মনীষ পাল : ১৯৪৫ এর ৬ই মে। মিত্র বাহিনীর কাছে জার্মানীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। ১৯৪৫-এর ৭ই মে। যুদ্ধে সামরিক পরাজয় মেনে নিয়ে জার্মানি এদিন আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে বাধ্য হয়। পরদিন ৮ই মে সারা পৃথিবী বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে, ইউরোপে শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের দ্বিতীয় ভয়াবহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি রচিত হয়। প্রশান্ত মহাসাগর বলয়ে জাপান আত্মসমর্পণ করে ১৪ই আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে স্বভাবতই এবার পৃথিবীতে নেমে আসে শান্তির সুবাতাস আর সেই সুযোগে কানাডার অর্থনীতি আর অভিবাসন দুটোই জোরালো হতে শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায় এই দশকের শেষ চার বছরে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ লোক কানাডায় অভিবাসী হয়, যা আগের পনেরো বছরের সমস্ত অভিবাসনকে হার মানিয়ে দেয়। আর নাই বা হবে কেনো, যুদ্ধ ফেরত সৈনিকেরা তাদের সাথে নিয়ে আসে ভিনদেশী বধূ, সেই সাথে আসতে থাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে বাস্তুচ্যুত শরণার্থী, আসে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে নতুন পৃথিবীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া অগুনতি মানুষ। অভিবাসন আইন-এর পরিবর্তনে কালক্ষেপন হবে, তাই অপেক্ষা না করে সরকার অধ্যাদেশ জারি করেই কানাডায় প্রবেশের দরোজা উন্মুক্ত করে দেয় বসত খুঁজে ফেরা মানুষদের জন্যে, ফেলে আসা ভিটেয় যাদের আর ফেরার উপায় নেই।

একদিকে ইউরোপের অর্থনীতির পতন, অন্যদিকে কানাডার অভূতপূর্ব উন্নয়নযাত্রা সেই সময়কার জোরালো অভিবাসনের অনুক‚ল পরিবেশ তৈরী করে দেয়। পঞ্চাশের দশকের প্রায় পুরোটাই তেমনটি থাকে যদিও শেষ দুবছরে এসে অভিবাসনে দেখা দেয় স্থবির সময়। ততদিনে পৃথিবীজুড়ে অর্থনীতির মানচিত্র আবার বদলে যায় – ইউরোপের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আর অন্যদিকে কানাডার অর্থনীতিতে নেমে আসে প্রতিকুল সময়। সরকার প্রশাসনিক আদেশে অভিবাসনে লাগাম টেনে ধরে।

খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, ভাগ্যদেবী আবারো মুখ তুলে তাকান। ষাটের দশকে অর্থনীতির চিত্র আবার বদলে যায়। কানাডার অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে, সেই সাথে বাড়তে থাকে অভিবাসন, টানা ছয় বছর এরকম চলতে থাকে। বিশ শতকের শুরুর সেই উচ্চ হারের অভিবাসন যদিও ফিরে আসেনি, কিন্তু পঞ্চাশ আর ষাটের দশকের অভিবাসন আগের তিন দশকের অভিবাসনকে অতিক্রম করে যায়।

চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধিতে নীরবে উত্তর আমেরিকায় ঘটে যায় আরেক পালাবদল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের এই সময়টিতে কানাডায় শিশু জন্মের হার সবচেয়ে বেশি। কানাডার জনমিতিতে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। উচ্চ হারের অভিবাসন সত্বেও অভিবাসীরা সেসময় জনসংখ্যায় কার্যকর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে এই সময়ে নতুন অভিবাসীদের মধ্যে ওন্টারিওতে বসবাসের প্রবণতা বেড়ে যায়।

কানাডার অর্থনীতির রূপান্তর এ প্রবণতার অন্যতম অনুঘটক, দেশটির কৃষি। প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে বিশ শতকের শুরুতে যে অর্থনীতির উত্থান, পরিবর্তনের ধারায় সেটি ক্রমে রূপান্তরিত হয় উত্পাদনমুখী কারখানা। সেবা খাতে। যুদ্ধপরবর্তী অভিবাসীরা ছিল এই নতুন অর্থনীতির মূল শ্রম। তাদের অধিকাংশই ছিলো পেশাজীবী বা দক্ষ শ্রমিক; যদিও যুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য থেকে আসা অভিবাসীরা ছিলো সংখ্যায় বেশি, কিন্তু ক্রমান্বয়ে জার্মানী, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, পোল্যান্ড এবং সেই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও পর্যাপ্ত সংখ্যায় অভিবাসীরা আসতে শুরু করে।

চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত অনুপ্রবেশ, কানাডা তখন বারো হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়
সৌজন্যে : কানাডিয়ান মিউজিয়াম অফ ইমিগ্রেশন

