী পরিবর্তনের ফল দাঁড়িয়েছে এই, শতাব্দী শেষের কানাডা একশো বছর আগে শতাব্দীর শুরুর কানাডার একেবারে বিপরীত। অভিবাসীরা কানাডার জনসংখ্যা বাড়িয়েছে, এই ভূখণ্ডের জাতিকাঠামোয় আর ভাষায় এনে দিয়েছে বৈচিত্র্য। শ্রমের যোগান দিয়েছে পুরনো আমলের কৃষি অর্থনীতিতে আবার সময়ের রদবদলে ভবিষ্যতের নিত্যনতুন শিল্প আর সেবা অর্থনীতিতে।

মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো