শুজা রশীদ : (পর্ব ১৫)
২১.
দিন দুয়েক পরে ড্রাইভিং স্কুল থেকে আসমা যখন ফোন করল, একটু অবাকই হল রিমা। প্রথম সেশনে যে ধরনের ভয়াবহ সব ভুল-ভ্রান্তি করেছিল তারপর ভদ্রমহিলা আবার তাকে নিয়ে রাস্তায় নামবে ভাবতেও পারেনি ও। সেদিন আসমাকে দেখে একটু ভীত-সন্ত্রস্থই মনে হয়েছিল। রিমা ভেবেছিল মিলাকেই বলবে তার গাড়িতে ওকে কয়েকটা লেসন দিতে। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পাল্টেছিল। মিলা তার কিয়া গাড়িটাকে খুব ভালোবাসে। ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে বেচারীর গাড়িতে কোন ঘাই গুতা লেগে গেলে রিমার খুব অপরাধবোধ হবে।
আসমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে গেছে। রিমাকে ফোন করেছিল জানার জন্য সে আরেকটা লেসন চায় কিনা। চাইলে আসমা বিকালে এসে ওকে নিয়ে যাবে। সুযোগটা নিল রিমা। ড্রাইভিং স্কুল চারদিক অনেক আছে কিন্তু বাংলাভাষী মহিলা ইন্সট্রাক্টর খুব বেশি নেই।
বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে আসার পর রিমা আরিফার কাছ থেকে রবিনকে নিয়ে এসে গোছল করালো, খাওয়ালো, তারপর ফায়জার হাতে তুলে দিল। খাওয়া নিয়ে খুব খুঁত খুঁত করে ছেলেটা, মায়ের হাতে ছাড়া কারো কাছে খায় না।
আসমা বিকাল ৪টার দিকে তাকে তুলে নিল এপার্টমেন্টের সামনে থেকে। একটা নিরালা রাস্তায় গিয়ে গাড়ি থামাল।
“ড্রাইভিং খুব সহজ,” আসমা স্বভাবসুলভ কাটখোট্টা স্বরে কথা বলে যদিও আজকে রুক্ষতার পরিমাণ অনেকখানি কম। “কিন্তু তোমাকে সবসময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আর মনযোগ দিতে হবে। অন্য গাড়িগুলো কি করছে সেদিকে বেশি লক্ষ্য কর না। তোমার লক্ষ্য থাকবে রাস্তার উপর। সাইনগুলো কি বলছে খেয়াল কর, রাস্তার নিয়ম-কানুন মেনে চল। প্রথমবার তুমি খুব ঘাবড়ে ছিলে। প্রথম প্রথম ঐরকম হয়ই। কিন্তু আজকে আমি কিছু উন্নতি দেখতে চাই। রেডী?”