অভিবাসনের সমীকরণে এই সময় আরো দুটো নাজুক বিষয় সামনে চলে আসে। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে রাজনীতিতে দেখা দেয় উত্তাপ, সংঘাত সংঘর্ষ হয়ে ওঠে অনিবার্য। প্রথমটি সুয়েজ খাল সংকট নামে পরিচিত; মিশর একতরফা সুয়েজ খাল জাতীয়করণের ঘোষণা দিতে গেলে তাকে রুখে দিতে মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স আর ইসরাইল। এ সংঘাতের পরিণতিতে ব্রিটেন থেকে এক লক্ষেরও বেশি নাগরিক কানাডায় চলে আসে। দ্বিতীয় সংকট দেখা দেয় ১৯৫৬ সালে নভেম্বরে হাঙ্গেরীতে। সোভিয়েত অনুপ্রবেশের বিরোধিতায় হাঙ্গেরীতে তুমুল জনবিদ্রোহ দেখা দেয়। জনগণের স্বতস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে হাঙ্গেরী স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটা মেনে নিতে পারেনি, শুরু করে কঠোর দমন পীড়ন। সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে বাঁচতে দুলক্ষেরও বেশি লোক তখন পার্শ্ববর্তী অস্ট্রিয়াতে পালিয়ে যায়। তারপর টানা ছয় মাস ধরে ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কানাডা অভিবাসিত করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া হাঙ্গেরীয় শরণার্থীদের। শরণার্থীরা যে যেভাবে পারে, কেউ বা নৌজাহাজে, আবার কেউ বা বিমানে কানাডার সীমান্তে ঢুকে পড়ে। কিন্তু ১৯৫৭ সালে কানাডা একেবারে ভিন্নধরনের একটি উদ্যোগ নেয় – এবার কানাডার সরকার প্রায় সাড়ে তিনশো উড়োজাহাজ ভাড়া করে শরণার্থীদের নিজ দেশ থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসে। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজার লোক সেই সময় কানাডায় চলে আসে।
যুদ্ধপরবর্তী কানাডায় অভিবাসনে অনেক সিদ্ধান্তের মূলে ছিল যুদ্ধ বা রাজনৈতিক সংঘাতে বাস্তুচ্যুত মানুষ, সেই সাথে ইউরোপীয় অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। তারপরও অভিবাসীর সংখ্যা, জন্মস্থল বা ধরণ নির্ধারণে কানাডার স্বকীয় অভিবাসন নীতির একটা ভূমিকা আছে। ১৯৪৭ সালে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ম্যাকেঞ্জি কিং জোর দিয়ে বলেন, কানাডার অগ্রগতিতে অভিবাসনের গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু ইঙ্গিত করেন, অভিবাসীর সংখ্যা এবং তাদের উত্স নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তার ঠিক পাঁচ বছর পর যুদ্ধপরবর্তী যাবতীয় পরিবর্তন সংযোজিত করে ১৯৫২ সালে সংশোধিত নতুন অভিবাসন আইন প্রণীত হয়। আইনের পরবর্তী প্রবিধানগুলোতে অভিবাসীদের প্রবেশ সীমিত রাখবার জন্যে সম্ভাব্য অভিবাসীদের উত্স দেশ বা জন্মস্থানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় – সেই ভিত্তিতে অনুমতিপ্রাপ্ত দেশগুলোর তালিকায় স্থান পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নির্বাচিত কিছু ইউরোপীয় দেশ।

দশ বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে এই উত্সদেশের প্রবিধান তুলে দেয়া হয়। তারপর ১৯৬৭ সালের পরিমার্জিত আইনে উপযুক্ততা বাছাইয়ে বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ভাষাগত দক্ষতা এবং আর্থিক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করে নতুন নিয়ম চালু করা হয়। অভিবাসীদের জন্মস্থান নিয়ে বাধ্যবাধকতা বাতিল হওয়ার কারণে নতুন নিয়মে আমেরিকা বা ইউরোপের বাইরের অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসন সহজ হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের প্রবিধানে মূল আবেদনকারীর সাথে পরিবারের অভিবাসনকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। পরিবারভিত্তিক অভিবাসন অর্থনৈতিক অভিবাসনের পাশাপাশি বরাবরই সহাবস্থান করে আসছে কিন্তু এই প্রথম আইনে এটাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। পারিবারিক অভিবাসনে নারীরা কখনো বধূ, কখনো বা মা, কখনো বা বোন হিসেবে সবসময়ই অংশ নিয়ে এসেছে, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে প্রাপ্তবয়স্ক অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেক নারী আর তারই ফলশ্রতিতে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সময়ের সাথে সাথে লিঙ্গের অসমতা কিছুটা হলেও দূরীভূত হয়।

১৯৪৫-এর যুদ্ধ শেষে ইউরোপে এক কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। তবুও সে বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ অধিকাংশই স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। তারপরও বাকী প্রায় বারো লক্ষের মতো জার্মানীতে রয়ে যায় এবং তারা ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের এই ঘরে ফেরার অস্বীকৃতির মূলে আছে অনেকগুলো কারণ; রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ তো রয়েছেই, তাছাড়া মনস্তাত্তি¡ক কিছু ব্যাপার তাদেরকে ঘরে ফিরতে নিরুত্সাহিত করে। পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত বলয়ের বিস্তার-এর আশঙ্কা, সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধা আর ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি আকাঙ্খা ইত্যাকার কারণে তারা বেঁকে বসে। অনেকের ভয়, জার্মান নাত্সীদের সাথে সহযোগিতার অজুহাতে হয়তো চরম শাস্তিও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ১৯৫১ সাল নাগাদ তাদেরকে আশ্রয় দেয়া হয় অন্যান্য দেশে। তাদের এই ঘরে ফিরতে অস্বীকৃতি এই প্রথম শরণার্থীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক বিতর্কের জন্ম দেয়। পৃথিবীজুড়ে শরণার্থীদের সুরক্ষা দেবার যে অগ্রগতি আজকে দেখতে পাই, তার দানা বাধে বহুল পরিচিত এই ‘লাস্ট মিলিয়ন’ থেকে। সে বছরই শরণার্থী বিষয়ে আলোচনার সূচনা হয় জেনেভায়। জাতিসংঘের আয়োজনে এই সম্মেলনে কানাডা অংশ নেয় কিন্তু শরণার্থী বিষয়ক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে কানাডার লেগে যায় আরো আঠারো বছর। ১৯৬৯-এর আগে কানাডা এই চুক্তিতে কার্যকরভাবে অংশ নেয়নি।
মনীষ পাল – লেখক ও অভিবাসন উপদেষ্টা, টরন্টো

পরবর্তী সংখ্যায় : অভিবাসনে প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্র্য