শুজা রশীদ : (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
রিমার ঘুম ভাঙল মুখে একটা বিস্বাদ অনুভূতি নিয়ে। নিজেকে শুষ্ক, তৃষ্ণিত মনে হয়। সকাল ছয়টায় এলার্ম দিয়ে রেখেছিল কিন্তু এলার্ম বাজার আগেই তার ঘুম ভেঙে গেছে। বাইরে এখনও বেশ অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশ নজরে পড়ে। ভোর চারটা বাজে। আগের রাতে কিভাবে বাসায় ফিরেছিল মনে করতে পারে না। মিলা তাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। নিশ্চয় বাইশ তলা পর্যন্ত উঠে তাকে এপার্টমেন্টে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে ফিরেছে। মিলা ঐ রকমই। সে হচ্ছে তার গার্ডীয়ান এঞ্জেল। ঢাকায় এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ার সময় তার খুব পছন্দের একজন তরুণ শীক্ষিকা ছিলেন। তার নাম ছিল মিস মিলা। সেই জন্যেই প্রায়ই মিলাকে ক্ষ্যপানোর জন্য তাকে মিস মিলা বলে ডাকে। অন্ধকার ঘরের মাঝে একা একা মুচকি হাসে রিমা।
আবার ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এলো না। সাধারণত গঞ্জিকা সেবনের পর তার ভালো ঘুম হয়। কিন্তু আজ তার ব্যাতিক্রম হয়েছে। পরবর্তি আধা ঘন্টা বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে উঠ পড়ল। হঠাত ক্ষিধায় নাড়ি ভুড়ি চক্কর দিয়ে উঠল। রান্নাঘর গিয়ে যতখানি সম্ভব নিঃশব্দে একটা স্যন্ডউইচ বানালো। বাচ্চারা সবাই ফায়জার কামরায় ঘুমাচ্ছে। ওদেরকে জাগিয়ে দিতে চায় না। সকালে ফায়জা এবং জিব্রানের স্কুল আছে। যার অর্থ, রবিনকে সামলানোর দায়িত্ব তার কাঁধে পড়বে। বিরাট সমস্যা। গত সপ্তাহ দুই ধরে একজন মহিলাকে ও খুঁজে পেয়েছে যে এই বিল্ডিংয়েই থাকে এবং রবিনকে প্রতিদিন ঘন্টা খানেকের জন্য রাখতে সম্মত হয়েছে। তার জন্য এটা একটা আশীর্বাদের মত। ঢাকা গ্রোসারীতে আরোও কয়েক ঘন্টা কাজ বেশি নিয়ে নিয়েছে। আগে মানিকের সাথে শেফালীও আসত সকালে দোকান খোলার সময়। ডায়াবেটিস আর হাই ব্লাডপ্রেসার ধরা পড়ার পর থেকে শেফালী কাজ কর্ম একটু কমিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল, বিশেষ করে সকালের শিফটে সে অন্য কাউকে খুঁজছিল। সুযোগটা রিমা নিয়েছে। টাকাটা তার দরকার।
ধীরে সুস্থে স্যান্ডউইচটা খেল রিমা, তারপর ফায়জার রুমে উঁকি দিল। বাচ্চারা আঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় না গিয়ে বাইরে বেলকনিতে গিয়ে শীতল কংক্রিটের মেঝেতে বসল। এক দল কবুতর এখানে এসে তাদের প্রাতঃকর্ম সারে। এই বেলকনিতে শুধুমাত্র মিন্টুই আসত, হয় সিগ্রেট টানতে নয়ত এমনি হাওয়া খেতে। সেই মাঝে মাঝে জায়গাটা পরিষ্কার করত। তার মৃত্যুর পর এখন পর্যন্ত এখানে পা দেয় নি রিমা। এটা ছিল মিন্টুর বিশেষ জায়গা। তার মনে হয় সে মানুষটার ব্যাক্তিগত গন্ডিতে অনাহুতের মত প্রবেশ করেছে। পায়জামার নীচে ভেজা কিছুর স্পর্শ পেল। সেটা কি বুঝতে অসুবিধা হল না। সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। ভালো করে ধুলেই চলে যাবে। এখন ও দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে চায়, দেখতে চায় কিভাবে আঁধার ধীরে ধীরে আলোয় ভরা একটি চমত্কার দিনে রূপান্তরিত হয়।
সোমবার সকাল। যেদিন স্কুল খোলা থাকে ফায়জা ছয়টার আগেই উঠে পড়ে, গোছল করে, নাস্তা করে, নিজের এবং জিব্রানের লাঞ্চ প্যাক করে, তারপর জিব্রানকে ঘুম থেকে টেনে তোলে, তাকে নাস্তা খাওয়ায়, তারপর আটটার দিকে মাকে একটা আলিঙ্গন দিয়ে ভাইকে নিয়ে স্কুলের পথে বেরিয়ে পড়ে। রিমাকে এসব নিয়ে একেবারেই ভাবতে হয় না। গত বছর ওদেরকে স্কুল পর্যন্ত দিয়ে আসত। এবছর ফায়জা তাকে একরকম জোর করেই নিরস্ত করেছে। সে এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে। জিব্রানকে সাথে নিয়ে স্কুলে যাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়। রিমার একটু দুশ্চিন্তা থাকলেও সে জোরাজুরি করে নি। সত্যি বলতে কি ভেতরে ভেতরে সে একটু স্বস্তিই বোধ করেছিল। মিন্টু আর নেই যে তার কাছে রবিনকে রেখে চলে যাবে। তাকে সাথে নিয়ে কোথাও যাওয়াও একটা অত্যচারের মত।
ওরা দু’জন স্কুলে চলে যাবার পর রিমা অনেক্ষণ ধরে গোছল করল। মাথাটা ধরে ছিল। গোছল করেও কোন কাজ হল না। একটা টাইলানল খেল, রবিনকে তুলে হাত মুখ ধোয়াল, নাস্তা করাল – যেরকম খুঁতখুঁত করে খাওয়া নিয়ে, তাকে খাওয়ানোও একটা যুদ্ধের মত। তাকে পোশাক পরাতেও আরেক দফা যুদ্ধ করতে হয়। যে হাফ প্যান্ট আর হাত কাটা গেঞ্জী পরবার জন্য সে জিদ ধরেছে এইরকম ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেটা পরা যাবে না কিন্তু তাকে বোঝানো দুঃসাধ্য। রিমা বকা ঝকা দিয়ে অন্য কিছু পরানোর চেষ্টা করল, তাতে কোন কাজ হল না। উল্টো ক্ষেপে গিয়ে চিত্কার চেঁচামেচি শুরু করল রবিন। বাধ্য হয়ে হাল ছাড়ল রিমা। একটা ব্যাগের মধ্যে কয়েকটা গরম কাপড় এবং রবিনের লাঞ্চ ঢুকিয়ে নিল, তাকে তার স্পাইডারম্যানের জুতা পরাল। বাসা থেকে বের হতে হতে সাড়ে নয়টা বাজল। দোকান খুলবে দশটায়। কয়েক মিনিট আগেই পৌঁছানোটা দরকার। মানিক শেফালীর মত সময় নিয়ে অত খিটমিট না করলেও রিমা চায়না এমন কিছু করতে যেন মনে হয় সে মানিকের ভালোমানুষির সুযোগ নিচ্ছে। মানিক এবং শেফালীর দোষত্রুটি থাকলেও তাদের দোকানে কাজ করতে ভালোই লাগে।
রবিনকে যে অল্পবয়স্ক মহিলা বেবিসিটিং করে তার নাম আরিফা। খুব আলাপী, মধ্য বিশ হবে বয়েস, নিজের দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। আশেপাশের এপার্টমেন্টের আরোও তিনটি বাচ্চাকে সে দেখভাল করে। তার রেট খুব কম। ঘন্টায় মাত্র দুই ডলার, দিনে বিশ ডলার। রিমার কাছে এর চেয়ে সস্তা আর কিছু হতে পারে না। প্রতিবন্ধি একটা বাচ্চাকে দেখার জন্য কাওকে পাওয়াই একটা সমস্যা। আরিফা তার অনেক অর্থ বাঁচিয়ে দিয়েছে। দিনে বিশ ডলার দেয়াটা তার পক্ষে সম্ভব। দোকানে দুই ঘন্টা বেশী কাজ করতে হবে প্রতিদিন, যদি পাওয়া যায়।