রিমা মাথা দোলায়। আসমাকে প্রথমবারের মত তত মেজাজী মনে হয় না। মাথার চারপাশে শক্ত করে হিজাব প্যাঁচানো থাকে বলে বয়েসটা ঠিক ঠাহর করা যায় না কিন্তু বয়েসে সে রিমার চেয়ে বেশ বড়ই হবে, হয়ত মধ্য চল্লিশ। আরেকটু বন্ধুত্বপূর্ণ হলে ভালো হত। মাঝে মাঝে একটু আধটু হাসলেও তো ভালো লাগে। কিন্তু মানুষটাই ঐরকম। সবাইতো আর এক রকম হয় না।
“তোমাকে দেখে একটু আনমনা মনে হচ্ছে,” আসমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে খেয়াল করতে করতে বলল।
“না, না, আমি ঠিক আছি। আমি পারব আজকে।” রিমা খুব চেষ্টা করে তার হাবে ভাবে দৃঢ়তা ফুটিয়ে তোলার। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার গলা শুকিয়ে এসেছে। বুকের মধ্যে সমানে ঢেঁকী পড়ছে।
তার অবস্থা বুঝতে দেরী হল না আসমার। “ভয় পাবার কিছু নেই,” সে বলল। “আমি অনেক মহিলাকে লেসন দেই। বিশ্বাস কর, পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে তোমার মাথায়। যদি ভয়ের কাছে নতি স্বীকার কর তাহলে কোনদিন কোন কিছু করতে পারবে না। কষে ভয়ের লাগাম টেনে ধর। বুক ভরে শ্বাস নাও।”
তার কথা মত কাজ করল রিমা। গভীরভাবে একটা শ্বাস নিল, শক্ত করে চেপে ধরল স্টীয়ারিং হুইল, গ্যাস পেডালটা স্পর্শ করল, তারপর পা রাখল ব্রেকে, আয়নাগুলোতে নজর বোলাল, তারপর তাকালো সামনেÑ রাস্তায়। ঘোড়ার লাগাম চেপে ধরতে হবে তাকে, ভয়কে জয় করতে হবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে কারো গায়ের উপর গাড়ি না তুলে দেয়।
এক ঘন্টা পরে, ঘামে জবজবে রিমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যখন আসমা শেষতক সেদিনের মত লেসনের সমাপ্তি ঘোষণা করল। আগের দিনের চেয়ে বেশ ভালো করেছে রিমা আজকে কিন্তু তারপরও ওর ভয় খুব একটা কাটেনি। হাত কাঁপছিল, বুক দুরু দুরু করছিল। আসমা চেষ্টা করেছে ওকে সাহস জোগাতে। এপার্টমেন্টের সামনে ওকে নামিয়ে দেবার আগে হঠাৎ বলল, “মিন্টুর সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয়। আমাকে বড় বোনের মত জানত। ওর মৃত্যুর খবর শুনে খুব মুষড়ে পড়েছিলাম।”
রিমা কি বলবে বুঝতে পারেনি। তার কথা মিন্টু কখন বলেনি। কিন্তু মিন্টু খুব একটা বাক্যবাগীশ ছিল না। আসমাও কি ওকে মিন্টুর মৃত্যুর জন্য দোষী ভাবে? নিজের অজান্তেই চিন্তাটা চলে এলো মাথায়।
“ওদেরকে আমরা- আমি এবং আমার স্বামী- দেশ থেকেই চিনি,” আসমা আরেকটু খোলাসা করে বলে। “ওদের সম্বন্ধে এমন অনেক কথা আমি জানি যেটা তোমাকে আমি বলতে পারব না। সাবধানে থেক।”
রিমা আশা করেছিল আসমা আরোও কিছু বলবে। একই ছাদের নীচে বছর ছয়েক থেকেও সে মিন্টু কিংবা তার পরিবার সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানতে পারেনি। ধারণা করেছিল রাজনৈতিক কারণে দেশ ছেড়েছিল তারা। মিন্টু কিছু খুলে বলেনি, সেও কখন জানতে চায়নি।
ফায়জা ওর ফেরার অপেক্ষাতেই ছিল। “আজ কেমন গেল, মা?” কৌতুক উপচে পড়ছে ওর চোখে মুখে। “কাউকে চাঁপা টাপা দাওনি তো?”
রিমা সোফায় ধ্বসে পড়ল। মুক্তি! “নারে! আমার গাড়ির নীচে আজকে কেউ পড়েনি। বাঁচা গেছে। যা ভয় লাগে না! ড্রাইভিং করতে গিয়ে এতো ভয় পাবো কোন দিন ভাবিনি।”
দুই ছেলে ছুটে এসে ওর মনযোগ পাবার জন্য দুষ্টুমি ভরে কিছুক্ষণ ওকে নিয়ে টানাটানি করল। ফায়জাও মজা করবার জন্য ওদের সাথে যোগ দিল। তিনজনে তাই নিয়ে খুব খিল খিল হল কিছুক্ষণ। এই ছোটখাট আনন্দের মুহূর্তগুলো রিমার সবচেয়ে প্রিয়। এটাই ওকে পথ চলার পাথেয় জোগায়, এগিয়ে যেতে সাহস দেয়। এদের জন্যই ওকে বাঁচতে হবে। এখনও কত পথ যাবার বাকী।
সেই আনন্দময় অনুভুতিটুকু অবশ্য খুব দীর্ঘজীবি হল না। মিলা সন্ধ্যায় ফোন দিল। রিমার টেস্ট রিপোর্ট এসেছে। খুব খুলে কিছু বলল না কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হল খুব একটা ভালো নয়। বলল ডাক্তারের অফিসে এসে ডঃ ফাতিমার সাথে দেখা করতে। যদি পরবর্তি আধা ঘন্টার মধ্যে একটা উবার জাতীয় কিছু নিয়ে সে অফিসে চলে আসতে পারে তাহলে ফাতিমা ওকে খানিকটা সময় দিতে পারবেন রিপোর্টটা নিয়ে আলাপ করার জন্য। সেখানে অনেক ব্যাস্ততা এখন। মিলা একাই কাজ করছে। নইলে ঝট করে এসে নিয়ে যেত ওকে।
মিলা ফোন রেখে দেবার পর নির্জীব ফোনটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে বসে থাকে রিমা। ভেতরে ভেতরে একটা খারাপ অনুভূতি হচ্ছে। গত কয়েকটা দিন ধরে ওর পেটের ব্যাথাটা বেশ কমই ছিল কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু একটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কি হয়েছে জানাটা খুব দরকার। খুব খারাপ কোন অসুখ হয়ে থাকলে ওর সব পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। ওর পা কাঁপতে থাকে। মাথাটা ভীষণ ভারী মনে হয়। জানে নিজেকে কঠিন করতে হবে কিন্তু মাঝে মাঝে চাইলেও পারা যায় না। কয়েকটা গভীর শ্বাস নিয়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুল, তারপর জামাকাপড় পালটে একটা উবার ডাকল, ফায়জাকে বলল মিলার সাথে একটু গল্প করার জন্য কাছেই একটা টিম হর্টনে যাচ্ছে, তারপর ঝট করে বেরিয়ে পড়ল, ফায়জা সন্দেহভাজন হয়ে ওকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করবার আগেই। সবকিছু জানার আগেই মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না।
ডঃ ফাতিমা কম্পিউটারে লগ ইন করে ওর মেডিকেল রেকর্ড মেলে ধরলেন, দ্রæত নজর বোলালেন ওর টেস্ট রেজাল্টের উপর। ছোট কামরাটাতে তার সামনে চুপচাপ বসে দুশ্চিন্তায় সমানে ঘামছে রিমা। অবশেষে মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে রিমার দিকে তাকালেন ডাক্তার। পুরু চশমার পেছনে তার চোখজোড়া দূরতর মনে হলেও সেই দৃষ্টির উষ্মতাটুকু ধরতে অসুবিধা হয় না। রিমার উদ্বিগ্নতাটুকু ঝট করেই ধরে ফেললেন তিনি।
“নিজেকে শক্ত কর,” বললেন তিনি। “নামাজ পড়?”
