মনীষ পাল : “আমি প্রার্থীর স্টাডি পারমিট এর আবেদন পর্যালোচনা করেছি। আমি সন্তুষ্ট নই, যে, তিনি অস্থায়ী অভিবাসী হিসেবে তার ভিসার মেয়াদ শেষে কানাডা ছেড়ে যাবেন। আমি খতিয়ে দেখেছি – প্রার্থী একা, নিজদেশে অস্থায়ী, ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত নয় এবং তার কোনো পোষ্য নেই। তিনি নিজের দেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেছেন, বর্তমানে ইরানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং পুনঃসংস্কার সংস্থায় প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত। প্রার্থী পরবর্তীতে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে চিঠি লিখেছেন, সেটিও পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বিষয়ে পড়াশোনা তার চাকুরীর কাজে কি উপকারে লাগবে, সেই চিঠিতে তিনি কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। তিনি যে সব নথি জমা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, বর্তমান কাজের জন্য সমন্বিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা সবই তার রয়েছে আর তাই তার পেশা উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো পড়াশোনার প্রয়োজন পড়ে না। এতে সন্দেহ হয়, কানাডায় তার পড়াশোনার যে প্রেরণা, সেটির পেছনে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো কারণ রয়েছে। আমি আরো পর্যবেক্ষণ করি, প্রস্তাবিত কোর্সে একটা জায়গা ধরে রাখবার জন্যে ন্যূনতম একটা টিউশন ফি জমা দেয়া হয়েছে মাত্র। আর কোনো অতিরিক্ত পয়সা জমা দেবার কোনো প্রমাণ নথিতে পাওয়া যায়নি। আবেদনের সমস্ত কার্যকারণ বিবেচনা করে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না, যে, প্রার্থী অনুমোদিত সময়ের পর কানাডা ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছুক হবেন । এসব কারণে আমি তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করছি।’”
উপরের অনুচ্ছেদটি গ্লোবাল কেস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এর নথির অংশবিশেষ। এই সিস্টেমে ভিসা অফিসার কোন কারণে ভিসা প্রত্যাখ্যান করে, তার নোট দেবার বিধান রয়েছে।
গত বছরের জানুয়ারির নয় তারিখে ইরানের এই প্রার্থীর ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়। আবেদনকারী ভিসা অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে এবার বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার আবেদন করেন।
এতোক্ষণ যার কথা বলছি, তার নাম মাহিয়ার হাজি তেহরানি, ইরানের বাসিন্দা। তিনি টরন্টোর নর্থ ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বা প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ তার আবেদন গ্রহণ করলে তিনি ভর্তির অনুমতি পেয়ে যান। তারপর পড়াশোনা উপলক্ষে কানাডায় প্রবেশের জন্যে তিনি অভিবাসন কতৃপক্ষের কাছে স্টাডি পারমিট এর আবেদন করেন।
আবেদনকারী আদালতকে বলেন, তার একক বৈবাহিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে ভিসা অফিসার অনুমান করেন, দেশে তার স্থায়িত্ব নেই এবং তিনি দেশে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। তেহরানির মতে, ভিসা অফিসের অনুমাননির্ভর সিদ্ধান্ত এই ক্ষেত্রে ভুল কেননা তার দেয়া নথিপত্র এর বিপরীত চিত্র প্রমাণ করে।
প্রার্থী আদালতকে আরো বলেন, ভিসা অফিসার ধরেই নিয়েছেন, দেশে তার ইতোমধ্যে সমন্বিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে আর তাই তার কানাডায় উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই। অথচ প্রার্থী তার উচ্চ শিক্ষা পরিকল্পনা বা স্টাডি প্ল্যানে পরিষ্কারভাবে দেখান, দেশে তার শিক্ষা ছিল প্রকৌশল বিষয়ে এবং তিনি তার পেশাগত উন্নয়নের জন্য কানাডায় আসতে চান প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বা প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের আশায়। তিনি এ ও জানান, বাইরের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় উচ্চতর ডিগ্রী নেবার জন্যে তার কর্মস্থল থেকে তাকে সুপারিশ করা হয়।
প্রার্থী অফিসারের আরেকটি বক্তব্যের সাথেও দ্বিমত পোষণ করেন। সেই বক্তব্যে বলা হয়, প্রার্থী প্রস্তাবিত শিক্ষা কার্যক্রমে তার স্থান ধরে রাখবার জন্য টিউশন ফি এর অংশমাত্র পরিশোধ করেন এবং ফি এর বাকি অংশ পরিশোধের কোনো প্রমাণ ফাইলে পাওয়া যায়নি। প্রার্থী আদালতকে বলেন, এটি আসলে কোনো যুক্তি হতে পারে না কেননা এই বিষয়টি অফিসারের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।
প্রার্থী তার স্টাডি প্ল্যানে ইঙ্গিত করেছেন, তিনি তার মায়ের একমাত্র সন্তান এবং মায়ের সাথে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ। মা থাকেন ইরানে আর মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে মায়ের দেখভালের দায়িত্ব একমাত্র তার উপরই বর্তায়। তাই কানাডায় উচ্চতর শিক্ষা শেষে তিনি দেশে ছেড়ে আসা পরিবারের একমাত্র সদস্য মায়ের কাছে ফিরে যাবেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০১৭ সাল থেকে তিনি ইরানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড রেনোভেশন সংস্থার সাথে কর্মরত। কানাডায় তার উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট শাখায় অধিকতর জ্ঞান অর্জন করা যাতে দেশে ফিরে গিয়ে সেই অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেন। তাছাড়া তার কর্মস্থল থেকেও তাকে উচ্চ শিক্ষার সুবিধার্থে বিনা বেতনে ছুটি মনজুর করা হয় এবং এটি ও নিশ্চিত করা হয়, শিক্ষা শেষে দেশে ফিরলে তাকে পদোন্নতি দেয়া হবে যেটার অনুলিপি তিনি তার স্টাডি পারমিট এর আবেদনের সাথেও সংযুক্ত করেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ভবিষ্যতে তার নিজের কোম্পানি খুলবারও পরিকল্পনা রয়েছে। তা ছাড়া, দেশে তার নিজের বাড়ি, গাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদের মালিকানারও তালিকা আবেদনের সাথে যুক্ত করেন। এসব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি প্রার্থীর নিজ দেশের সাথে তার দীর্ঘদিনের যোগসূত্রের সাক্ষ্য বহন করে। সেইসাথে নিজ দেশে প্রাথী যে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত, সেটি ও প্রমাণ হয়। কিন্তু ভিসা অফিসার তার সিদ্ধান্তে এসব সাক্ষ্য প্রমাণাদির কোনো উল্লেখমাত্র করেননি।
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, প্রাথীর টিউশন ফি সংক্রান্ত বিষয়ে ভিসা অফিসারের মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা বোধগম্য নয়। ভিসা অফিসার মন্তব্যে লিখেন, প্রাথী ন্যূনতম ফি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কার্যক্রম সারেন, কোনোভাবে প্রস্তাবিত প্রোগ্রামে একটা স্থান ধরে রাখবার জন্য অল্প ফি মাত্র জমা দেন, অতিরিক্ত ফি দেবার কোনো প্রমাণ নথিতে নেই। আদালত বলেন, এক্ষেত্রে ভিসা অফিসারের মন্তব্য অন্য বিষয়ের মন্তব্যের সাথে সাযুজ্য নয় কেননা ন্যূনতম ফি এর সাথে প্রার্থীর অনুমোদিত সময়ের মধ্যে কানাডা ছেড়ে চলে যাবার আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, সেটি ভিসা অফিসার ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রার্থী তার উপস্থাপনে বলেন, একজন ছাত্র সঙ্গত কারণেই প্রয়োজনের বেশি টিউশন ফি দিতে কখনোই রাজি হবে না, স্টাডি পারমিট এর অনুমোদন যখন এখনো সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়, বিশেষ করে, কোনো কারণে স্টাডি পারমিট অনুমোদন না হলে টিউশন ফি যখন ফেরত পাবার নিশ্চয়তা থাকে না। আদালত এই বিষয়টিতে প্রার্থীর উপস্থাপনের সাথে সহমত পোষণ করেন।
অভিবাসন আইনে শুধু এটুকু বলা আছে , প্রার্থীকে দেখাতে হবে, যে, সরকারের অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথীর ভর্তি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ভাবে সম্পন্ন হয়েছে, সম্পূর্ণ বা আংশিক টিউশন ফি পরিশোধের কোনো প্রমাণের কথা অভিবাসনের কোনো প্রবিধানে উল্লেখ করা নেই। যদিও বলা হয়েছে, প্রার্থীর টিউশন ফি থেকে শুরু করে নিজের এবং পরিবাবের (যদি থাকে) যাবতীয় খরচ মেটানোর পর্যাপ্ত তহবিল ছাড়া ভিসা প্রদান করা যাবে না। আদালত বলেন, তার মানে এই নয় যে, সম্পূর্ণ বা আংশিক টিউশন ফি মিটিয়ে দেবার প্রমাণ দরকার – পরিবর্তে শুধু দরকার পর্যাপ্ত তহবিলের আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ। প্রার্থী যেমন তার উপস্থাপনে ইঙ্গিত করেন, প্রার্থীর কানাডায় শিক্ষা এবং অন্যান্য বিষয়ের খরচ মেটাতে অর্থ সামর্থ্যের বিষয়টি নিয়ে অফিসার এর কিছুই বলার থাকেনি। তাই এই বিষয়টিতে অফিসার এর মন্তব্য আদালতের কাছে একেবারেই পরিষ্কার নয়।
আদালত রায় দিতে গিয়ে বলেন, সমস্ত কার্যকারণ বিবেচনা করে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়, অফিসার এর সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক কেননা এই সিদ্ধান্তে কোনো ন্যায্যতা নেই, তাছাড়া এই সিদ্ধান্ত অস্পষ্ট এবং এটি প্রার্থীর দেয়া সাক্ষ্য প্রমাণাদি আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই প্রার্থীর পক্ষে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার অনুমোদন দেয়া হয় এবং ভিসা অফিসার এর সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিয়ে পুনঃনিরীক্ষার জন্য আরেকজন অফিসার এর কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো