সাইফুল আলম চৌধুরী
দুই. তার সাহিত্য-কর্মের পুনর্পাঠ :
তের. অধ্যাপক-নাট্যকার মুনীর চৌধুরী- আমার শিক্ষক-অভিভাবক অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমেদ ক্লাসে যখন ‘নাটক আর ট্র্যাজেডি’ নিয়ে পাঠ দান করতেন তখনই বারংবার মুনীর চৌধুরীর প্রসঙ্গের অবতারণা করতেন। প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বের উচ্চারিত মমতাজ স্যারের অবাক বিস্ময়কর দুটি বাক্য আমৃত্যু বিস্মৃত হবো না- “মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক আছে, কিন্তু নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর কবর থাকলো না।”
আমার শিক্ষকের শিক্ষক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে জীবনে একবারই সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো একাত্তরের উত্তাল-উন্মাতাল গণঅভ্যুত্থান এবং অসহযোগ আন্দোলনের ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে। চট্টগ্রামের শহীদ মিনারের বিপরীতে অবস্থিত মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে তিনি বিরামহীন নিরবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ প্রায় ঘণ্টা দুয়েক আলোচনা করলেন তার নাট্যকর্ম, বাংলা নাটকের স্বরূপ অন্বেষণ, আগামীর ভাবনা, সেই সময়ের বৈরী-প্রতিক‚ল নাট্য পরিমন্ডল, নাট্যাভিনয় এবং গ্রীক-শেক্সপীয়র, আধুনিক ট্র্যাজেডি বিষয়াবলী নিয়ে। সেই সমাবেশে বিদগ্ধ নাট্যবোদ্ধা, নাট্যজন, অভিনয় শিল্পী, মঞ্চ কর্মীরা যেমন উপস্থিত ছিলেন, তেমনি সাধারণ নাট্য দর্শক-শ্রোতাগণও আগ্রহভরে গিয়েছিলেন। এখনো স্মরণে আছে, মমতাজ স্যার তার সেইদিনের সুদীর্ঘ বক্তব্য স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের ক্যাসেটে ধারণ করে রেখেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরবর্তীকালে স্যারের নিকট থেকে জেনেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অন্যান্য ঐতিহাসিক অপ্রকাশিত সাহিত্য কর্মের সাথে মুনীর চৌধুরীর ধারণকৃত ফিতাসমৃদ্ধ ক্যাসেটখানি ঘরের স্ত‚পের অভ্যন্তরে রোপন করেছিলেন। স্যারের নয় মাসের হাইড আউটে অবস্থানের কারণে, বড্ড অযতেœ ধুলো-ময়লায় মিশ্রিত ক্যাসেটটি চিরতরে নির্জীব হয়ে যায়, যা দেশ স্বাধীন হবার পর ঘরে ফিরে তিনি আবিস্কার করেছিলেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী কণ্ঠস্বর ক্যাসেট থেকে একেবারেই নিশ্চি?হ্ন হয়ে গিয়েছিলো, কিছুতেই তা আর উদ্ধার করতে পারেননি আমার শিক্ষক। এই বিষয়ে তাকে অনেক সময় কেবল আফসোস করতেই দেখেছি।
মমতাজ স্যার তার স্মৃতি-স্মারক গ্রন্থে এই বিষয়ে উল্লেখ করেন : “মনে আছে উনিশ শ’ একাত্তরে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কিছু সময় মুনীর চৌধুরী চাটগাঁতে কাটিয়েছেন। ক্যাডেট কলেজে অনুজের বাসায় থাকতেন, দিনের বেলাটা সুযোগ পেলে চাটগাঁ কলেজে চলে আসতেন। আমরা তার ছাত্র ছিলাম কয়েকজন। আমাদের সঙ্গে বসে চুটিয়ে গল্প-গুজব করতেন। অত কাছে থেকে তাকে আর কখনো দেখিনি। বিস্তর কথা বলেছেন সে সময়। নিজের কথা, দেশের কথা, সমাজের কথা, নির্বিচারে বলেছেন। বাবা, মা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র অনেক কথা। কখনো হালকা চালে, কখনো সামান্য ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলে যেতেন। বাবাকে নিয়ে মজার কথা বলছেন, কিন্তু সাথে সাথে অপরিমেয় শ্রদ্ধা মিশিয়ে দিচ্ছেন। বড় ভাই কবীর চৌধুরীকে নিয়ে ভয়ঙ্কর সব বিবরণ দিচ্ছেন, কিন্তু তারই মধ্যে বড় ভাইয়ের জন্য ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠছেন।
… একদনি বললাম, স্যার আমাদের ছাত্রছাত্রীরা ট্র্যাজেডি সম্পর্কে শুনতে চাচ্ছে। ম্যাকবেল, ইডিপাস নাটক দুটো তাদের জন্য পাঠ্য আছে, ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা করলে ওরা উপকৃত হবে। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, প্রস্তুতি ছাড়া আমি কোনো ক্লাস নিতে বা বক্তৃতা করতে পারিনে। কুড়ি বছরের বেশি হয়ে গেল পড়াচ্ছি, এখনো ক্লাসের আগের রাতে রীতিমতোভাবে বঙ্কিম রচনাবলী নিয়ে বসতে হয়। প্রস্তুতি না নিয়ে ক্লাসে যেতে আমার খুব ভয়। … তিনি আরো বললেন, যেখানে যাই একটা চলন্তিকা অভিধান হাতের কাছে রাখি, অসংখ্যবার বানান দেখি, অভিধানের সঙ্গে পরামর্শ করে নিই।”
অধ্যাপক মমতাজ উদদীন তার শিক্ষক শহীদ মুনীর চৌধুরীর সাহিত্য কর্ম এবং নির্মাণসমূহের বৈশিষ্ট্য আর বিশেষত্ব সম্পর্কে লিকেছেন, সেই ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে’ স্মৃতিগ্রন্থে : “শেক্সপীয়রের নাটক নিয়ে সবে কাজ শুরু করেছিলেন। একটি ট্র্যাজেডি আর একটি রগড অনুবাদও করেছিলেন। করতে চেয়েছিলেন রোমিও জুলিয়েট, অকারণ ডামাডোল আরো অনেক নাটকের অনুবাদ।
একই সঙ্গে নাট্যবোধ, শব্দ ভান্ডার এবং রসবোধের অপরূপ সমন্বয় হয়েছিল তার মধ্যে। তৎসম শব্দের এতবড় জোগানদার ছিলেন যে, তার মধ্যে অনায়াসে আরবি, ফার্সি শব্দের মিশেল দিয়ে অপূর্ব সজীব সংলাপ গড়ে তুলতে তিনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ কারিগর।
… মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন, ট্র্যাজেডি সামান্য মানব ও সামান্য ঘটনার পরিণামে সংঘটিত হয় না। ট্র্যাজেডি বড় কিছু চায়। অনেক বড়, মহৎ এবং শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে ট্র্যাজেডির সাফল্য। … মুনীর চৌধুরীকে বড় মহৎ ও শক্তিমান বিবেচনা করি। তার বিনাশকে মনে করি মহৎ এক ট্র্যাজেডি। আমাদের জন্য, বাংলা নাটকের জন্য এবং বাংলাদেশের নাট্যকর্মের জন্য মুনীর চৌধুরীর বিনাশ বৃহৎ এক বিনাশ। … যখন দেশ স্বাধীন হল, যখন দেশে নাট্যকর্মের জোয়ার এল, তখন যার নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি তখন তিনিই থাকলেন না।