তার কাছে যারা রোগ দেখাতে আসে ফাতিমা তাদেরকে মানসিক সমর্থনও দেন। তার রোগীদেরকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলাটা নিজের দায়িত্ব মনে করেন। অধিকাংশ মানুষই সেজন্য তাকে সম্মান করে, ভালোবাসে।
রিমা মাথা নাড়ে।
ফাতিমা হাসেন। “পড়ে দেখ। প্রার্থনার কিছু যাদুকরী ক্ষমতা আছে। মন এবং শরীর দুটোর জন্যই ভালো।” আবার মনিটরে চলে গেল তার দৃষ্টি। “তোমার পেটে একটা ওভারিয়ান সিস্ট হয়েছে। সেটা ক্যান্সারাস কিনা জানার জন্য একটা ঈঞ স্ক্যান করতে হবে, হয়ত চঊঞ স্ক্যানও করতে হতে পারে।” আবার রিমার দিকে তার দৃষ্টি ফিরল। “এই ওভারিটা তোমার জন্য একটা সমস্যা। তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি জানি না, কিন্তু তোমার তিনটা সুস্থ বাচ্চা আছে। তোমার ঐ ওভারিটাকে একেবারে কেটে ফেল্লেই মনে হয় ভালো হবে। ভবিষ্যতে ওটা নিয়ে আর ঘন ঘন সমস্যায় পড়তে হবে না। ভেবে দেখ। তোমার একটা ভালো ওভারি থাকবে। ভবিষ্যতে আরোও বাচ্চা কাচ্চা নিতে চাইলে সেটাও সম্ভব হবে। তোমাকে একজন গাইনোকলজিস্ট সার্জেনের কাছে পাঠাবো আমি। সে তোমাকে ডায়গনস্টিক টেস্টগুলো করাবে।”
রিমা একটা পরিত্রাণের নিঃশ্বাস ফেলে। ওভারিটা ফেলে দিলেই যদি এই সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তাহলে অসুবিধাটা কোথায়? বাচ্চাগুলোর বেড়ে ওঠা দেখতে চায় ও, সে জন্য সব কিছু করতে পারে। কিন্তু প্রসিজারটা কতখানি নিরাপদ সেটাই প্রশ্ন। ফাতিমা ওকে সেই ব্যাপারে নিশ্চিত করলেন।
চিন্তা করার জন্য রিমার আরেকটু সময় দরকার। ভবিষ্যত ঝামেলা এড়ানোর জন্য এই ধরনের চরম সিদ্ধান্ত নেয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অপেরেশনের কথা শুনলেই তো বুক কেঁপে ওঠে। যে কোন অপেরেশনরই কিছু না কিছু ঝুঁকি থাকে। ওকে দেখেই ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারল মিলা। বলল বাসায় চলে যেতে। কাজের পর ও আসবে।
২২.
মিলা আসতে আসতে রাত নটা বাজাল। আসার পথে চাইনিজ নিয়ে এলো, জানে বাচ্চারা পছন্দ করে। ঘরে ঢোকার পথে চাইনিজের ব্যাগটা রিমার হাতে তুলে দিল। “জানি দেরী হয়ে গেছে। কাজ থেকে মাত্র আধ ঘন্টা আগে বের হয়েছি।”
রিমা দরজাটা বন্ধ করল। “আগে হাত মুখ ধুয়ে এসো। ফায়জা টেবিলে খাবার দেবে।”
“বাচ্চারা খেয়ে নিয়েছে নাকি?” মিলা একটা টেবিলে ওর হ্যান্ড ব্যাগটা ছুড়ে দিয়ে সোফায় ধপাস করে বসল।
“আমরা তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম,” ফায়জা মায়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিতে নিতে বলল। “মা ভাত আর মুরগীর তরকারী রান্না করেছে।”
“দারুন!” মিলা এক গাল হাসি নিয়ে বলল। “তোমরা বাচ্চারা খাও চাইনিজ, আমরা খাবো ভাত।”
ফায়জা চলে গেল টেবিলে খাবার দিতে।
রিমা বান্ধবীর পাশে বসল। “অনেক ব্যাস্ততা গেছে অফিসে?”