রবিন আরিফাকে পছন্দ করে। ভালোবাসা সে ভালোই বুঝতে পারে। মাত্র কয়েক দিনেই আরিফার সাথে ওর বেশ একটা ভাব হয়ে গেছে। সে হাসি মুখে কিছু করতে বললে রবিন তার কথা শোনে।
আরিফার সাথে আলাপ করবার সময় ছিল না রিমার। হেঁটে দোকান পর্যন্ত যেতে মিনিট বিশেক তো লাগবেই। গরম কাপড়ের ব্যাগটা আরিফার হাতে তুলে দিয়ে বিদায় নিল সে। আরিফা বাচ্চা সামলাতে ওস্তাদ। ঠিকই সামাল দেবে।
শরতের সকাল কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডাটা একটু বেশীই। কামিজের উপর একটা হালকা জ্যাকেট পরে নিয়েছে সে। এমনিতে ও শার্ট প্যান্টই পরে বেশি কিন্তু ঢাকা গ্রোসারীতে কাজ করতে গেলে তাকে দেশী কাপড় পরতে অনুরোধ করা হয়েছে। মানিক অবশ্য পোশাক নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। একেবারেই যে খেয়াল করে না তাও নয়। যে সব দিনে রিমা একটু ভালো কিছু পরে, হালকা সাঁজ গোঁজ করে আসে, ও লক্ষ্য করেছে মানিক তাকে গোপনে পরখ করছে। ধরা পড়ে গেলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে কিন্তু ধরা না পড়ার জন্য যে খুব চেষ্টা করে তাও নয়। তার মধ্যে এক ধরনের বীনিত ধুর্ততা আছে, সে সবার সামনে নিজেকে খুব উচ্চ মানসিকতার একজন সত মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে একজন সুন্দরী নারীর সৌন্দর্যকে উপভোগ করবার মত মানসিকতা তার নেই। রিমা তাকে যে খুব একটা অপছন্দ করে তা নয়, শুধু যখন দেখে সে ড্যাব ড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে আছে তখন শরীরটা একটু ঘিন ঘিন করে ওঠে।
যাইহোক, পোষাক সংক্রান্ত নিয়মটা শেফালীর। সে সাধারণত শাড়ী পরে দোকানে কাজ করতে আসে। তার মতে একটা দেশী দোকান শুধু দেশী জিনিষ পত্র বেঁচবে সেটাই যথেষ্ট নয়। সাংস্কৃতিক দিকটাও বিবেচনা করা উচিত। রিমা খামাখা এসব নিয়ে ঝামেলা করতে চায়নি যদিও জিনস আরে টি-শার্ট পরতেই তার ভালো লাগে, দেশী জামা কাপড় পরতে অত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।
হাঁটার গতিটা বাড়িয়ে দিল। যেমনটা মনে হয় দূরত্ব তার চেয়ে বেশিই। দোকানে যখন পৌঁছাল মানিক ততক্ষণে দোকান খুলে ফেলেছে। রিমাকে দেখে সে বিশাল একটা হাসি দিল। রিমা প্রত্যুত্তরে সংক্ষিপ্ত একটা হাসি দেয়। লোকটাকে দেখে যত নিরীহ মনে হয় তার ধারণা সে ততখানি নয় এবং তার কাছ থেকে যতখানি দূরত্ব বজায় রাখা যায় ততই ভালো। মাঝে মাঝে তার চোখে লোভাতুর কিছু একটার ঝিলিক দেখেছে সে। সতর্ক থাকাই ভালো।
সোমবার সকাল সাধারণত বেশি ব্যাস্ত থাকে না। বিকালের দিকে ধীরে ধীরে ভীড় বাড়ে। দোকানে ব্যাস্ততা না থাকাটার মধ্যে ভালো মন্দ দুটি দিকই আছে। ক্যাশিয়ার হিসাবে তার খাটুনীটা কম হয় কিন্তু মাঝে মাঝে শেলফে গিয়ে জিনিষপত্র গোছাতে হয়, ফাঁকা শেলফ ভরতে হয়। সমস্যা হচ্ছে সেই সময়টুকু তার সাথে সবার আলাপ করবার সুযোগ তৈরী হয়ে যায়। শুধু মানিক নয়, দোকানে যারা কাজ করে- মিট কাটার, লোডার, কাস্টোমার- সবাই আলাপ জমাতে চায়। দিনকাল কেমন যাচ্ছে? একা একা কোন ঝামেলা হচ্ছে? পুলিশ কি এখনও বিরক্ত করে? ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি? একাকী আর কত দিন? তিন বাচ্চা নিয়ে নিশ্চয় খুব সমস্যা হচ্ছে।