… আমি তার সেমিনার বক্তৃতা শুনেছি। টেবিলের প্রান্তে বসে ঘরোয়া আলাপও শুনেছি। একা তার সঙ্গে কাটিয়ে বিস্তর প্রসঙ্গ বা প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে অন্য অনেক দূরের বা কাছের কথাও শুনেছি। কথা বলার মধ্যে তার এমন মোহ জাল বিস্তার করার সু² কারুকাজ ছিল যে, শ্রোতা ধীরে ধীরে তাতে নিমগ্ন হয়ে যেত। সেই জালে সহজেই বন্দী হয়ে নিরাপদ আশ্রয় লাভের আনন্দ অনুভব করতো মুগ্ধ শ্রোতা।
প্রায় তিনি শুরু করতেন নিজেকে নিয়ে। খুব সহজ ভঙ্গিতে নিজের নিজেকে রসময় করে ব্যাখ্যা করতেন। নিজের সঙ্গে পরিবারের, সমাজের, সাহিত্যের, রাজনীতির এবং সাধারণের সম্পর্ক অকুণ্ঠভাবে স্থাপন করে মুনীর চৌধুরী ক্রমে ক্রমে বিষয়ে ঢুকতেন। কোনো সংকোচ ও দ্বিধার মধ্যে তার কণ্ঠ কম্পিত হতো না। তার শব্দ ভান্ডার এত বিশাল ও বিচিত্র যে, শব্দের সন্ধানে তিনি বিভ্রান্ত হতেন না। তার কণ্ঠের চাপা ফাঁসা ফাঁসা ধ্বনির মধ্যেও প্রবল আকর্ষণ অন্যের কাছে সে কণ্ঠ সম্পদ হতো না, কিন্তু তিনি সে কণ্ঠকেই ঐশ্চর্য্যময় করে ছেড়েছিলেন।
প্রচুর লেখাপড়া তার। পৃথিবীর সর্বাধুনিক নাটকটি তিনিই প্রথম পড়ে নিয়েছেন এদেশে। নাট্য আন্দোলনের সর্বশেষ ঢেউয়ের সংবাদ তার কাছে এসেই প্রথম ধাক্কা মেরে যেত। জন অসবর্ণ বিষয়ে আমরা প্রথম শুনেছি তার কাছে। স্টান্ডবার্গের অতি আধুনিক অবচেতন চিত্তের দহন সমৃদ্ধ নাটক নিয়ে তিনিই প্রথম ঘণ্টার পর ঘন্টা আলোচনা শুনিয়েছেন আমাদের।
দীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনীর দুর্বল নাট্যশক্তির মধ্যেও তিনি শেক্সপীয়রের রঙ্গ তামাশার গোপন সংবাদটি প্রথম ধরিয়ে দিয়েছেন আমাকে। জলধরের মতো রসময় ভন্ড, ধূর্ত এবং বেকুব চরিত্রটির নাকানি চুবানি খাওয়ার বৃত্তান্তটি তিনি নিজের ঢঙে বলে আচ্ছন্ন করে দিয়েছেন আমাদের। জলধর চরিত্রে অভিনয় করার বড় সাধ ছিল তার। কিন্তু অধ্যাপক হয়ে তেমন বাঁদর গোছের চরিত্রে সম্পৃক্ত হওয়া নিরাপদ নয়। তাতে তার গৃহ, সমাজ এবং পরিবেশ বৈরী হবে।
তিনি সরস কণ্ঠে হেসে হেসে নির্বিচারে বলে যেতেন। সে সব কথা কতভাবে কত দিন শুনেছি আমি। বাংলা নাটক পাঠের আনন্দবোধ আমার জগতই না, যদি না তিনি, বাংলা নাটকের ক্ষুদ্র, সামান্য ও অকিঞ্চিতকর নাট্য ঘটনাগুলো আমার দৃষ্টির মধ্যে এনে দিতেন। তিনিই আমাদের স্বদেশী ও বিদেশী নাট্য বিষয় সম্পর্কে সচেতন করেছেন।
… চলে গেলেন। শয়তানরা, মনুষ্য নয় এমন কুৎসিত অমানুষরা তাকে হত্যা করল। তিনি রচনা করেছেন ভাষা আন্দোলনের নাটক কবর। আবার তিনিই রচনা করতে পারতেন মুক্তিযুদ্ধের উপাখ্যান। তা হল না।”
পাদটীকা : মুনীর চৌধুরীÑ-শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, অধ্যাপক, ভাষাতাত্তি¡ক। মুনীর চৌধুরীর জন্ম : ২৭ নভেম্বর ১৯২৫, অকাল মৃত্যু ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সেই দিন থেকে নিখোঁজ।