মিলা কাঁধ ঝাঁকাল। “ডঃ ফাতিমার সাথে কাজ করে আনন্দ আছে কিন্তু অনেক সময় দিতে হয়। সে তো সারাদিন ওখানেই পড়ে থাকে। আমার কথা থাক, বল তুমি কেমন আছো। তখন দেখে মনে হচ্ছিল ভীষণ মুষড়ে পড়েছ।”
“না, না, মুষড়ে পড়িনি,” রিমা শান্ত গলায় বলল। “একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। এই ধরনের কোন অপারেশন আগে কখন হয়নি আমার। ভাবতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠছে।”
মিলা মাথা দোলাল। “সেটাই স্বাভাবিক। আমিও ঐসব খুব ভয় পাই। কিন্তু মনে রেখ, এটা ডঃ ফাতিমার ব্যাক্তিগত মতামত। তোমার গাইনোকলজিস্ট নেবে আসল সিদ্ধান্ত। কিন্তু গাইনোকলজিস্টের এপয়েন্টমেন্ট পেতে পেতে কয়েক মাস লেগে যাবে। চেষ্টা করছি এমার্জেন্সী বলে তাড়াতাড়ি কিছু একটা পাবার। দেখা যাক কি হয়।”
রিমা মৃদু হাসে। “তুমি না থাকলে কি যে হত আমার।”
মিলা ওর একটা হাত ধরে চাপ দিল। “এটুকু না করলে বোন হয়েছি কেন? বাচ্চাদেরকে বলেছ কিছু?”
“ফায়জাকে বলেছি। ছেলে দুটাকে বলে কোন লাভ নেই। ওরা বুঝবেও না।”
ফায়জা ওদেরকে খেতে ডেকে দুই ভাইকে টেবিলে বসে দুষ্টুমি করবার জন্য বকাবকি করতে লাগল। রিমা ওদেরকে খেয়ে নিতে বলল। ওরা দু বান্ধবী একটু পরে খাবে।
“ফায়জা শুনে কি বলল?” মিলা জানতে চাইল।
“সিস্ট নিয়ে কিছু প্রশ্ন করল। মনে হয় পরে ইন্টারনেটে গিয়ে একটু রিসার্চ করবে। বলেছি চিন্তার কোন কারণ নেই। কিন্তু ও আমার ভয়টা ঠিকই ধরতে পেরেছে।”
মিলা মাথা দোলাল। “অনেক স্মার্ট মেয়ে। চুপচাপ হলেও ভীষণ বুদ্ধিমতী। ওর বাবাও কি ঐ রকম ছিল?”
রিমা কাঁধ ঝাঁকাল। ফায়জার বাবা সম্বন্ধে ওর অনুভূতি মিশ্র। তাকে সে ঘৃণা করলেও তার প্রতি যথেষ্ট কৃতজ্ঞতাবোধও রয়েছে, হয়ত একটু আধটু ভালোবাসাও আছে। “বোধ হয়,” রিমা আনাগ্রহ নিয়ে বলে। “আমি মনে করি ও আমারই উত্তম এক প্রতিচ্ছবি।”
মিলা ঘাড় দুলিয়ে তার সম্মতি জানাল। রিমা নিজের অতীত সম্বন্ধে অল্প স্বল্প বললেও অনেক কিছুই সে জানে না। কৌতূহল থাকলেও সেই সব নিয়ে কখন জোরাজুরি করে নি ও। অতীত একজন মানুষের খুব ব্যাক্তিগত একটা ব্যাপার। রিমার অতীতের কোন ব্যাথাময় স্মৃতিকে উত্তোলিত করবার কোন আগ্রহ ওর নেই।
“তোমার সাথে একটা ব্যাপারে আলাপ করতে চেয়েছিলাম,” রিমা প্রসঙ্গ পালটে বলে।
“বল, শুনছি,” মিলা সাগ্রহে বলে। ও রিমাকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ দিতে চায়। ওর স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর ওর মনের মধ্যে ঠিক কি চলছে সেটা বোঝাটা দুষ্কর হয়ে উঠেছে।
“বাসায় ফেরার পর থেকেই চিন্তাটা মাথায় ঘুরছে,” রিমা আনমনে বলল। “সিস্ট-টার কি হবে সেটা বলার কোন উপায় নেই, কিন্তু ওটার কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকা যাক। আমার বয়েস এখন তেত্রিশ! আমার জীবনের একটা লক্ষ্য থাকা দরকার। থাকা দরকার একটা উদ্দেশ্য, ক্যারিয়ার। যখন বয়েস কম ছিল তখন অনেক স্বপ্ন ছিল। কিছু ভুল ভ্রান্তি করেছি কিন্তু সেসব নিয়ে অনুশোচনা করতে চাই না। অনুশোচনা করে কোন লাভ হয় না।”
“আমাকে এই কথা বলছ তুমি?” মিলা হাসে। “আমি হলাম ভুলের রাণী! অনুশোচনা হচ্ছে আমার দিবারাত্রির সঙ্গী। চেয়ছিলাম নার্স হতে। হলাম ডাক্তারের এসিস্ট্যন্ট। টাকা পয়সা নাই। প্রেম ভালোবাসা নাই। তোমার তো তবু তিন তিনটা বাচ্চা আছে। তুমি আমার চেয়ে কত এগিয়ে আছো ভেবে দেখেছ?”
