আতোয়ার রহমান : রুনাকে প্রথম দেখেছিলাম ফার্স্ট ইয়ারেই, বাংলা ক্লাশে। আগাগোড়া মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়া রুনা পারতপক্ষে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলত না। বয়েজ স্কুলে পড়ার মেঠো অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা আমিও তেমনি মেয়েদের সামনে সহজ হতে পারতাম না। যদিও যে কোনও মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া একটি উষ্ণ হাসি যেন আমার জন্য সকাল বেলার শুভেচ্ছা স্বরুপ, যা আমাকে আশাবাদী করে তুলতো। ক্লাশে কাছাকাছি বসায় আমাদের মধ্যে চোখাছোখি হয়েছিল, কথা হয়েছিল আরও পরে। ব্যাচের মধ্যে আমার সঙ্গেই সম্ভবত তার প্রথম আলাপ। প্রথম দিন সে আমাকে ‘আপনি’ বলে কথা বলেছিল, “আপনার খাতাটা এক দিনের জন্যে দেবেন?” নিরঞ্জন হেসে উঠেছিল, বলেছিল, “এক সপ্তাহের মধ্যে তুইতোকারি চালু হবে।” খোলা চুলে বেগুনি সালোয়ার কামিজ পড়া রুনাকে মনে হচ্ছিলো সত্যিই কোন নিঝুমপুরির মায়াকন্যা। আমার মন গলে গিয়েছিলো সেই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের আলোতে।
না, অত নিখুঁত অবিশ্যি মেলেনি নিরঞ্জনের কথা। এক সপ্তাহ নয়, ঠিক দু’মাস পরে- রুনা নিজের তীব্র তাপ আমার কোষে-কোষে ছড়িয়ে দিতে-দিতে প্রথম আমাকে অস্ফুটে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করে।
সামনের সারিতে জানালার কাছে বসে থাকা সেই এক ঝলকানো সৌন্দর্যে আমার মনোযোগ চুরি হওয়ায় পড়ার প্রতি মনোযোগ ছিল না। কারমাইকেল কলেজের সুদৃশ্য ক্যাম্পাস, সবুজ গাছগাছালি, মিছিল, ক্যান্টিনের আড্ডা, মাঠের ফুটবল খেলা, অপু-হৈমন্তির গল্প এবং ড্যাফোডিল কবিতা কোনকিছুই আমাকে টানতো না।
আস্তে আস্তে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেল। এখনও ইংরেজির ক্লাসে স্যারের সুচনা কথাগুলো মনে করতে পারি। “গুড মর্নিং ক্লাস, আজ আমরা ও হেনরির গিফট অব দ্য ম্যাজাই গল্পের মধ্য দিয়ে জিম এবং ডেলার মধ্যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অন্বেষণ করতে যাচ্ছি।” নাটকীয় ভঙ্গিতে দেওয়া শিক্ষকের আলোচনায় কবিতাটির গল্পসুত্র শোনার সাথে সাথে আমি নিজেকে জিম এবং রুনাকে আমার ডেলা বলে মনে করলাম।
রুনা কেবল একজন কলেজছাত্রীর চেয়ে বেশিই ছিল না, সে কিছুটা অত্যাধুনিক, বিচক্ষণ, এক বিকাশমান নারী ছিল। তার টানাটানা বাদামি চোখ, হাসলে টোল পড়া গাল, নরম ত্বক এবং কাজল কালো লম্বা চুলগুলির জন্য তাকে অনেক মিষ্টি এবং শান্ত কমনীয় লাগতো। তাকে অনেক করে কাছে পেতে ইচ্ছে করতো, হাতে হাত ধরে হাঁটতে, তার সাথে সময় কাটাতে মন চাইতো। কিন্তু কখনই তা হয়ে ওঠেনি। সকাল বেলা যখন সাদা সালোয়ার কামিজ পরে মেয়দের কমনরুমের সামনে রিকশা থেকে নেমে ওড়না দিয়ে চোখ মুছতো, দূরে দাঁড়িয়ে চোরা চাহনিতে ওর দিকে তাকাতাম, যেমন করে পকেটমার সন্দেহে সাবধানী চোখে কেউ কারও দিকে তাকায়, ঠিক সেভাবে।