চৌদ্দ. মধুসূদন দে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর মধু’র ক্যান্টিন, পাশাপাশি ইতিহাস এবং কিংবদন্তি। মধু’র ক্যান্টিন একেবারে সজীব-জলন্ত ইতিহাসের আরেক নাম সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়। মমতাজ স্যারের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে মধুর ক্যান্টিনের চেহারা ছিলো টিনের চালায় নির্মিত। মধুসূদন দে ওরফে সে সময়ে সকলের ‘মধু দা’ সপরিবারে থাকতেন ঢাকা হলের (বর্তমানে শহীদুল্লাহ হল) পার্শ্বে কর্মচারীদের জন্যে নির্মিত ছাউনীতে।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ গণহত্যার বিভীষিকাময় কালরাত্রিতে মধুসূদন দে পাক-বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। আমার শিক্ষক তার সাথে ছাত্র জীবনের কিছু স্মৃতি নির্ভর কথা পাঠকদের উপহার দিয়েছেন :
“… ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধুর ক্যান্টিন মানে একটা কিংবদন্তি। তাও না, সজীব ইতিহাস। ছানার সন্দেশ আর সিঙ্গারা ছিল প্রসিদ্ধ। কখনো সখনো চিনির বসে চোবানো গজাও হতো। তবে সন্দেশের ছিল খুব কাটতি। যে ঢোকে, সেই সন্দেশ খায়। মধুর সন্দেশ খায়নি, এমন সচিব, অতিরিক্ত সচিব, রাষ্ট্রদূত, বিজনেস ম্যাগনেট আর মন্ত্রী এখনো বাংলাদেশে কেউ নেই। সবাই মধু দা’র টিনের চালার নিচে লোহার শিক দিয়ে বানানো চেয়ারে বসে সন্দেশ খেয়েছে।
… মধুর সন্দেশ না খেলে ছাত্র রাজনীতি করা সম্ভবই ছিল না। দরাজ গলা, এক হাঁকে মধু দা’র কর্মচারীরা সন্দেশ নিয়ে ছাত্র নেতাদের চেয়ারে চেয়ারে ছুটে যেত। মধু দা জানতেন এদের মধ্যে কে নগদ খাবে আর কে ধার রাখবে। … কিন্তু মধু দা’র টাকা মেরে পালিয়েছে তেমন বান্দা বেশি নেই। ছাত্র জীবনে শোধ না করুক, চাকুরি জীবনে পাই পাই করে বাকি টাকা দিয়ে গেছে। মধু দাকে ঠকাতে কেউ চায়নি।
মধু বড় মুখ করে বলতেন, আমার টাকা কেউ নিয়ে যেতে পারবে না স্যার। আমি কারো নিয়ে আসিনি, তাহলে আমারটা কে নিয়ে যাবে? মাঝে মাঝে মধু দা একটু হতাশ হয়ে দু’একজনের নাম বলতেন, আহারে দু’বছর হয়ে গেল, তারা গেলেন কই? আমার ধারের টাকার জন্য বলি না, তারা একবার আসুন, এখানে বসে গল্প-গুজব করুন। চা সন্দেশ খেয়ে যান। আমি টাকার জন্য ভাবি না। কিন্তু তাদের দেখি না বলেই মনে ব্যথা করে।
… বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলাম। কলেজে মাস্টারি করি। ঢাকার বাইরে থাকি। ঢাকা এলেই মধুর ক্যান্টিনে বসি। নতুন পুরাতনদের সঙ্গে দিনভর আড্ডা। ক্ষণে ক্ষণে সন্দেশ গজা আসে। খাই, সময় কেটে যায় ভালো। কে কখন অর্ডার দেয়, কে খায় তার হিসাব থাকে না। মধু দা কাছে আসে। ভারি কণ্ঠে বলে, এত ঘন ঘন আমার এখানে আইসেন না, পকেটের মালপানি কিছুই থাকব না। এখন যা যা খান, সবই তো আপনার খাতায় ওঠে।
মধু দা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন না। বড় ভাইয়ের মতো আমাদের তদারকিও করতেন। কে কাকে ঠেলা মারছে, কার পকেট খালি হচ্ছে, মধু দা ঠিকই বুঝতেন। তাই ঠিক সময়ে সাবধান করে দিত। মধু দা মানুষটা বড় সহি মানুষ ছিল। অমন মানুষের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।