“মিস মিলা, আমি ঠাট্টা করছি না। এই ক্যাশিয়ারের কাজে আমি জীবন শেষ করতে চাই না। আমি আরোও বড় কিছু করতে চাই।” রিমা গম্ভীরভাবে বলে। “আমাকে কিছু আইডিয়া দাও।”
মিলা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ওকে কিছুক্ষণ দেখল। “তোমার কোন ডিগ্রী আছে?”
রিমা মাথা নাড়ল। “আন্ডারগ্র্যাড শেষ করি নি। মাঝ পথে ছিলাম।”
“আবার পড়ছ না কেন?”
“এখন আর পড়াপড়ি করতে পারব না,” রিমা বলে। “প্রথম থেকে শুরু করতে হবে আবার। সংসার, কাজ, আকাশচুম্বী টুইশান ফি – নাহ, সম্ভবই না।”
“রিয়েল স্টেট কর না কেন?” মিলা বলল। “ওটা একটা ব্যবসার মত। কয়েকটা কোর্স করে লাইসেন্স নিতে হবে। তেমন কঠিন কিছু না। অনেক ইমিগ্রান্টরা এখন করছে। সাধারণ কাজের চেয়ে অনেক ভালো।”
রিমা একটু ভাবল। “এটা নিয়ে কখন চিন্তা করি নি। খোঁজ নিয়ে দেখব। আর কি আছে?”
“মেডিক্যাল এসিস্ট্যান্ট, ফার্মেসী এসিস্ট্যান্ট, মেডিকেল ইন্সট্রæমেন্ট টেকনিশিয়ান, পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার এই রকম বেশ কিছু বিষয়ে সার্টিফিকেশন করতে পারো। আরোও অনেক কিছু আছে। যদি চাও আমি তাহলে আরোও ভালো করে খোঁজ খবর নেব।”
“ফায়জাকে বলবখনে,” রিমা বলল। “তুমি এতো ব্যাস্ত থাকো। তোমার সময় কখন? আচ্ছা, সার্টিফিকেশন করার পর কাজ পাওয়াটা কি সহজ?”
মিলা কাঁধ ঝাঁকাল। “সহজ না। অনেক কম্পিটিশন কিন্তু লেগে থাকলে একসময় হয়েই যায়।”
ফায়জা ডাইনিং টেবিল থেকে আবার ডাকল ওদেরকে, “তোমরা খাবে না? সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
দুজনকে উঠতেই হল। মেয়েটার মেজাজ অনেক। টেবিলে গিয়ে বসল। রিমার মনটা ইতিমধ্যেই যেন ভালো হয়ে গেছে। মিলার সাথে আলাপ করার পর নিজের সামনে যেন নতুন আলোর রশ্মি দেখতে পাচ্ছে ও। অপ্রয়োজনে বেশ অনেকখানি সময় নষ্ট করেছে। কিন্তু এখনও নতুন করে শুরু করা সম্ভব।