পাক্কা এক বছর বাদে, গোলাপি ডানায় তরতরিয়ে ভেসে-যাওয়া বারোটি মাস কেটে যাওয়ার পর- একদিন বুঝতে পারলাম রুনা আমাকে এড়িয়ে চলছে কিছু কাল, এর বেশি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল, মনের মধ্যে রেখে গিয়েছিল একটা অমোচনীয় ছাপ। সেভাবেই। যে মুহূর্তে আমি তাকে দেখি, আমার বুক অসাড় হয়ে পড়ে।
কলেজের কলা বা বিজ্ঞান ভবনের করিডোরে, এক ভবন থেকে আর এক ভবনে যাওয়ার মাঠচেরা হাঁটা পথে, শহিদ মিনারে, শহরের বিপনি বিতানে বা কলেজ রোডের হুড তোলা রিক্সায় চোখাচোখি হলে, আমার বুক ধড়ফড় করে, মুখটি মরুভূমির মতো শুকিয়ে যায়, গলায় কথা আটকে আসে। তাই কথাবার্তা তেমন হয় না, হলেও তা বেশি দূর গড়ায় না। পড়াশোনার মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। উভয়ে কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে থাকি। ক্লাসে চুপচাপ থাকা গম্ভীর মেয়েটি হঠাৎ পাশের ছেলেটিকে মিষ্টি হেসে হঠাৎ কোনো একটি প্রশ্ন করে বসত, তখন আমার হিংসে হতো, বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ টের পেতাম। ‘সুরঞ্জনা কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে’- এ পংক্তি বড় সত্য মনে হয় আমার কাছে। অন্য কারো সঙ্গে সহাস্য হাঁটতে দেখে ভেতরে ভেতরে খানিক জ্বলেপুড়ে যেতাম।
আমি ভয়গুলির টুটি চেপে ধরতে পারিনি, সাহস সঞ্চয় করে রুনার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” প্রাণের আবেগ, প্রাণের বাসনা রুদ্ধ রেখে নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি, ঝেড়ে কেশে শুদ্ধ হতে পারিনি। নিজেকে মেলে ধরতে পারিনি ময়ুরের পেখমের মতো। মনের কথাগুলো খুলে বলার মতো বয়স হলেও সে সাহস হয়নি। তাই নিজের মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখি আমার ভালোবাসা।
কাউকে না বলে গোপন কষ্টগুলো বয়ে বেড়ানোও খুবই কষ্টের। কাছের বন্ধু নিরঞ্জনের সাথে রুনার জন্য বুকে চেপে রাখা পাথর কুচির মতো আমার আবেগ অনুভূতিগুলি শেয়ার করেছি। আমি জানি, অনেক সময় একটি সম্পর্ক গড়ে উঠার আগেই অন্য একজন মানুষকে পেটের সব বেফাঁস কথা বেমালুম বলে ফেলা ঠিক নয়। সেই মানুষটি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষতিও করতে পারে। কিন্তু নিরঞ্জন ছিল আমার এমন একজন বন্ধু যার কাছে মনের গোপণ কথা বলা যায় এবং সে অন্যদের মতো খোলস পাল্টে আমার গোপনীয়তা ফাঁস করবে না, হাসিঠাট্টা, টোন-টিটকিরি করবে না।