… মধু দার ক্যান্টিনের যত যত সন্দেশ, নিমকি আর চা খেয়েছি, তার জন্য সব টাকা কি আমি পরিশোধ করেছি? মধু দা বেশ হিসেবি লোক। কাউকে ছেড়ে দেয়নি, ন্যায্য পাওনা সময় মতো সবই বুঝে নিয়েছে। কিন্তু আমার কেমন যেন বার বার মনে হয়, মধু দা আমাকে ছাড় দিয়েছেন। বেশ ভাল রকম ছাড়। কয়েকবার বলেছি, মধু দা, পাওনা কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেন। যদি মন্ত্রীটন্ত্রী হয়ে যাই, তাহলে সবার সামনে বাকি টাকা চাইলেও দেব না।
মধু দা বেশ গুছিয়ে হেসে বলেছিল, আশীর্বাদ করি তেমন কিছু হোন। তখন খাতা মেলে দিয়ে বলব, আগে শোধ করেন, তারপর দ্যাশের কাম করেন। মধু আমার নাম, কিন্তু মানুষটা আমি খুব দড়।
মধু দা বুকে হাত দিয়ে বলেছিল, ভায়া, এই বুকের মধ্যে আপনার বাকির হিসাব লেখা আছে। সে হিসাব শোধ করার ক্ষমতা আপনারও নাই, আমারও নাই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধু’র ক্যান্টিনের সত্ত¡াধিকারী শ্রী মধুসূদন দে’কে আমার এই জীবনে তো সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয়নি, তবে চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে মরহুম তালেব আলীকে নিবিড়ভাবে পেয়েছিলাম। ধারণা হয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন-ক্যাফেটেরিয়ার মালিকগণের সবারই স্বভাব-বেশিষ্ট্য প্রায় অনুরূপ হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম কলেজের ‘অন্বেষা’ বার্ষিকী সম্পাদনায় তাই সেই বছরের ম্যাগাজিন মরহুম তালেব আলীর স্মরণে উৎসর্গ করেছিলাম।
মমতাজ স্যারের বর্ণনা হতে মধু দা ওরফে মধুসূদন দে’র শারীরিক ও মুখায়ব কল্পনা করা যেতে পারে অনায়াসে, কাইয়ুম চৌধুরীর তুলির স্পর্শে যা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্যার পাঠকদের জানান দেন : … “মানুষটা বেশ মোটাতাজা ছিল । হাঁটতো যেন একটা হালকা পাহাড় যাচ্ছে। … তার মনটা যেমন সবুজ ঘাসের মতো সজীব, কণ্ঠও ছিল খোলামেলা। যখন ডাক দিত, সে ডাক বহুদূর থেকে শোনা যেত। মধু দা’র কণ্ঠে সাহস ছিল, কিন্তু গর্জন ছিল না। মধু তো মধুসূদন। মধুসূদন দে। মধু নামক দৈত্যকে বিনাশ করে তবেই না মধুসূদন।
… মধু দা’র হৃদয়ের হিসাব মেলাবার ক্ষমতা আমারও নাই। যদি বেঁচে থাকতো, তখনো হিসাব মেলাতে পারতাম না। … এখনো মাঝে মধ্যে মধু দা’র দরাজ গলার ডাক শুনি, ওরে ঐ কোণের সাহেবকে সন্দেশ দে, গজা দে। শুনি আর দু’চোখ জলে ভরে ওঠে। মনে মনে বলি, কে বলে মধু নেই। … আর মধুসূদন যে, সে তো চিরকালীন।
পাদটীকা : মধুসূদন দে- জন্ম : ১৯১৯, মৃত্যু : ২৬ মার্চ ২৯১৭ (পাক বর্বর সামরিক বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের স্মৃতিতে কিংবদন্তি। (অসমাপ্ত/চলবে)
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও কলামিস্ট। sakil19@hotmail.com