রিমার ইচ্ছে হয় চীত্কার করে বলে, মাত্র তো দু মাস হল। না, তার মোটেই একাকী লাগে না। না, সে এখন নতুন সঙ্গীর খোঁজ করছে না। না, বাচ্চাদের নিয়ে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না। যে যার জীবন নিয়ে এগিয়ে যাক, তাকে নিয়ে কারো এতো উদ্বিগ্ন হবার কোন প্রয়োজন নেই। নিজের জীবন সে নিজেই সামলাতে পারবে।
কিন্তু বাস্তবে সে মেজাজ ঠান্ডা রেখে সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেয়, তোতা পাখীর মত একই কথা বার বার বলতে থাকে, কেউ রোমান্টিকভাবে অতিমাত্রায় আগ্রহ দেখালে সবিনয়ে প্রত্যখ্যান করে। এখন সে ওসব নিয়ে একেবারেই ভাবছে না। কখন আবার ভাবতে পারবে কিনা জানেও না।
একমাত্র কালামের সাথে আলাপ করতে ওর খারাপ লাগে না। অল্প বয়স্ক ছেলে, পড়তে এসেছে, টরন্টো ইউনিভার্সিটির স্কারবোর ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করে আর এখানে পার্ট টাইম মিট কাটার হিসাবে কাজ করে। তার বয়েস বিশের বেশি হবে না। হালকা পাতলা গড়ন, মাঝারী উচ্চতা, একটু চুপচাপ স্বভাবের। সে নিজের মত কাজ করে, কেউ কোন আলাপ না তুল্লে কথা বলে না। কিন্তু রিমার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হয়। দেশে তার একটা বড় বোন আছে, রিমাকে দেখলে তার কথা মনে পড়ে যায়। রিমার নিজেরও দেশে একটা ছোট ভাই আছে যদিও তার সাথে গত দশ বছরে দেখা কিংবা আলাপ হয়নি। কিন্তু দু’জনের সখ্যতা হতে সময় লাগে নি।
ওর সাথে আলাপ করতে পছন্দ করে কালাম। নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে বক বক করে কালাম। কমার্সে পড়াশুনা শেষ করে নিজের ব্যাবসা শুরু করতে চায়। তার অনেক স্বপ্ন। সফল্যের মাপকাঠিতে সে অনেক উপরে উঠতে চায়, তার বাবা মাকে গর্বিত করতে চায়। নিজ পরিবারের প্রতি ওর এই গভীর অনুরক্তি দেখে রিমার খুব আলো লাগে।
কালাম সাধারণত কাজে আসে সন্ধ্যায়। সকালে তার ক্লাশ থাকে। মাংসের সেকশনে তার সাথে আরও দু’জন কাজ করে, দু জনাই পঞ্চাশোর্ধ। রহমান একটু মোটাসোটা, মাথা ভর্তি পাকা চুল। আখন্দ চিকন চাকন, কলপ করা চুল দেখে তার বয়েস একটু কম মনে হয়।
রিমা একটু অবসর দেখে মিট সেকশনে কালামের খোঁজে গেল। তাকে দেখল না। রহমান আর আখন্দের সাথে ভালো মন্দ দু একটা কথা বলে নিজের কাউন্টারে চলে এলো। ক্রেতাদের ভীড় একেবারেই নেই বলতে গেলে। তার ক্যাশিয়ারের সামনে কেউ নেই। সে একটা খরের কাগজ তুলে নিয়ে হেডলাইনে চোখ বোলাচ্ছিল যখন সদর দরজা খুলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকল। দরজায় ঝোলান বেলটা টুং টাং করে বেজে উঠল। কৌতূহলী হয়ে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে চাইল রিমা। লোকটাকে দেখেই সে জমে গেল।
এখানে তার আসার কথা নয়।
শুধু এখানে নয়, তার আশেপাশেই আসার কথা নয় তার।