“আমি মনে হয় রুনার প্রেমে পড়ে গেছি। কোনও কিছুতে মনোযোগ দিতে পারি না, ওর কথা ভেবে ভেবে আমার পুরো দিন মাটি করি। ও এক দিন কলেজ কামাই করলে আমার সারাটা দিন মেঘলা হয়ে থাকে, ওর জন্যে মন কেমন করে। আমার মনের গহীনে শুধুই রুনা, আর কেঁউ নেই সেখানে,” নিরঞ্জনকে বলে আমার মনটাকে হালকা করতে চাইলাম।
“তুই কি পাগল হয়েছিস? তুই কীভাবে রুনার প্রেমে পড়িস? রুনা কি কখনো তোকে ভালোবাসার কথা বলেছে, চিঠি লেখাতো দুরের কথা।”
“হ্যাঁ, ঐ সেদিনই তো বাংলা ক্লাসে ও আড়চোখে তাকিয়েছে আমার দিকে, হাসি সমেত, সংকেতবাহী হাসি। দেখেই ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুক, সাহস করে একটা চিরকুটে হাবিজাবি লিখে দিতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে থমকে গেছি। প্রতি দিনই ভাবি ওকে প্রেমের কথা বলব, কিন্তু বলার সময় বুকটা কেমন যেন করে, একটা অদ্ভুত শ্বাসকষ্ট হয়। থেমে যাই। ভেতরে ভেতরে পুষে রাখা ভয়, ‘যদি বলে প্রেম-ট্রেম করতে পারবনা, তোমাকে আমার পছন্দ হয়না, বাবার কড়া নজরদারি আছে, ইত্যাদি।”
“এই বোকা, প্রেমের পোকা মাথা থেকে বের কর। ক্লাসের অন্যদের চিন্তা যখন পড়াশোনো করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, তখন তুই এসব কী ভালোবাসা মন্দবাসায় জড়িয়ে পড়ছিস। রুনা আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী ও স্মার্ট মেয়ে, কলেজের ফাংশনে গান গায়, নাটক করে। ইন্টার কলেজ কম্পিটিশনে রবীন্দ্র সংগীতে ফার্স্ট হয়েছে। ওর বাবা ব্যাংকের ম্যানেজার, মা স্কুল টিচার। ওর মতো একটা শহুরে মেয়ে কোন দুঃখে তোর মতো একটা গাঁইয়া পুঁটিকে পাত্তা দিবে, আমাকে বল। তোর কল্পনাগুলি বোকার কল্পনা। আমি যদি তোকে খুব ভালভাবে না জানতাম তবে বলতাম যে তুই ভাটিখানার ভবঘুরে ছেলেদের সাথে নেশা-ভাং করেছিস।”
“আমি কোনও নেশা করিনি, ওসব থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকি। আমি ওর সবুজ চোখ এবং চকচকে, গোলাপী রঙের ঠোঁটে ডুবে গেছি, ওর উজ্জ্বল হাসিতে চমকে উঠি।”
“এই হতচ্ছাড়া শোন, এই সবুজ চোখগুলি বিপদের কারণ এবং তার এই স্যাকারিন হাসি থেকে সাবধান। জেদী টাইপের মানুষ এভাবে হাসে। রুনা নাকউঁচু, জেদি প্রকৃতির মেয়ে। তুই ওর বন্ধুবলয়ে নেই, তুই ওর বন্ধুবৃত্তের বাইরের সীমাতে আছিস। ও যদি লালবাগ হাটের একটা বেকারির মতো হয় তবে তুই খরিদ্দারদের লাইনের সর্বশেষে ব্যক্তি।”
“তোর উচিৎ এমন কারও ওপর মনোযোগ দেওয়া যে তোকে সুযোগ দেবে।”
“ওহ, মোটা নীলার মতো?”
“নীলা তেমন মেদযুক্ত নয়, কেবল অন্য মেয়েদের মতো ছিপছিপে নয় এই যা। ওর চেহারা খুব সুন্দর এবং আমি শুনেছি ও সহজ এবং খোলামেলা মনের। এরকম মেয়েদের পটানো তোর জন্য সহজ হবে।”
“তুই যে যাই বল, আমি রুনাকে চাই।”
নিরঞ্জন আমার হৃদয় বেদনার দগদগে ঘায়ে নরম প্রলেপ দিবে কি, তাতে যেন শিরিষ কাগজ ঘষে দিল।
লুকোছাপার দিন ফুরোল। কলেজের পাট চুকল। দেখতে দেখতে দুটো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল। বন্ধুবান্ধবরা অনেকটা ক্যারামের জমাট বাঁধা ঘুঁটির এদিকওদিক ছিটকে যাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়লাম। ক্যান্টিনের সামনে ধুমায়িত চা খেতে খেতে আগের সেই মন খুশি করা আড্ডাটা আর জমে না। দুর্বার সবুজ ক্যাম্পাস ছেড়ে কে কোথায় হারিয়ে গেলাম। আমার সুপ্ত প্রেম সুপ্তই রয়ে গেল। যে কথাটি বলবার জন্য আমার অন্তরাত্মা আকুলি-বিকুলি করছিল এতদিন, তা আমি কিছুতেই বলতে পারলাম না। শুধু এক আশ্চর্য অন্তর্যামী আমার প্রেমের ভেলার সলিল সমাধি ঘটিয়ে দিল। রুনা চলে যাওয়াতে আমার চারপাশটা বিষন্নতায় ভরে গেল। তখন তো আর মোবাইল টোবাইলের জন্ম হয়নি যে কারো সঙ্গে চটজলদি যোগাযোগ করা যাবে।
সবসময় ওর স্বপ্ন দেখতাম। পরবর্তীতে আমি আমার লক্ষ্য অর্জনের লড়াইয়ে ব্যতিবস্ত থাকলেও রুনার জন্য আমার মনের মধ্যে যে টান, ছটফটানি তা মুছে যায়নি। বুনো হরিনীর মতো ও একসময় আমার দৃষ্টির সীমা থেকে হারিয়ে গেলেও মনের ফ্রেমে ল্যামিনিটেড করা ছিল ওর ছবি।
সময়ের নদী বয়ে চলে। মাঝখানে কেটে গেছে কুড়িটা বছর। তত দিনে তিস্তা-ঘাঘটে প্রচুর পানি গড়িয়েছে। গৌড়ভুমির ওপর দিয়ে হিমালয় পর্বতমালার হিমশীতল বাতাসও বয়ে গেছে প্রচুর। আমাদের জীবনের নদীতেও ভাটিতে চলে গিয়েছে অনেক পানি। পানির সাথে চলে গিয়েছে অনেক আশাহত গল্পের চরিত্র! চার পাশের পরিবেশ আগের মতো নেই। আমরা দুজন মুখোমুখি হলাম। আমাদের কলেজ রিইউনিয়নে। কলেজের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে। ঘরে বেশ ভিড়, বাতাসে খুব উষ্ণতার, উৎসবের আমেজ। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুবান্ধবদের খুঁজে পাওয়া, পরম বন্ধুতায় কথা বলা। বহু বছর আমাদের দেখা নেই, যোগাযোগ নেই। অথচ একটা সময়ে আমরা দলবেঁধে নির্মল আড্ডা দিয়েছি, একে অপরের জন্য পাগল থেকেছি। কত দিন পর বন্ধুদের সাথে আন্তরিক ভাবে আলিঙ্গন, হ্যান্ডশেক! স্মৃতির সরণী বেয়ে পুরনো দিনগুলিতে ফিরে যাওয়া। স্মার্ট ফোনে ছবি আর ছবি।
সকালের নরম রোদ ক্ষয়ে বাদামি আভা ছড়াচ্ছে চারদিকে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় পুস্প বৃষ্টি চলছে যেন মায়াজড়ানো মাঠে। পাখি ডাকছে। আশপাশের গাছগাছালির ঝরা পাতা এসে ঢেকে দিয়েছিল রাস্তা, তারা উড়ছিলও,না জানা গন্তব্যের দিকে। বড় বড় পাইন,দেবদারু গাছের শুকনো ঝরা পাতা ও ঝরে পড়া শুকনো ফুল পায়ে মাড়িয়ে যেতে মচমচ শব্দ করছে আর আমি পাঞ্জাবির কলারটা টেনে উপরে তুলছি। কৈশোরের দিনগুলো যেন শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়তে শুরু করে আমাদের ওপর। আমাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাস। আমরা কৈশোরের স্বপ্নে ঢূকে পড়ি…ভিড় ঠেলে রুনার কাছে গিয়ে বললাম- “রুনা, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো? তুমি এখানে আসবা চিন্তায় হয়নি। তুমি আসায় আমার কিযে আনন্দ লাগছে।”
এক পশলা দমকা হাওয়ার দোলায় উড়িয়ে নিচ্ছে তার লালপাড় সাদা সুতির শাড়ি, আধা-পাকা এলোচুল এসে উড়িয়ে নিচ্ছে তার কাপড়। শুধু বুকের কাছে হাত দিয়ে আঁচল চেপে ধরেছে। রুনার কাচাপাকা চুল যেন কলেজের বø্যাকবোর্ডের ওপর চক দিয়ে লিখে জানান দিচ্ছে আমাদের মাঝে প্রায় কুড়ি বছর অতিক্রান্ত। আমার মাথা ভর্তি টাক থাকায় বুঝলাম না আমার চুলেও পাক ধরেছে।
রুনা হেসে বলল “চিনতে পারব না কেন? তুমি সেই শান্ত ছেলেটি, রোলকলের সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে। প্রায়ই জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে। ও হ্যাঁ, তুমি কী এখনো আবৃত্তি কর? রেগে গেলে তোতলাও?”
তারপর দুজনেই খানিক চুপ থাকলাম, মনে হয়!
স্মৃতি হাতড়ে কুড়ি বছর পিছনে ফিরে যায় রুনা। প্রাণপনে চেষ্টা করছে রুনা তার স্মৃতি থেকে সময়ের আস্তরণ মুছে ফেলে অতীতকে উদ্ধার করার।
কত স্মৃতি বুদ বুদ করে ওঠে মনের আলপথে। মনে আমার ফিরে এল কুড়ি বছর আগের উত্তাপ। দুজন মুখোমুখি… দুজনে অনেকক্ষণ বসে গল্প করি। কলেজ জীবনের সুখের স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করি দুজনে। অনেক আবেগ, মান অভিমানগুলো সব দলা পাকিয়ে গলার মধ্যে আটকে গেল।
রুনার ঠোঁট দুটো কাঁপছিল, চোখ নামিয়ে নিল!
কপাল থেকে চুল সরিয়ে আমি বললাম “রুনা এখনও তুমি দুর্দান্ত দেখতে।”
“আমার মনে হয় তোমার চোখে ছানি পড়েছে, তোমার চশমা দরকার। ভালভাবে দেখ আমার মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে, চোখের নিচে কালি, বুড়িয়ে গেছি।”
“সেতো আমিও বুড়িয়ে গেছি। সত্য কথা বলতে কি, কলেজে এসে আমি তোমার ওপরই সবচেয়ে উথালপাথাল হয়েছিলাম তবে আমি ছিলাম মুখচোরা, তোমার কাছে যেতে লজ্জা পেয়েছিলাম, মনের কথা প্রকাশ করতে পারিনি, ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যেতাম। তোমাকে মনে হতো সৌন্দর্যের দেবী। একদিন না দেখলে জানটা ছিন্নমস্তক পাখির মতো ছটফট করতো। কিন্তু কোনও দিন মুখ ফুটে বলতে পারিনি। তাই হৃদয়ের দ্বারে তালা মেরে শুধু ছাত্রের কর্তব্য পালন করে গেছি। ফলে ভাল ছাত্র হতে পেরেছি, কিন্তু প্রেমিক আর হতে পারিনি।
“কখনই জানতাম না যে তুমি আমার অপেক্ষায় ছিলে।”
বাদাম খেতে খেতে আমার মন সুদীর্ঘ কুড়ি বৎসরের ধূসর ব্যবধানের ওপারে আমাকে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে একেবারে শহীদ মিনারের সামনের রাস্তাটা যেখানে বিজ্ঞান ভবনে গিয়ে মিশেছে, রুনা আজও আঠার বছরের কিশোরী, যেখানে সে আজও দুপুরবেলায় বই হাতে ছোটাছুটি করে নিয়মমতো।
আমাদের দুজনের মুখেই এক প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে, প্রৌড়ত্বের গভীরে ঢুকে পড়া দুটি মানুষের মনে ফুটে ওঠে কোনো চঞ্চলা কিশোর কিশোরীর ছবি, ফেলে আসা ছেলেবেলার সোনালি দিনগুলি।
“এটা খুব মিষ্টি। সেই দিনগুলির স্মৃতি এখন কিছু ভাগ করে নেওয়ার পালা আমার। আমিও খুব লাজুক ছিলাম কিন্তু কাছের কয়েকজনের বলয়ে নিজেকে ঘিরে রেখে তা আমি সামলাতে পেরেছি।”
“রুনা, দিনগুলি অবশ্যই স্মৃতিময়। কিন্তু আমাদের জীবন তো কোথাও থেমে থাকার না। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। দিন বদলের সঙ্গে জীবনও বদলে যায়।”
“তুমি ভাল করেছো। কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আচমকা এক অসীম শূন্যতা নেমে আসল। সামনের দিনগুলো নিয়ে অজানা আনন্দ রোমাঞ্চ তরঙ্গিত সময়ের ঢেউয়ে মিলেমিশে এসে ধাক্কা মারছিল ভেতরে। কোন কিছুতে থিতু হতে পারছিলাম না।
আমিও নিজে ভীষণ একা, ভীষণ।
আমি নিজেকে নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টায় এতটাই ব্যতিব্যস্ত থেকেছি অন্যদিকে মনযোগ দেয়ার ফুরসতই হয়নি, সত্যিকারের শুভাকাংখীরা আমার ক্যারিয়ারের অস্থিরতায় একসময় দূরে চলে গেছে। পরে যখন এদিকে মনযোগ দিলাম, আমি এমন একজনকেও খুঁজে পেলাম না যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, যে আমার চোখের জল, আমার যন্ত্রণা, বিষণ্ণতা নিয়ে মাথা ঘামায়…।
যাক, তুমি এখন কী কর? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
একটা স্কুলে শিক্ষকতা করি।
আমার মনে হলো, সব থেকেও কিসের যেন একটা অনন্ত চাহিদায় রুনার হৃদয়ে মরুভূমির উত্তাপ।
সুযোগটি নিলাম। রুনাকে গান গাইতে বললাম। সে ফিসফিস করে বলল, “আমাকে গান গাইতে বলতে তোমার এত সময় লাগল কেন?” ওর কোমল কথাগুলি আমার কাছে কবিতার মতো মনে হল। সেগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে মনের মধ্যে একটা পুলক জাগল, উৎসাহিত বোধ করলাম। মনের ভিতরে অদ্ভুত প্রশান্তি। চোখ জুড়ে আসে আনন্দে। রুনা কাছে এসে আমার ডান হাতটা ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কোমরে হাত রাখলাম। চোখে চোখে হারিয়ে গেলাম, ও গুনগুনিয়ে গাইতে থাকল-
ওবেলায় হলোনা কথা
এবেলায় হলো সাথী।
বালু চরে চল যাইগো সখা
ঘর বাঁধি চল এবার ঘর বাঁধি…
বন্ধ কামরার ভিতরের প্রতিধ্বনির মতো গানের মিষ্টি সুর আমার কানে ফিরে ফিরে বাজতে লাগল। বাগান থেকে চন্দ্রমল্লিকার একগোছা শাদা আর হলুদ ফুল তুলে ওর খোপায় গুঁজে দিলাম। ফুলের গাছগুলো দুলে উঠল, আমার মনে আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। গাছগাছালি, গাছের মাথায় বসে-থাকা পাখপাখালি আর এর নির্জনতা ওর সৌরভ ছড়ানো হাসিতে চমকে উঠে নতুন রুপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এক অপার্থিব খুশবুর স্নিগ্ধ সৌরভ ছেয়ে ফেলেছে আমাদের চারপাশ। ওর কপালের ওপরের ঝুলে পড়া চুলগুলোর ওপর পড়া রোদটুকু এক অন্যরকম অপার্থিব আলো ছড়াচ্ছিল। পুরো বাগানটা জুড়ে ছায়া নেমেছে। অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করছে। একটা নাম না জানা পাখি উড়ে যায়, একটা অচেনা পাতা ঝরে পড়ে।
লেখক : কবি ও গল্পকার, টরন্টো, কানাডা